নবীউর রহমান পিপলু ও নাইমুর রহমান, বড়াইগ্রাম ঘুরে
গত আটদিন ধরে চলছে গ্রামবাংলার চিরায়িত হালখাতা। তবে এই হালখাতা আয়োজন কোন বিত্তবানের নয়, নয় কোন ব্যবসায়ীর। একজন খেয়া মাঝির হালখাতা। বিত্তবানের বৈভবের জৌলুস নেই ঠিকই তবে আছে সৌখিন এক মনন। বলা যেতেই পারে- এ যেন কুঁড়ে ঘরে থেকে বাবুঁই পাখির শান্তির বড়াই।
নাটোর জেলার বুক চিরে যাওয়া এককালে গভীর ও খরস্রোতা বড়াল নদী। একপাড়ে বড়াইগ্রাম এবং অপর পাড়ে বাগাতিপাড়া উপজেলা। বড়াইগ্রামের রামাগাড়ি এবং বাগাতিপাড়া উপজেলার চন্দ্রখইড় বাজারকে যেমন ভাগ করে গিয়েছে এই নদী, ঠিক তেমনই এই দুই উপজেলায় সংযোগ ঘটিয়েছে বড়াল নদী। তাই রামাগাড়ি ও চন্দ্রখইড় সংযোগস্থলে গত তিন দশক ধরে ন্যুনতম জীবিকার ব্যবস্থা করে আসছে মাঝি অজিত কুমার। নদীর বুকে নৌকা বেয়েই চল্লিশ বছর ধরে পার করেছেন অজিত কুমার। বর্ষায় প্রমত্ত বড়ালে নৌকায় অজিত মাঝি এপারের লোককে ওপারে পার করে দেন। বাকী সময়টা কষ্টে দিন গুজরান করেন। এখন নদীতে পানি না থাকায় এই নদীতে দীর্ঘ বাঁশের সাঁকো এখন রামাগাড়ি ফেরিঘাট। এই রামাগাড়ি ফেরিঘাট খ্যাত দীর্ঘ বাঁশের সাঁকো দুই উপজেলার ২০টি গ্রামের প্রায় ৫০ হাজার মানুষের নদী পারাপারসহ চলাচলের একমাত্র মাধ্যম।
আবহমান কাল থেকেই গ্রাম বাংলার মানুষ হালখাতার সঙ্গে পরিচিত। নতুন প্রজন্মের কাছে নিছকই একটি অনুষ্ঠান। অন্য হালখাতা একদিন হলেও অজিত মাঝির এ হালখাতা চলে আট দিনব্যাপী । উপজেলা প্রশাসন থেকে বার্ষিক পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে ইজারা নেয়া মাঝি অজিত কুমার এ হালখাতার আয়োজন করেছেন। বৈচিত্র্যময় এ আয়োজন স্থানীয় বাসিন্দাদের মাঝে দারুণ কৌতুহল সৃষ্টি করেছে। এক সময় খেয়া নৌকা থাকলেও কয়েক বছর ধরে স্থানীয় অজিত মাঝি নদীতে চারফুট চওড়া ও প্রায় আড়াই’শ ফুট দীর্ঘ বাঁশের সাঁকো তৈরী করেন। নৌকার পরিবর্তে এ সাঁকোয় পারাপারে কেউ নগদ দেন, কেউ বকেয়া রাখেন। পরে বাৎসরিক হিসোবে ধান বা টাকা নেন তিনি। তবে দূর-দূরান্তের যারা চলাচল করেন তাদের বাড়ী গিয়ে ধান বা টাকা সংগ্রহ করা সম্ভব না হওয়ায় এই হালখাতার আয়োজন। মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা যায়, ঘাটের পূর্ব পাশে রঙিন কাগজ আর লাল নীল বাতিতে সাজানো ছোট্ট প্যান্ডেলে হালখাতা চলছে। পাশে ঝুলছে রামাগাড়ি ফেরিঘাট লেখা সাইনবোর্ড। গেটে বড় বড় অক্ষরে লেখা শুভ হালখাতা। হালখাতায় আমন্ত্রিতরা হাসিমুখে লুচি-মিষ্টি খাচ্ছেন। প্রায় সাড়ে তিন হাজার লোক আটদিন ব্যাপী চলা এ হালখাতায় অংশ নিয়েছেন বলে জানান অজিত মাঝির পরিবার।
হালখাতা প্রসঙ্গে অজিত কুমার মাঝি জানান, বনপাড়া, রামাগাড়ী, দয়ারামপুর, বিদ্যুৎনগর, চন্দ্রখইড়, বাটিকামাড়ি, দরাপপুর, সাতসৈল, চাঁদপুর ও সোনাপুর হাটসহ আশপাশের হাটগুলো সপ্তাহের বিভিন্ন দিনে বসে। দূর-দুরান্তের লোকজন হাটের দিনে সাঁকো পার হয়ে বেচাকেনা শেষে হালখাতা করে বাড়ি ফিরবেন। একেক এলাকার লোক একেক হাটে যায় তাই তাদের সুবিধার জন্য বেশি সময় ধরে হালখাতা করতে হচ্ছে। এতে তার খরচ বেশি হলেও সবার সুবিধার্থে এমনটি করতে হচ্ছে। এভাবেই তার জীবনের সিংহভাগ কেটে গেছে। বাপ-দাদারাও এই পেশায় জীবন কাটিয়েছেন। স্বাধীনতার পরও নদীতে পানি প্রবাহ ছিল। এখন নদী ভরাট হয়ে গেছে। তাই মানুষের পারাপারের জন্য বাঁশের সাঁকো করে দিয়েছেন। মোটর সাইকেল, ভ্যান ও রিক্সা এবং অটো সবই পারাপার হয়। দুর-দুরান্তের মানুষ নগদ দিয়ে যায়। স্থানীয়সহ আশেপাশের গ্রামের মানুষদের জন্য এই হালখাতা । এই খেয়া পারাপার করে স্ত্রী সন্তান নিয়ে বেশ সুখেই কাটছে তাদের দিন। তবে এই খেয়াপাড়ের মাঝিরও সুখের বাতাসে অশনি সংকেত দেখা দিয়েছে। গত তিন দশক ধরে বংশপরাপর এই পেশায় জীবন কাটিয়ে আসছেন ওই খেয়া মাঝি। কিন্তু কালের বির্বতনে নদীপারাপারের আধুনিক ব্যবস্থা খেয়া মাঝির জীবনে দেখা দিয়েছে অশনি সংকেত। খেয়া ঘাটের পাশেই নির্মাণ করা হচ্ছে পাকা ব্রিজ। পথচারী সহ এলাকার মানুষের মাঝে আনন্দের জোয়ার বইতে শুরু করলেও শান্তি নেই রামাগাড়ি খেয়া ঘাটের মাঝি অজিত কুমারের। ব্রিজটি চালু হলে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে পথে বসতে হবে এমন আশংকায় দিন কাটছে অজিত মাঝির স্ত্রী সন্তানরা এখন বাঁশের সাঁকোর পাশে দাঁড়িয়ে অজানা শংকায় দিন কাটাচ্ছে।
অজিতের স্ত্রী আশা রানী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, এই খেয়াঘাট তাকে সুখের স্বপ্ন দেখিয়ে ছিল। দুই ছেলের একজন কলেজে পড়ে। এই খেয়া পাড়াপাড় বন্ধ হয়ে গেলে তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে। এছাড়া সংসার চলবে কি করে তা জানেন না। নিজেদের কোন জমিজিরাত নেই। খেয়া ঘাটের পাশেই সরকারী জমিতে তারা বাস করে। ব্রিজ হবে এতে আমাদের কোন ক্ষোভ বা দুঃখ নেই। তবে ব্রিজ চালু হওয়ার আগে সরকারীভাবে তাদের জন্য কিছু ব্যবস্থা করলে তারা স্বচ্ছলভাবে জীবন কাটাতে পারতেন।
বাগাতিপাড়া উপজেলার দয়ারামপুর ইউপি চেয়ারম্যান মাহবুবুল ইসলাম মিঠু বলেন, ‘অজিত মাঝির হালখাতা বড়াইগ্রাম ও বাগাতিপাড়া উপজেলার কয়েক গ্রামের মানুষ বেশ আনন্দের সাথে উপভোগ করে। এই হালখাতার কথা মুখে মুখে থাকে অনেকদিন ধরে। তবে ওই স্থানে ব্রিজ নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। ব্রিজটি চালু হলে অজিত মাঝির জন্য কিছু সমস্যা হবে। তবে সরকারীভাবে যদি সহায়তার কোন সুযোগ থাকে সে বিষয়ে অজিত মাঝিকে সর্বাত্মক সহায়তা করবেন। উপজেলা সমুহে সহায়তার জন্য অনলাইনে আবেদন করার পরামর্শ দিয়েছেন। এছাড়া তিনি তার পরিষদ থেকে এককালীন কিছু সহায়তার ব্যবস্থা করবেন।
অজিত মাঝির খেয়াপাড়ের হালখাতা এলাকার মানুষদের মাঝে কৌতূহলসহ আনন্দের সৃষ্টি করে বলে জানান বড়াইগ্রাম উপজেলার জোয়াড়ী ইউনিয়ন চেয়ারম্যান চাঁদ মোহম্মদ। তিনি বলেন, ‘ব্রিজ চালু হওয়ার পর অজিত মাঝি হয়ত বেকার হয়ে যাবেন। তাই তাকে কিভাবে সহায়তা করা যায় তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলব।’