জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, জাগোনাটোর২৪॥
নাটোরে ভোটের রাজনীতিতে সরব একমাত্র দল আওয়ামী লীগ। গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকেই হঠাৎ করে দলটিতে বইতে শুরু করে নির্বাচনী হাওয়া। হঠাৎ করেই দলটির ভোটের রাজনীতিতে নেমে এসেছে নীরবতা। এমন নীরবতায় অনেকের মনে প্রশ্ন, কি হচ্ছে আওয়ামী লীগে?
এক বছর আগেও নাটোর উত্তপ্ত ছিল আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে। জেলার ৪টি সংসদীয় আসনের ৩টি তে দলীয় কোন্দল আর আধিপত্য বিস্তারের জেরে স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা দ্বন্দ্বে জড়ান নিজ এলাকার সাংসদদের সাথে। এ শুরু হয় গ্রুপিং যার নেতৃত্ব ছিলেন সাংসদবিরোধী এক একজন নেতারা। শুরুটা এখান থেকেই। এরপর থেকে তারা বিভিন্ন উপায়ে সাংসদদের বিরোধীতায় লিপ্ত থাকে। পোস্টার,ব্যানারিংসহ বিভিন্ন উপায়ে নিজেদের বর্তমান সাংসদদের বিপরীতে দলীয় ‘মনোনয়ন প্রত্যাশী’ হয়ে জানান দেন নিজেদের সম্ভাব্য প্রার্থীতা। পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়ে বিরোধে জড়ান কেউ কেউ। এতে করে দলীয় কোন্দল প্রকাশ্য রুপ নেয়। সংকটে পড়ে নেতৃত্ব। মনোনয়ন নিয়ে একে অপরের দূর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ, পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন প্রকট আকার ধারণ করলে তা নিরসনে কাজ শুরু করেন খোদ দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ঢাকায় বিবাদমান নেতৃবৃন্দকে ডেকে শোনেন সকলের অভিযোগ। নির্দেশনা দেন ঐক্যবদ্ধ থাকার। তৃণমূলের কোন্দল নিরসনের মাধ্যমে দলকে সংগঠিত করার জন্য প্রথম কর্মীসভা দেন নাটোরেই। এরপর থেকেই ভোটের রাজনীতির উত্তাপ একটু একটু করে কমতে শুরু করে। এর কিছুদিন পরই জাতীয় দৈনিকগুলোতে দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রে গ্রিন সিগনাল পাওয়া দুএকজন প্রার্থীর নাম প্রকাশিত হলে আবারো উত্তেজনা শুরু হয় মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে। বাড়তে থাকে মনোনয়ন চাওয়ার ঘোষণা নিয়ে উত্তেজনা।
এই যখন অবস্থা, তখন হঠাৎই নীরব আওয়ামী লীগ। যেন থেমে গেছে ভোট নিয়ে পরস্পরবিরোধী আলোচনা, মনোনয়ন নিয়ে প্রতিযোগিতা। নাটোর-১, ২ ও ৪ আসন ঘুরে দলটির স্থানীয় থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলে জানা গেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কারো মতে, গত ২৩ শে জুন গণভবনে দলের বর্ধিত সভা ও ৩০শে ইউনিয়ন পর্যায়ের তৃণমূল নেতাদের সাথে বর্ধিত সভার পর থেকে এমন পরিবর্তন শুরু হয়েছে। স্পষ্টভাষায়, দলীয় সভানেত্রী আসন্ন নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের যে সাবলীল নির্দেশনা দিয়েছেন, সেটা পালন করতেই আপাতত একটু থমকে গেছেন তারা। কারো দাবী, এতোদিন প্রকাশ্যে প্রার্থীতা জানান দিয়ে দলের কোন কোন নেতা সরাসরি দলের বিরোধীতা করেছেন। স্থানীয় এমপিদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে দলকে হেয় করেছেন ভোটারদের কাছে। কোন্দল প্রকাশ্যে এনে দলকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তারা চুপসে গেছেন প্রধানমন্ত্রীর দেয়া বক্তব্যের পর। কারো মতে, বর্তমান সাংসদ ও সম্ভাব্য অনান্য মনোনয়নপ্রত্যাশীদের উভয়ই ‘ধীরে’ চলছেন কারণ তাদের কর্মকান্ডে গত সাড়ে ৪ বছর বিব্রত হয়েছে মূলত সরকার।
সম্প্রতি, নাটোর-২ আসন থেকে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী এক নেতা আত্নপ্রচারের চিরাচরিত ব্যানারের বদলে দলের পক্ষে বিশেষ করে নৌকার পক্ষে ভোট প্রার্থনা সম্বলিত ব্যনার প্রস্তত করতে দেখা গেছে। নাটোর-১ আসন থেকে দলের মনোনয়ন চাওয়া অপর এক শীর্ষ নেতাকে ঈদের পর আর মাঠে দেখা যায়নি। নাটোর-৪ আসনেও কোন কোন সম্ভাব্য প্রার্থীরাও মুখে কুলুপ এঁটেছেন রহস্যজনক কারণে।
