নাটোরঃ নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার জয়ন্তিপুর গ্রামের মাহবুবুর রহমান ১৮ বছর ধরে করেন শিক্ষকতা। কিন্তু এমপিওভুক্ত না হওয়ায় বেতন পাননা তিনি। তাই অভাব অনটনের সাথে তাকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে নিত্যদিন। তার চোখ-মুখ জুড়ে কেবলই হতাশা, অপ্রাপ্তি আর বিষন্নতার ছাপ। জেঁকে বসেছে সংসারের অজস্র চাহিদাও। বুকের ভেতরে কষ্টের দগদগে ক্ষত নিয়ে বেশ আনমনা হয়ে গেছেন শিক্ষক মো. মাহবুবুর রহমান। বয়সও ফুরিয়ে আসছে তার। কণ্ঠে আর উচ্চারিত হয় না জ্ঞানের বাণী। অভাবী সংসারে স্ত্রী-সন্তানের খাবার যোগাতে সেই শিক্ষক মাহবুবুর আজ নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করছেন। তার চোখ দুটো আর স্বপ্ন দেখায় না। কষ্টের আবরণে ঢাকা পড়া অশ্রুসিক্ত চোখ জোড়া নির্বাক হয়ে কেবলই রডের সাথে আরেক রডের জোড় বাঁধছেন। মানুষ গড়ার এই কারিগর জীবন-জীবিকার তাগিদে বেছে নিয়েছেন রড মিস্ত্রির কাজ। বয়সের অন্তিম লগ্নে এসে শুরু করেছেন জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়। নিজেকে সঁপে দিয়েছেন শ্রমিকের কাজে। মরণপণ সংগ্রাম করছেন প্রতিনিয়ত।
মাহবুবুর রহমান নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার জয়ন্তিপুর দাখিল মাদরাসার সহকারী মৌলভী। দেড়যুগ আগে তিনি ওই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে চাকরি নিয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু ভাগ্যের নির্মমতা তাকে মর্যাদার পরিবর্তে দিয়েছে তিরস্কার। বেতনহীন চাকরি করছেন ১৮ বছর ধরে। এমপিওভুক্তির আশায় একে একে পার করেছেন দিন। বার বারই ভেঙ্গেছে আশা, পেয়েছেন বঞ্চনা। চলতি বছর নন এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিও’র নতুন বার্তায় আশায় বুক বেঁধেছিলেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন ঘোষণা না পাওয়ায় আশাহত হয়েছেন। ছেলে মেহেদী হাসানের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া, অসুস্থ মা-বাবার ওষুধ আর সংসারের খরচ জোগাতেই তিনি এভাবে রড মিস্ত্রির শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন।
শিক্ষক মাহবুবুর রহমান বলেন, স্ত্রী মরিয়ম বেগম, এক ছেলে, এক মেয়ে ও মা-বাবাসহ ছয় সদস্যের সংসার তার। ২০০০ সালে তিনি শিক্ষক হিসেবে ওই প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। এমপিওভুক্ত না হওয়ায় চাকুরির ১৮ বছর পেরোলেও বেতন পান না। মসজিদের ইমামের দায়িত্ব নিয়ে মাসে এক হাজার আর মসজিদে গণশিক্ষায় পাঠদান করে কিছু টাকা আয় করে সংসার চালিয়েছেন। কিন্ত জীবন যুদ্ধে আর পেরে উঠছিলেন না। অভাবের তাড়নায় বাধ্য হয়ে শ্রমিকের কাজে নেমেছেন শিক্ষক মাহবুবুর।
সরকারের ভৌতিক নিয়মের বেড়াজালে আটকে পড়েছে মাহবুবুরের মতো অসংখ্য শিক্ষকের ভাগ্য। বাগাতিপাড়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, এ উপজেলার স্তর পরিবর্তনসহ ১৪ প্রতিষ্ঠান ননএমপিও রয়েছে। এখানে কর্মরত আছেন ২ শতাধিক শিক্ষক-কর্মচারী।
জয়ন্তিপুর দাখিল মাদরাসার সুপারিনটেনডেন্ট রবিউল ইসলাম বলেন, ১৯৭৫ সালে স্থাপিত হয়ে ৪৩ বছরেও তার মাদরাসাটি এমপিওভুক্ত হয়নি। তিনি এই প্রতিষ্ঠানে যোগদান করার পর চোখের সামনে বিনাবেতনে কত জনকে অবসরে যেতে দেখেছেন, দেখেছেন এমপিওর আশায় থাকা সহকর্মীর অকাল মৃত্যু। তাদের মতো শিক্ষকদের এমন করুন পরিনতি চান না তিনি।
বাগাতিপাড়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষক-কর্মচারী সমিতির সভাপতি সাজেদুর রহমান বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে অল্পসংখ্যক প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়। কিন্তু পরে দীর্ঘ সময় ধরে আর কোনো প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়নি। এতে করে ননএমপিও প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত শিক্ষক-কর্মচারীরা বছরের পর বছর মানবেতর জীবনযাপন করছেন।