রাকিব হোসেন ও আমির আলী দুই বন্ধু। তারা উভয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বেরিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল। রাকিব ছাত্রলীগ আর আমির আলী ছাত্র ইউনিয়ন করত। কিন্তু বাস্তব জীবনে পা দিয়ে সব কিছু ছেড়ে তারা চাকরির জন্য ঘুরছে। তারা মেধাবী ছাত্র হলে কী হবে, চাকরির বাজার মন্দা। মামা-খালুও নেই যে তদবিরে চাকরি হবে। কাজেই নিজের যোগ্যতাই একমাত্র সম্বল।
দুই বন্ধু একসঙ্গে মেসে থাকে। টিউশনি করে জীবিকা নির্বাহ করে। প্রথমবার বিসিএস দিয়ে ভাইভায় বাদ পড়ে দ্বিতীয় দফায় আবার পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। একই সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও চাকরির জন্য ঘুরছে। এর মধ্যেই শুরু হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন। দুই বন্ধু প্রতিদিন শাহবাগে যায়। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। দিনে দিনে সেই আন্দোলন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। শাহবাগ থেকে আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছড়ায়। এরপর অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও ছড়িয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন থেকে রাজপথে আন্দোলন শুরু হয়। রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকা কলাপস করার মতো পরিস্থিতি হয়। আন্দোলনে বেশির ভাগই সাধারণ শিক্ষার্থী অংশ নেয়। এর সঙ্গে মূল ছাত্রসংগঠনের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। তার পরও সেই আন্দোলন তুঙ্গে উঠে যায়।
ছাত্র আন্দোলনের একপর্যায়ে সরকার কোটা বাতিল করার কথা ঘোষণা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে থেমে যায় আন্দোলন। শিক্ষার্থীরাও যে যার মতো ঘরে চলে যায়। কোটা সংস্কার আন্দোলন রাজনীতির জন্য অনেক কিছুই শিক্ষণীয় ছিল। কোনো রকম সংঘাত ছাড়া কিভাবে একটি আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়, তা কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা দেখিয়ে দেয়। আমাদের নতুন করে ভাবায়।
আন্দোলন সফল হওয়ায় দুই বন্ধু খুব খুশি। তাদের ধারণা, এখন নিশ্চিতভাবে তাদের চাকরি হবে। কেউ তাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। কিন্তু যখন তারা শুনতে পেল, কোটা বাতিল করা হবে না তখন তাদের মন খারাপ হয়ে গেল। দুশ্চিন্তায় দেয়ালে মাথা ঠোকে।
রাকিব বলে, খোদ প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বললেন, কোনো কোটা থাকবে না। এখন আবার কেন এই কথা বলা হচ্ছে? প্রধানমন্ত্রী তাঁর কথা রাখবেন না? নিশ্চয়ই তিনি কথা দিয়ে কথা রাখেন। তিনি তো কোটা সংস্কারের জন্য কমিটিও গঠন করে দিলেন। সেই কমিটি আবার তিন মাস সময় বাড়িয়ে নিল কেন? ঘটনাই কিছু বুঝলাম না।
আমির আলী বলল, কী জানি; আমিও বুঝতে পারছি না। এখন তো শুনছি, কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আমরাও তো পুরো বাতিল চাইনি। সরকার নিজের থেকেই বাতিলের ঘোষণা দিয়েছিল। আমরা তো ভাবলাম, চাইলাম মেঘ, পাইলাম বৃষ্টি! আর এখন দেখছি, চাল-চুলো সবই গেল! হায় রে কপাল!
শুধু শুধু কপালের দোষ দিয়ো না। আমাদেরও দোষ আছে। রাকিব বলল।
আমরা আবার কী করলাম?
আমরা যখন আন্দোলন করলাম তখন কিছু দুষ্ট ছেলে ‘আমরা আবার রাজাকার হব’ স্লোগান ফেস্টুনে লিখে কপালে লাগিয়েছে। ব্যানারে লিখে মিছিলে এনেছে।
ও আচ্ছা। এ জন্য কোটা বাতিল করা হবে না! এটা ঠিক না। তা ছাড়া তোমার মনে নেই; একজন মন্ত্রী সংসদে রাজাকারের বাচ্চা বলে গালি দিলেন। আমরা কি সবাই রাজাকারের বাচ্চা?
না, উনি আমাদের বলেননি। উনি বোঝাতে চেয়েছেন, সারা দুনিয়াতেই মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বা পোষ্যরা রাষ্ট্রের বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকে। বাংলাদেশে তারা খুবই নিগৃহীত হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তো তারা পুরোপুরি অবহেলার শিকার হয়েছিল। এই সরকার না দেখলে মুক্তিযোদ্ধাদের কে দেখবে?
সেটা অবশ্য ঠিক। আচ্ছা বাদ দাও ওসব কথা। শোনো, এখন কী হবে? আবার কি রাজপথে নামতে হবে?
আবার রাজপথে! ক্যাম্পাসেই তো কেউ নামতে পারছে না। ছাত্রলীগ সবাইকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করছে। তবে সমস্যা হয়েছে কি জানো?
কী, বলো দেখি!
বিএনপি আমাদের আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে ভুল করেছে। এখন সরকার এর মধ্যে রাজনীতি খুঁজছে। বুঝতে পারছ কিছু?
হুম। বুঝব না! বিএনপিকে কে নাক গলাতে বলেছে। নিজেরা তো কিছু পারে না। অন্যদেরটাও নষ্ট করে!
ওই কারণেই আমার মনে হয় কোটা সংস্কারসংক্রান্ত কমিটি তিন মাস সময় নিয়েছে। তার মানে বুঝতে পারছ?
মানে কী?
তিন মাস পর অন্তর্র্বতী সরকার আসবে। তারা শুধু সরকারের রুটিন কাজ করবে। নীতিনির্ধারণী কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। কোটা সংস্কারের বিষয়টি নীতিনির্ধারণী বিষয়। তাই অন্তর্র্বতী সরকার এ বিষয়ে কিছু করতে পারবে না। পরবর্তী সরকারের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
তার মানে কোটা ঝুলে গেল!
তাই তো মনে হচ্ছে।
আমাদের আন্দোলন জলে গেল!
জলে যায়নি। তবে এখনই যে কিছু হচ্ছে না তা পুরোপুরি বোঝা যাচ্ছে।
আমাদের চাকরির কী হবে! বয়সও তো থাকছে না! হায় রে কপাল!
চুপ করো তো! চুপ করো। আর কপালের দোষ দিয়ো না!
-লেখক : মোস্তফা কামাল, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক