নাটোর অফিস॥
নাটোরের গুরুদাসপুরে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তিন ফসলি কৃষি জমি নষ্ঠ করে অবৈধ পুকুর খননের ফলে দিনের পর দিন কমে যাচ্ছে কৃষি জমি। গত ৫ বছরে কমেছে ১ হাজার ১৫১ হেক্টর ফসলি জমি। অবাধে পুকুর খনন বন্ধ না করা হলে স্থায়ী জলাবদ্ধতাসহ কৃষিজমির ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট কৃষকেরা। এছাড়াও সড়ক-মহাসড়কে ঝুঁকিপূর্ণ ভাবে চলছে মাটি বহণকারী ট্রাক্টর। এর ফলে যেমন কৃষি জমি কমছে, তেমনি পাকা রাস্তা গুলো দ্রুত সময়ের মধ্যেই চলাচলের অনুপোযগি হয়ে যাচ্ছে।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত উপজেলাব্যাপী সরেজমীনে গিয়ে দেখাযায়, উপজেলার হাড়ি ভাঙ্গা বিল, হাজিরহাট, চাপিলা, বিয়াঘাট, ধারাবারিষা, নাজিরপুর মশিন্দা মাঠসহ প্রায় ১০টি মাঠে এক্সভেটর মেশিন দিয়ে তিন ফসলি জমিতে পুকুর খনন করছে এক শ্রেণীর প্রভাবশালী সিন্ডিকেট চক্রের ব্যক্তিরা। ২০১৯ সালের ১২ই মে ঢাকাস্থ ‘লইয়ারস সোসাইটি ফর ল’ নামক একটি মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠনের পক্ষে মহাসচিব এড. মেজবাহুল ইসলাম আতিক বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে জনস্বার্থে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন। নাটোর জেলার নাটোর সদর, নলডাঙ্গা, সিংড়া, বাগাতিপাড়া ও গুরুদাসপুর উপজেলার নাম উল্লেখ করে কৃষি জমিতে পুকুর খনন বন্ধে আদালত এ নির্দেশ দেন। তবে আদালতের নির্দেশ কাগজে কলমে বাস্তবায়ন হলেও প্রতি বছর দুই-তিন ফসলি জমি পুকুর খনন করলেও এসব পুকুর খনন বন্ধে প্রশাসন কার্যক্ররী কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ স্থানীয় কৃষকদের। তবে পুকুর খননকারী মাটি ব্যবসায়ীদের দাবি উপজেলা প্রশাসনের কাছ থেকে মৌখিক অনুমতি নিয়েই এসব পুকুর খনন করা হচ্ছে।
উপজেলার মশিন্দা ইউনিয়নের কাছিকাটা মাঠে দেখাযায় মশিন্দা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহাবুব হাসান লাবু তার নিজের ৬ বিঘা জমিতে পুকুর খনন করছেন। একই জায়গায় রুহুল ও রফিক নামের দুই ব্যবসায়ী ৫ বিঘা জমিতে পুকুর খনন করে পাকা রাস্তা নষ্ঠ করে বিভিন্ন জায়গায় মাটি বিক্রি করছে। হাজিরহাট এলাকায় মহাসড়কের পাশেই আব্দুল আজিজ ১০ বিঘা জমিতে পুকুর খনন করে মহাসড়ক দিয়ে মাটি বিক্রি করছেন। এছাড়াও হাড়ি ভাঙ্গা বিলে শাহাদৎ হোসেন রান্টু, সানোয়ার হোসেন, কৃষি জমি নষ্ঠ করে পুকুর খনন করছে। চাপিলা ইউনিয়নের ধানুড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশেই খনন করা হচ্ছে পুকুর। ফলে বিদ্যালয়ে শব্দ দূষণসহ ভবিষ্যতে বিদ্যালয়ের নির্মাণাধীন বিল্ডিং ধসে পড়ার আশঙ্কা করছে স্থানীয়রা।
গুরুদাসপুর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পুকুর খননের ফলে উপজেলা জুড়ে আবাদি জমি কমেছে প্রায় ১ হাজার ১৫১ হেক্টর। ২০১৮ সালেও উপজেলা জুড়ে ফসলি জমির পরিমাণ ছিলো ১৫ হাজার ৮১৪ হেক্টর। ২০২২ সালে যেটা দাড়িয়েছে ১৪ হাজার ৬৬৩ হেক্টরে। এছাড়াও চলতি বছরের জানুয়ারী মাসের এই ১৯ দিনেও প্রায় ২৫০ বিঘা জমিতে পুকুর খনন করা হয়েছে। ২০১৮ সালে কমেছে, ১৩৪ হেক্টর,২০১৯,২০২০,২০২১ ও ২০২২ মিলে চার বছরে কমেছে ১ হাজার ১৭ হেক্টর।
