নাটোর অফিস॥
সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে পরিচিত নাটোরের সিংড়ার বামিহাল গ্রাম আবারও অশান্ত হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসিন দলের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা একাধিক গ্রুপ আধিপত্য বিস্তারে একে অপরের ওপর হামলা চালানো হয়। এছাড়া এলাকাটি চলনবিলের প্রত্যন্ত এলাকা হওয়ায় এক সময় নিষিদ্ধ সংগঠন সর্বহারাদের অবাধ পদচারনা ছিল। এজন্য এই বামিহাল এলাকায় স্থাপন করা হয় পুলিশ ক্যাম্প। গত প্রায় দেড় যুগে তিন আমর্ড পুলিশ সহ ৯জন সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে সর্বহারাদের হামলায় ৩ আমর্ড পুলিশ নিহত হন। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে ২০০৩ সাল থেকে এই গ্রামে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠে নেতৃত্বের আধিপত্ত্য। এই সময় সর্বহারাদের কার্যক্রম স্থিমিত হয়ে পড়ে। তবে ২০০৫ সালে বামিহাল পুলিশ ফাঁড়িতে সর্বহারা সদস্যরা হামলা চালিয়ে ফাঁড়ি লুট সহ ৩ আমর্ড পুলিশকে হত্যা করে। এই ঘটনার পরবর্তী সময়ে বামিহাল পুলিশ ফাঁড়ি প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।
এই পুলিশ ফাঁড়ি প্রত্যাহার করার পর থেকে এলাকার আধিপত্য নিয়ে বিএনপি রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা কুদ্দুস বাহিণীর সাথে আফজাল বাহিনীর বিরোধ চরমে ওঠে। শুরু হয় হামলা -পাল্টা হামলার ঘটনা। ২০০৩ সালে আফজালের অনুসারি আফতাব খন্দকারের মা চাম্পা বেগম সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন। এদিন প্রতিপক্ষ কুদ্দুস অনুসারিরা আফতাবের বাড়িতে হামলা চালায়। কিন্তু না পেয়ে তার মা চাম্পা বেগমকে হত্যা করে। এই হত্যাকান্ডই বামিহাল গ্রামের প্রথম খুনের ঘটনা ঘটে। এর পর থেকে শুরু হয় একে অপরের ওপর হামলা ও পাল্টা হামলার ঘটনা। এর পর একে একে খুনের ঘটনা ঘটতে থাকে। প্রতিপক্ষদের হামলায় খুন হন শাজাহান, আনসার আলী,সোহান,আইয়্যুব আলীসহ ৫ জন। ক্ষমতার পট পরিবর্তন হলেও এদের রাজনৈতিক পরিচয়ও পরিবর্তন হয়। ২০০৮ সালে আওয়ামীলীগ রাষ্ট্রিয় ক্ষমতায় আসার পর আফজাল বাহিনী দল পাল্টে আওয়ামীলীগ বনে যান। অপর দিকে কুদ্দুস বাহিনীর অনুসারিরা কুদ্দুসের ভাই ফরিদ উদ্দিনের মাধ্যমে আওয়ামীলীগ বনে যায়। অভিযোগ রয়েছে ২০১৩ সালে ফরিদ ও কুদ্দুস বাহিনীর অনুসারিরা ১ নং ওয়ার্ড মেম্বার আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল জলিলকে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হাতের কব্জি বিচ্ছিন্ন করে। একই বছরে ফরিদ উদ্দিন অস্ত্র সহ র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে ফরিদ ফেনসিডিল সহ বগুড়া জেলার দুপচাঁচিয়া থানায় গ্রেফতার হন। ২০১৯ সালে আফজাল বাহিনীর প্রধান আফজাল ও তার ভাই আনসার বন্দুক যুদ্ধে নিহত হওয়ার পর আফতাব খন্দকার এই গ্রুপের নেতৃত্বে আসেন। এসময় আফতাব ওর্য়াড আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক হন।
সন্ত্রাসী হামলার শিকার ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সহ সভাপতি আব্দুল জলিল বলেন,বামিহাল গ্রামের নেতৃত্বদানকারীরা সুযোগ সন্ধানী। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে তখনই এরা ভোল পাল্টে সেই দলেই ভিরে যায়। এরা প্রভাবশালী হওয়ায় এদের ভয় পায় সাধারন মানুষ। দলীয়ভাবেও এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়না। তবে প্রশাসন এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও অদৃশ্য শক্তির বলে ছাড়া পেয়ে যায়। পরবর্তীতে অদৃশ্য ওই শক্তির চাপে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।
স্থানীয় সুত্রে জানা যায়,ইউপি সদস্য ও ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সহসভাপতি ফরিদ উদ্দিনের অনুসারি দুলাল আকন্দের বাড়ি থেকে পুলিশ সম্প্রতি চোরাই বৈদ্যুতিক মোটর উদ্ধার করে। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর অভিযুক্তরা গ্রেপ্তার হয়। তারা জামিনে বের হয়ে আসার পর থেকে এনিয়ে উত্তেজনা দেখা দেয়। রোববার রাত ৮টার দিকে আফতাবের নেতৃত্বে তার কয়েকজন অনুসারী বর্তমান ইউপি সদস্য ফরিদ উদ্দিনের অনুসারী আবু মুসাও রুহুল আমিনের দোসাপাড়ার বাড়িতে হামলা চালায়। এ ঘটনার জেরে বামিহাল বাজারে আফতাব ও তার সমর্থকদের ওপর পাল্টা হামলা করে রহুল ও মুসার লোকজন । দুই পক্ষের এই সংঘর্ষের সময় আফতাব, রুহুল আমিনসহ দু’পক্ষের অন্তত ৪ জন আহত হয়। আহতদের সিংড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার পর কর্তব্যরত ডাক্তার আফতাবকে মৃত ঘোষনা করেন। রুহুল আমিন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার ভোর ৪ টার দিকে মারা যায়। গত দেড় যুগে দুই পক্ষের বিরোধের জেরে এই দুটি খুনের ঘটনায় এলাকায় মোট খুনের ১১তম ।
নিহত আফতাবের প্রতিপক্ষ সুকাশ ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি ইউপি সদস্য ফরিদ উদ্দিনের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগকে বানোয়াট দাবি করে বলেন,কোন কারন ছাড়াই তার সমর্থক রুহুল আমিন ও মাসুদ নামে দু’জনকে কুপিয়ে জখম করা হয়েছে। এছাড়া রুহুল ও মুছা নামের তার দু’জন কর্মীর বাড়ি-ঘর ভাংচুর করা হয়েছে।
সিংড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন,ইতিপুর্বে দলীয় শৃংখলা ভঙ্গের দায়ে নিহত আফতাব খন্দকারকে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে বহিস্কার করা হয়। তবে দলের সদস্য হিসেবে তিনি দলের কর্মকান্ডে অংশ নিতেন। এলাকার বিএনপি নেতা কুদ্দুস অনুসারিদের হামলায় আফতাব খন্দকার নিহত হয়েছেন।
সিংড়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জামিল আকতার বলেন, বর্তমানে এলাকার পরিবেশ শান্ত রয়েছে। বামিহাল এলাকাজুড়ে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এই জোড়া খুনের ঘটনায় পৃথক দু’টি মামলা হওয়ার পর উভয় গ্রুপের ৫ সমর্থককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হামলাকারীদের ধরতে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ।