নবীউর রহমান পিপলু ও নাইমুর রহমান, নাটোর নাটোরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে ‘যৌন হয়রানি’ আতঙ্ক। একের পর এক শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীদের যৌন হয়রানির ঘটনা অস্বস্তিতে ফেলেছে ছাত্রী ও অভিভাবকদের। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কমে যাচ্ছে ছাত্রীদের উপস্থিতি। অভিযুক্ত শিক্ষকদের বাঁচানোর জন্য ঘটনা ধামাচাপা দিতে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান প্রধানের তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে। তবে সম্মানের স্বার্থে ভুক্তভোগীরা আইনের আশ্রয় না নিলে অভিযুক্ত শিক্ষকরা শাস্তি ছাড়াই পার পেয়ে যাবেন বলে শংকা তৈরী হয়েছে।
ফেনীর সোনাগাজির মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যাকান্ডের আলোচিত ঘটনার পর নাটোরে শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীকে যৌন নিপিড়ন বা যৌনহয়রানির একাধিক ঘটনা উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। জেলার দুটি কলেজ ও দুটি স্কুলের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে। স্কুলের দুই শিক্ষককে কর্তৃপক্ষ বহিস্কার করলেও কলেজ কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি করেই দায় এড়িয়েছেন।
চলতি মাসের ১২দিনে নাটোর সদর, সিংড়া ও বাগাতিপাড়ার দুইটি কলেজ ও দুইটি উচ্চ বিদ্যালয়ে ছাত্রী যৌন হয়রানির ৪টি ঘটনা ঘটেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হল-নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলা সরকারী কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কলেজ, সিংড়া উপজেলার বিয়াম উচ্চ বিদ্যালয় ও বাগাতিপাড়া উপজেলার গফুরাবাদ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়।
চলতি মাসের ১১ই এপ্রিল নাটোর প্রেসক্লাবে স্থানীয় সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের উদ্দেশ্যে একটি খোলা চিঠি দেয়। চিঠিতে উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রীরা ওই বিভাগের প্রধান কাজী ইসমাইল হোসেনের বিরুদ্ধে সহপাঠীকে যৌন হয়রানির ও শরিফুল ইসলাম নামে এক প্রভাষকের বিরুদ্ধে ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার অভিযোগ আনে। এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলে স্থানীয় সংসদ সদস্যের নির্দেশে তদন্ত কমিটি করে কলেজ কর্তৃপক্ষ। তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বলা হলেও কলেজ কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে আর মুখ খুলছে না।
একই দিন সিংড়া বিয়াম উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৩ ছাত্রী ওই স্কুলের গণিতের শিক্ষক ফজলুর রহমানের বিরুদ্ধে রাতে ফোন করে কু-প্রস্তাব দেয়াসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগ এনে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর লিখিত অভিযোগ করে। অভিযোগের প্রেক্ষিতে কমিটি গঠন করে তদন্ত শেষে অভিযোগের সত্যতা মেলায় শিক্ষক ফজলুর রহমানকে বহিষ্কার করে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
গত ১৩ই এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কলেজের প্রভাষক স্বামী আব্দুল জলিলের বিরুদ্ধে এক কলেজের ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ করে তার স্ত্রী। অভিযোগের প্রেক্ষিতে গঠিত তদন্ত কমিটি ছাত্রী ধর্ষণের সত্যতা পেলেও কলজের অধ্যক্ষ বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছেন। অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে কেবল তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন অধ্যক্ষ। সর্বশেষ গত ২০শে এপ্রিল বাগাতিপাড়া উপজেলার গফুরাবাদ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষের ভেতর একা পেয়ে ৬ষ্ট শ্রণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা করে শিক্ষক আবুল কালাম। ওইদিন রাতে ছাত্রীর পরিবারের করা অভিযোগের প্রেক্ষিতে শিক্ষক কালামকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এসব যৌন হয়রানীর ঘটনার মধ্যে নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলা সরকারী কলেজে অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ হলেও প্রতিবেদন দেয়নি কলেজ কর্তৃপক্ষ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কলেজের অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। সিংড়া বিয়াম উচ্চ বিদ্যালয়ের অভিযুক্ত শিক্ষককে বহিষ্কার এবং বাগাতিপাড়া উপজেলার গফুরাবাদ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের অভিযুক্ত শিক্ষককে গ্রেফতার ও বহিষ্কার করা হয়েছে।
যৌন হয়রানির এসব ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অভিভাবক, সুধীজন, আইনজীবীসহ সর্বস্তরের মানুষ। দু-একজন লোলুপ শিক্ষকের কারণে পুরো শিক্ষক সমাজের বদনাম রোধে কঠোর আইন প্রয়োগ ও নৈতিক চর্চা বাড়ানোর তাগিদ তাদের।
সিংড়ার জুলফিকার আলম নামের সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রীর অভিভাবক জানান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রীদের যৌন হয়রানির ঘটনায় মেয়েকে স্কুলে পাঠাতে অস্বস্তিবোধ করছেন তিনি।
লালপুরের আশিকুর রহমান নামের এক অভিভাবক জানান, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা যৌন হয়নানির ঘটনা ধামাচাপা দিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেয়। তাই আইনের দ্বারস্থ হয়না কোন ছাত্রী।
আব্দুল কুদ্দুস নামের এক অভিভাবক বলেন, একটি কলেজের শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী যৌন হয়রানির ঘটনা অজ্ঞাত কেউ দেয়ালে লেখায় আমরা জেনেছি। সন্তান তার কলেজে কতটুকু নিরাপদ তা সহজেই অনুমেয়।
আলোচিত চার প্রতিষ্ঠানের তিনটিতেই শিক্ষার বিদ্যমান পরিবেশ নিয়ে কথা বলতে চাননি কেউ। শুধু সিংড়া বিয়াম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আজিজুর রহমান বলেন, ভবিষ্যতে যৌন হয়রানি এড়াতে শ্রেণিকক্ষে নজরদারী বাড়ানো এবং শিক্ষকদের এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ানো বন্ধ করা হবে।
জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি ও দিঘাপতিয়া এম কে কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘একজন ছাত্রী যখন শিক্ষক কর্তৃক যৌন হয়রানির শিকার হয়, তখন তা পুরো শিক্ষক সমাজের লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নাটোরের ঘটনাগুলোর সাথে জড়িতদের কঠোর শাস্তির দাবী করছি। কোন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সহযোগিতায় তারা যেন ছাড়া না পায়।’
আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী এডভোকেট মিলন রহমান বলেন, ভুক্তভোগীরা সাহস করে আইনের দরজায় কড়া না নাড়লে যৌন হয়রানির কোন প্রতিবিধান আশা করা যাবে না।
জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রসাদ কুমার তালুকদার বাচ্চা বলেন, ‘যৌন হয়রানির ঘটনা শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবকদের মধ্যে যে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে, তা নিরসনে ত্রিমুখী মতবিনিময় দরকার। আইনের আশ্রয় নিতে ভুক্তভোগীরা সংকোচবোধ করায় সামাজিক আন্দোলন অত্যন্ত জরুরী। এ কাজে রাজনৈতিক ও সমাজকর্মীদের এগিয়ে আসতে হবে।’
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রমজান আলী আকন্দ বলেন, নাটোরে ঘটে যাওয়া যৌন হয়রানির ঘটনাগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তারাও বিষয়টি তদন্ত করছেন। এসব ঘটনা এড়াতে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি নির্মূলে কমিটি করা দরকার। আগামী মাসে জেলা উন্নয়ন কমিটির সভায় জেলা প্রশাসককে এ বিষয়ে প্রস্তাব দেয়া হবে। সেই সাথে শিক্ষকদের নৈতিকতার চর্চা বাড়াতে হবে। শিক্ষকরা নিজেদের সম্মান রক্ষা না করতে পারলে, তা হবে দুঃখ জনক। ছাত্রীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানমুখী করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।
জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির ঘটনাগুলো শুনেই চলেছি। ভুক্তভোগীরা কেউই অভিযোগ করেনি। স্পর্শকাতর এসব ঘটনায় তাদেরই অভিযোগ করতে হবে। আগেই পুলিশের ভূমিকার পর অভিযোগ প্রমাণিত না হলে ভুক্তভোগির সামাজিকভাবে হেয় বা লাঞ্ছিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে।’ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শাহরিয়াজ বলেন, খুব শীঘ্রই আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের নিয়ে বসবো। যৌন হয়রানির অভিযোগ প্রমাণিত হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।