এ দিকে উপজেলা মৎস অধিদপ্তর বলছে, গুরুদাসপুর উপজেলা জুড়ে মোট মাছের উৎপাদন ১০৩১৩.১৯ মে.টন। চাহিদার চেয়ে ৪৫৪২.৯৯ মে.টন মাছ বেশি উৎপাদন হচ্ছে। ৫৭৭০.৩ মে.টন চাহিদা থাকলেও উদ্বৃত্ত হচ্ছে ৪৫৪২.৯৯ মে.টন। উপজেলা জুড়ে এখন পর্যন্ত বেসরকারী হিসাবে প্রায় ১০ হাজার পুকুর রয়েছে।
হাজিরহাট এলাকার কৃষক নবীর উদ্দিন জানান, আমাদের এই মাঠে সারা বছর বিভিন্ন ফসল চাষাবাদ হয়। বিনাহালে রসূনের চাষ এই মাঠ থেকেই আদিকাল থেকে শুরু হয়েছে। কিন্তু দিনের পর দিন এক শ্রেণীর অসাধু ব্যক্তিরা তিন ফসলি জমি নষ্ঠ করে পুকুর খনন করছে। সেই সাথে সরকারের কোটি কোটি টাকার রাস্তা অবৈধ মাটি বহণকারী ট্রাক্টর দিয়ে নষ্ঠ করছে। মহাসড়ক দিয়ে বিভিন্ন ধরনের গাড়ি চলাচল করে। যে কোন সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের দূর্ঘটনা। এ বিষয়ে প্রশাসন তেমন নজরদারী করছে না। প্রতিবছর এই মাটি বহণকারী ট্রাক্টরের দুর্ঘটনায় শিকার হয়ে কেউ মারা যায় আর না হয় কেউ গুরুত্বর আহত হয়।
বনপাড়া হাটিকুমরুল মহাসড়ক দিয়ে চলাচলকারী বাস ড্রাইভার রফিকুল ইসলাম বলেন, ঢাকা টু রাজশাহী যাতায়াত করি আমরা। গাড়িতে অনেক যাত্রি থাকে। আমাদের গাড়ি গুলো হাজিরহাট এলাকায় আসলে পরিচালনা করতে হয় খুব সাবধানে এবং ধীরগতিতে। অনেক সময় হুট হাট করে ব্রেকও ধরতে হয়। মাঠ থেকে মাটি বোঁঝাই ট্রাক্টর হঠাৎ করেই মহাসড়কে উঠে পরে। এছাড়াও রাস্তায় অতিরিক্ত মাটি পরে থাকার কারনে সামান্য বৃষ্টি বা ভারি কোয়াশা হলেও মহাসড়ক পিচ্ছিল হয়ে থাকে। মহাসড়ক কাঁদা হয়ে থাকলে গাড়ি চালানো খুব বিপদজ্জনক হয়ে যায়। নিজের ও যাত্রীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েই চলাচল করতে হচ্ছে আমাদের।
প্রশাসনের লিখিত অনুমোদন নিয়ে পুকুর খনন করে মাটি বিক্রি করছেন কিনা জানতে চাইলে পুকুর খননকারী মাটি ব্যবসায়ী আব্দুল আজিজ মুঠোফনে বলেন, প্রশাসনের লিখিত কোন অনুমোদন নেওয়া হয়নি। তাছাড়াও জানেনতো সবি কিভাবে এগুলোর অনুমোদন হয়। মশিন্দা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহাবুব হাসান লাবু জানান, তার জমিতে ফসল না ফলার কারনে স্থানীয় ব্যবসায়ী ময়ছের,শামিম ও রঞ্জুকে চুক্তিবদ্ধ ভাবে পুকুরটি খনন করার কাজ দিয়েছেন। তবে প্রশাসনের কোন অনুমোতি নেই।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হারুনর রশিদ জানান, দিনের পর দিন ফসলি জমি নষ্ট করে পুকুর খনন করার কারণে আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। এতে কৃষির ওপর বিরুপ প্রভাব পরবে।
গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার শ্রাবণী রায় জানান, কৃষি জমিতে পুকুর খনন বন্ধে উপজেলা প্রশাসনের অভিযান অব্যাহত আছে।