সিংড়া: মসিরন বেওয়ার বয়স আনুমানিক ৮৫ বছর। এ বৃদ্ধা প্রায় ২০ বছর যাবৎ সিংড়া পৌর শহরের দমদমা কবরস্থানের পাশে চকলেট ও বিড়ির দোকান দিয়ে আসছিলেন। স্থানীয়দের মাধ্যমে একদিন বিষয়টি জেনেছিলেন সিংড়া থানার অফিসার ইনচার্জ মনিরুল ইসলাম। সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তিনি নিজেই যান দমদমা কবরস্থানের সামনে। গিয়ে দেখেন, যা শুনেছেন অবস্থার এর চেয়েও করুন। দ্রুত ওসি বৃদ্ধাকে থানায় নিজ হেফাজতে নিয়ে আসেন এবং বৃদ্ধার ছেলে আবু সাইদকে ডেকে এনে মাকে তাঁর জিম্মায় দিয়ে ভরণ-পোষণের জন্য নির্দেশ দেন। অত:পর ছেলে মুচলেকা দেন যে মাকে সে দেখভাল করবে।
এটি একটি দৃষ্টান্ত শুধু। পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অনেক মানবিক কাজ করেন প্রচারবিমুখ নাটোরের সিংড়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মনিরুল ইসলাম। সিংড়ায় যোগদানের পর থেকে তিনি অসহায় মাকে সন্তানের কাছে, শিশু সন্তানকে মায়ের কোলে, শিকলবন্দী গৃহবধূকে উদ্ধার করা সহ বিভিন্ন কাজ করে ইতোমধ্যেই সিংড়াবাসীর মনে জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছেন। ব্যাপক গণসম্পৃক্ততার কারণে ওসি মনিরুল ইতোমধ্যেই সিংড়ায় ২৪ ঘন্টার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। এর আগে তিনি জেলার বাগাতিপাড়া, বড়াইগ্রাম, নলডাঙ্গা থানার অফিসার ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
উপজেলার কুষাবাড়ী গ্রামের মৃত হুসেন প্রামাণিকের স্ত্রী রহিমা বেওয়া প্রায় ১০ বছর পূর্বে তার স্বামীকে হারান। এরপর থেকেই তার ৭ ছেলে-মেয়ের পরিবারের সাথে জীবন যাপন করতে থাকেন। সম্প্রতি মেজ ছেলে বেল্লাল হোসেন একটু বেশি আদরের হওয়ায় তাকে জমি-জমা ও ঘর-বাড়ি লিখে দেন। একদিন সকালে ছেলের কাছে টাকা চাইলে মায়ের মুখে লাথি মেরে ফেলে দেয় ছেলে বেল্লাল হোসেন। গ্রাম্য প্রধানদের সামনেই করা হয় মারপিট।
এদিকে থানার সামনে মাটিতে বসে একজন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা মহিলাকে কাঁদতে দেখে স্থানীয় সাংবাদিকদের সহযোগিতায় বিষয়টি সিংড়া থানার ওসি মনিরুল ইসলামকে অবগত করা হয়। বৃদ্ধার ছেলে বেল্লালকে থানায় ডেকে তার মাকে হাতে তুলে দেন ও মায়ের সব দায়িত্ব বুঝে দেন ওসি মনিরুল ইসলাম।
উপজেলার বেলোয়া গ্রামের মৃত মছির উদ্দিন প্রামাণিকের স্ত্রী ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা মর্জিনা বেওয়া দীর্ঘ দিন ধরে ছেলেদের অবহেলার শিকার হয়ে আসছিলেন। পরে বিষয়টি সিংড়া থানা পুলিশ জানতে পেরে সম্প্রতি সেই অবহেলিত বৃদ্ধাকে তার ছেলে মহাব্বত প্রামাণিকের কাছে দায়িত্ব বুঝে দেন ওসি মনিরুল ইসলাম। আর কোন দিন ‘মা’ কে অবহেলা করবে না মর্মে ছেলের কাছ থেকে নেয়া হয় মুচলেখা।
যৌতুক লোভী স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বিছানায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন মমতাজ বেগম (২২) নামের এক গৃহবধু। স্বামীর মধ্যযূগীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে।
মমতাজ বেগমের ভাষ্য অনুযায়ী, স্বামী ও শ্বাশুরী শাফিয়া বেগম মিলে মাঝে মধ্যে তাকে যৌতুকের টাকার জন্য মারপিট করে। একদিন সন্ধ্যায় একই বিষয় নিয়ে ঝগড়া লাগলে স্বামী এবং শ্বাশুরী তাকে বেধড়ক মারপিট করে। খবর পাওয়ার পর রাত ১টায় হাসপাতালে নির্যাতিতা মমতাজ বেগমের কাছে ছুটে যান সিংড়া থানার ওসি মনিরুল ইসলাম। মমতাজ বেগমের কাছে ঘটনা শুনে দেড় বছরের সন্তানকে রাত ৩টায় তার কোলে ফিরিয়ে দেন তিনি।
উপজেলার ডাহিয়া ইউনিয়নের গাড়াবাড়ি গ্রামে রেবেকা নামে এক গৃহবধূকে মাঝে মধ্যেই তার স্বামী শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতেন। স্থানীয় সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাৎক্ষনাৎ গভীর রাতে তিনি সঙ্গীয় ফোর্সসহ রওনা দেন উপজেলার দূর্গম এলাকায় এবং তাকে উদ্ধার করে তার পিতার বাড়িতে পৌছে দেয়।
মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রহমানের বিধবা মেয়ে দেলচানের মুখেও হাসি ফুটিয়েছিলেন ওসি মনিরুল ইসলাম। দেলচান জানান, আমি ১ বিঘা জমি আবাদ করলে পার্শবর্তী গুরুদাসপুর উপজেলার বিয়াঘাট ইউনিয়নের হরদমা গ্রামের সোহরাব তার ধান জোড়পূর্বক কেটে নেয়। দীর্ঘদিন থেকে ঘুরে কোন সমাধান হয়নি। দীর্ঘদিনের জমির ধানের টাকা নিয়ে প্রতিপক্ষের সাথে বিরোধ চলছিলো, ওসি বিষয়টি জানতে পেরে দেলচানের সমুদয় টাকা আদায় করে তাঁর হাতে তুলে দেন।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের সিংড়া উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক পরিবেশকর্মী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর উপজেলা পর্যায়ের শীর্ষ কর্তা হলেও অফিসার ইনচার্জ মনিরুল ইসলাম অন্যদের চেয়ে আলাদা। অন্যরা যেখানে রুটিন দায়িত্ব পালন করেন শুধু, তখন ওসিকে পাওয়া যায় চব্বিশ ঘন্টাই। তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর মানুষের মধ্যে মানবতাবোধের জাগরণে কাজ করছেন।’
সিংড়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘মানবতার পাশে দাঁড়ানো সকলের কর্তব্য। সবাই যদি স্ব স্ব অবস্থান থেকে মানবতার জন্য এগিয়ে আসে তাহলে এ বিশ্ব হবে ভালবাসায় পরিপূর্ণ।’
সবাইকে তিনি মানবতার জন্য এগিয়ে আসতে আহ্বান জানান সেই সাথে ভবিষ্যতে তিনি এ রকম কাজ আরও করার জন্য প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।