সাইফুল ইসলাম, সিংড়া॥
একটি গভীর নলকূপ ছিল বহু দেন-দরবারের ফসল। এই-দফদর, সেই-দফতর ঘুরে ঘুরে আর কৃষকদের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় প্রায় চার দশক আগে মিলেছিল নলকূপটি। কয়েকবছর ধরে কৃষকরা প্রিপেইড কার্ডে বিদ্যুতের মূল্য পরিশোধ করার মাধ্যমে সেচ সুবিধা গ্রহন করছিলেন। তবে হঠাৎ নলকূপটির বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার চুরি হওয়ায় এবারের মতো ধানের আবাদ শেষ।
কথাগুলো বলছিলেন নাটোরের সিংড়া উপজেলার প্রত্যন্ত রামানন্দ ইউনিয়নের বসন্তপুর গ্রামের ধানচাষী আবের আলী, সোহেল রানা ও সুশান্ত কুমার। তারা জানান, ২০১৭ সালের অকালবন্যা আর ২০১৮ সালে কচুরীপানায় অচল হওয়া চলনবিলে ভালোমত ধানের আবাদ হয়নি। তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন হওয়ায় নতুন উদ্যমে ধান চাষ শুরু করেছিলেন তারা। তবে হঠাৎ করে একমাত্র নলকূপটি ট্রান্সফরমার চুরির কারনে বন্ধ হওয়ায় নিজেদেরসহ আশেপাশের প্রায় দুইশ’ বিঘা জমির আমন ধান চাষ হুমকিতে পড়েছে। তারা আক্ষেপ করে বলেন, আমাদের ভাগ্য এতটাই খারাপ যে এক সময় পানির কারণে আর এখন পানির অভাবে আমরা চাষাবাদ করতে পারছি না।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, ১৯৮০ সালে তৎকালীন বিআরডিবি কর্তৃপক্ষ বসন্তপুর সমাজকল্যাণ সমিতি গঠন করে। সমিতি ঋণের মাধ্যমে ডিজেল চালিত গভীর নলকূপ স্থাপন করে। পরে ১৯৯৪ সালে নলকূপটিতে বিদ্যুত সংযোগ দেওয়া হয়। ২০০২ সালে বরেন্দ্র বহুমুখি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গভীর নলকূপটিতে চার হাজার ফুট ভূগর্ভস্থ পানি সরবরাহ নালা তৈরি করে দেয়। তখন থেকে তাঁদের নিয়ন্ত্রণে চলছে নলকূপটি। তখন থেকেই বসন্তপুর ও আশেপাশের এলাকার দেড় শতাধিক কৃষক জমি সেচের জন্য নলকূপটির উপর নির্ভরশীল। গত মাসের (আগস্ট) শেষদিকে রাতের আধারে বসন্তপুর মাঠের গভীর নলকূপের বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারটি চুরি করে নিয়ে যায়। তখন থেকেই দুইশ বিঘা জমিতে রোপণ করা ধান ক্ষেতে সেচ দেওয়া বন্ধ হয়ে রয়েছে। তবে চলতি সপ্তাহের শুরুতে কয়েকজন কৃষক বিকল্প উপায়ে সেচের ব্যবস্থা করেছেন। এসব জমিতে প্রতিদিন অন্তত দুইবার করে সেচ দেওয়া দরকার হলেও তা আর সম্ভব হচ্ছে না। এতে ধানের ফলন কমসহ ধান জমিতেই চিটা হবার আশঙ্কা তৈরী হয়েছে।
স্থানীয় কৃষক প্রশান্ত প্রামাণিক এবার ৩৫ বিঘা জমিতে ধানের আবাদ করেছেন। তিনি জানান, ট্রান্সফর্মার চুরির কারনে সেচ দিতে না পারায় দুদিনেই রোপনকৃত ধানের চারা মরতে শুরু করে। চারাগুলো বাঁচাতে বিকল্প উপায়ে সেচের ব্যবস্থা করেছেন তিনি।
নলকূপের আওতাধীন কৃষক কানাই দাস ও বলাই দাস বলেন, চুরি যাওয়া ট্রান্সফরমারের স্থলে একটি নতুন ট্রান্সফরমার প্রতিস্থাপনে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করলেও তারা আমাদের ফিরিয়ে দিয়েছেন। চাষিরা চাঁদা তুলে অর্ধেক দাম ৭০ হাজার টাকা পরিশোধের কথা জানালেও তাঁরা তাতে রাজি হননি। পুরো টাকা নগদে দিয়ে ট্রান্সফরমার কেনা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
নলকূপ বন্ধ হওয়ায় কৃষকদের সাথে বিপাকে পড়েছেন এর অপারেটর বরুন চন্দ্র প্রামাণিক। তিনি বলেন, ট্রান্সফরমার থেকে সেচ সুবিধা গ্রহনকালে কৃষকরা ঘন্টাপ্রতি ৮ টাকা করে পারিশ্রমিক দিতেন। ট্রান্সফরমার চুরির কারনে ধানের জমিতে সেচ দেয়ার ভরা মৌসুম প্রায় বেকার হয়ে পড়েছি।
আব্বাস আলী নামের অপর এক কৃষক বলেন, নলকূপটির ট্রান্সফরমার চুরির পর থেকে আমরা নিরুপায় হয়ে পড়েছি। বিকল্প উপায়ে সেচ দিতে গেলে লাভের কিছুই ঘরে তোলা যাবে না।
বরেন্দ্র বহুমুখি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সহকারী প্রকৌশলী আনসার-উল-করিম চুরি হওয়া ট্রান্সফরমার প্রতিস্থাপনে নিজেদের অপরাগতা প্রকাশ করে জানান, নতুন ট্রান্সফরমার কিস্তির মাধ্যমে কৃষকদের কিনতে হবে। এছাড়া আর কোন উপায় নেই। তবে প্রয়োজন অনুযায়ী সাশ্রয়ী মূল্যে কৃষকরা নিজেরাও ট্রান্সফরমার তৈরি করেও নিতে পারেন।
এ বিষয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শ্রী তপন কুমার সরকার জানান, ট্রান্সফরমার চুরির বিষয়টি তিনি জানতেন না। তবে কৃষকদের সেচ সমস্যা সমাধানে কৃষি বিভাগ, উপজেলা প্রশাসন ও বরেন্দ্র বহুমূখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।