দুই দফায় দলটির বর্ধিত সভায় অংশগ্রহণকারী নাটোরের অন্তত ১০ জন নেতা-কর্মী দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বরার দিয়ে একমত পোষণ করে জাগো নাটোরকে জানিয়েছেন, যে কোন সময়ের চেয়ে আসছে নির্বাচনে সবচেয়ে সূক্ষ বিচারের মাধ্যমে মনোনয়ন প্রক্রিয়া শুরু হবে। এমপি বা মনোনয়নপ্রত্যাশীদের এমন ভাবার কারণ নেই, যে খুব সহজে তারা মনোনয়ন পাবেন। দল কার জন্য কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার হিসেবটুকুও করা হবে।
তবে দলের দায়িত্বশীল নেতারা হঠাৎ নীরবতার বিষয়টি মানতে নারাজ। তাদের মধ্যেই এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। তাদের একাংশের দাবী, সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটি দলের একটি কৌশল। তবে সারাদেশেই এ অবস্থা। দলীয় প্রধানের কড়া নির্দেশনায় মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে যারা বিশৃঙ্খলা করেছিলেন, তাদের কেউ সতর্ক হচ্ছে, কেউ কৌশলী হচ্ছে। অপর অংশের মতে, এমপিদের ভুল সংশোধনের মাধ্যমে গণমুখি ও মনোনয়ন প্রত্যাশী অন্যদের দলের পক্ষে কাজ করার নির্দেশনা দেবার পর তারা আরো সক্রিয় হয়েছে। কেউ বলছেন, বর্তমান সাংসদরা পুনরায় মনোনয়ন পেতে কেন্দ্রে দৌঁড়ঝাপ শুরু করেছেন এখন থেকেই। সরকারের মেয়াদের শেষদিকে এলাকায় না থেকে রাজধানীতেই ধর্ণা দিচ্ছেন তারা যে কারণে দলের কর্মীরাই খেই হারাচ্ছে। তারা নির্দেশনার অভাবে ভুগছে। এসব কারণেই এখানে ভোটের রাজনীতিতে একটু মন্দাভাব বিরাজ করছে।
বড়াইগ্রাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট মিজানুর রহমান জাগো নাটোরকে জানান, ‘একটি বার্তা দেয়া হয়েছে। এটি ঐক্যবদ্ধ হবার বার্তা। দলীয় বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হলে আওয়ামী লীগের জয় ঠেকানো যাবে না। আওয়ামী লীগের মতো বৃহত্তম দলে কোন্দল না থাকলে রাজনীতির সৌন্দর্য থাকবে না। সেই বিবাদ কোন্দল নিরসনের উপযুক্ত সময় এখন বলেই প্রকাশ্যে তা দৃশ্যমান নয়। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে রাজনীতিতে সামান্য নীরবতা বিরাজমান। বিষয়টি অন্যভাবে না নেয়াটাই ভালো।’
বাগাতিপাড়া পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি আব্দুল হামিদ মিয়া বলেন, ‘ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মেনে বাগাতিপাড়ায় দলের বিবাদমান নেতারা তাদের চিরাচরিত ‘অভিযোগের রাজনীতি’ থামিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। লালপুর উপজেলা সাথে নিয়ে আসনটি গঠিত হলেও বাগাতিপাড়ায় এখনো কিছুটা দলীয় সমন্বয়ের অভাব আছে। এটি নিরসন হওয়া দরকার।
জেলা মহিলা আওয়ামী লীগ সভাপতি রত্না আহমেদ সাময়িক নীরবতার বিষয়টি মানতে নারাজ। তিনি বলেন, ‘ নাটোরে যতই পাল্টাপাল্টি গ্রুপিং থাকুক দলের রাজনীতি পরিচালিত হয় এমপিকেন্দ্রিক। বর্তমানে নাটোর-২ আসনের সাংসদ শফিকুল ইসলাম শিমুল দেশে না থাকায় কর্মীরা একটু অগোছালো রয়েছে। তিনি ফিরলে রাজনীতি আবারো চাঙ্গা হয়ে যাবে। এটি স্বাভাবিক বিষয়।’
এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও নাটোর-২ আসনের সাংসদ শফিকুল ইসলাম শিমুল দেশের বাইরে অবস্থান করায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। তবে রোববার একটি অনুষ্ঠান শেষে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মোর্তোজা আলী বাবলু জাগো নাটোরকে বলেন, ‘ প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভাপতির নির্দেশ অমান্য করার সুযোগ নেই। ভুলত্রুটি শুধরে তিনি দলকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তত করার তাগিদ দিয়েছেন। সেটি মেনে নিয়েই এখন সকলে রাজনীতি করছে। আশা করছি মনোনয়ন প্রদানের পূর্ব পর্যন্ত নাটোরে দলের রাজনীতিতে এমন অবস্থাই বিরাজ করবে। ‘