নবীউর রহমান পিপলু ও নাইমুর রহমান, চকবৈদ্যনাথ ঘুরে ॥
বিদেশী ক্রেতারা হাত গুটিয়ে নেয়ায় বাংলাদেশে চমড়ার দাম পড়ে গেছে অস্বাভাবিক হারে। দরপতনের এই আঁচ লেগেছে নাটোরে চামড়া বাজারেও। এতে করে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন নাটোরের চামড়া ব্যবসায়ীরা। অথচ জাতীয় নির্বাচনের আগে এবার কোরবানী ঈদ হওয়ার কারনে পশু কোরবানীর পরিমাণও বেশী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু ট্যানারি মালিকদের কাছে পাওনা টাকা না পাওয়ায় এবার ঈদ মৌসুমে চামড়া কেনা নিয়ে শংকায় পড়েছেন তারা। এত করে এবার চামড়া ব্যবসায় নজিরবিহীন ধ্বসের আশংকা করছেন স্থানীয় চামড়া ব্যবসায়ীরা।
নাটোর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চামড়ার মোকাম হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে ‘ব্রান্ডিং’ করার একমাত্র শিল্প হলো চামড়া। কোরবানী ঈদ চামড়া ব্যবসার ‘উপযুক্ত মৌসুম’ হওয়ার কারণে দেশের এই দ্বিতীয় বৃহত্তম চামড়ার মোকাম নাটোরের চকবৈদ্যনাথ ও তৎসংশি¬ষ্ট এলাকাগুলো এখন থাকার কথা কেনাবেচার মৌসুম উপলক্ষ্যে নানামুখী প্রস্ততি। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বাংলাদেশ থেকে চামড়া কেনা বন্ধ করায় হঠাৎ করে কমে যায় চামড়ার দাম। ফলে অর্থ সংকটের কারণে এখনও প্রস্তত নয় এই দ্বিতীয় বৃহত্তম চামড়ার বাজার। ধারণা করা হচ্ছে জাতীয় নির্বাচনের আগে কোরবানী ঈদ হওয়ায় পশু কোরবানীর পরিণাম এবার বেড়ে যাবে। অধিক পশু কোরবানীর বিপরীতে কাঁচা চামড়া সংগ্রহও বেড়ে যাবে। অতিরিক্ত এসব চামড়া বিদ্যমান বাজারমূল্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশংকা ব্যবসায়ীদের।
মৌসুম শুরুর আগেই মূল্য হ্রাস নাটোরের চামড়ার বাজারে হঠাৎ করেই কমে গেছে সব ধরনের চামড়ার দাম। গত ঈদ উল ফিতরের পর থেকে দাম কমতে কমতে প্রায় অর্ধেকে নেমে গেছে প্রতিপিস চামড়ার দাম। বর্তমানে একটি গরুর চামড়া বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার টাকায় যা মাসখানেক আগেই বিক্রি হয়েছে দুই হাজার থেকে ২২শ’ টাকায়। অপরদিকে খাসি বা বকরীর চামড়ার বর্তমান মূল্য ৮০ থেকে ৮৫ টাকা যার মূল্য ছিল ১৫০ থেকে ১৭৫ টাকা। অথচ প্রতিপিস খাসি/বকরীর চামড়া আড়ৎদাররাই কিনছেন ৮০ থেকে ৯০ টাকায়।
অনিশ্চিত অর্থপ্রবাহ চামড়া কেনা-বেচায় প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান না হওয়া এ বাজারে নতুন কোন সংকট নয়। পাওনা টাকা আদায়ের উপর নির্ভরশীল মৌসুমী বা প্রাথমিক ও চুড়ান্ত বিক্রেতার সাথে আড়তদারদের সম্পর্ক। হিসেব অনুযায়ী গত কয়েক বছরে ঈদের আগে ট্যানারী মালিকদের কাছে নাটোরের ব্যবসায়ীদের বকেয়া থাকে শতকোটি টাকারও বেশী। ঈদের দু-তিনদিন আগে ট্যানারী মালিকদের থেকে বকেয়া টাকার কিছুটা আদায় হলে নতুন করে চামড়া কেনার সিদ্ধান্ত নেন এখানকার ব্যবসায়ীরা। এভাবে প্রতি ঈদেই ক্রয় করা চামড়া যোগ হয় বিগত দিনের মজুদের সাথে। স্বাভাবিক বিক্রয় প্রবাহের ফলে মূল্যপ্রাপ্তি বিলম্বিত হলেও এর নিশ্চয়তা ছিলো এতোদিন। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বাংলাদেশ থেকে চামড়া কেনা বন্ধ করায় এখন একমাত্র ক্রেতা চীন। সম্প্রতি চীন বর্তমানে বাজারমূল্যের চেয়ে অর্ধেক দামে চামড়া কিনবে বলে না জানালে শুরু হয় নতুন সংকট। এমন সিদ্ধান্তে ঢাকার ট্যানারী মালিকরাই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। তার ওপর ট্যানারী স্থানান্তরজনিত কারণে ট্যানারী মালিকরা নিজেরাও আর্থিক সংকটের সম্মুখীন। ফলে চামড়া বাজারে অর্থনৈতিক গতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ঈদুল আযহার দুই সপ্তাহের কম সময় বাকী থাকালেও চলতি মৌসুমে কি পরিমাণ বকেয়া টাকা আদায় হবে, তা নিয়ে শঙ্কায় স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের মতে, চামড়া সংগ্রহকালীন সময়ে এবার সচেতন না হলে লোকসানের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে।
শ্রমিক সংকট ও চামড়া নষ্টের আশঙ্কা অনিশ্চিত অর্থপ্রবাহের কারণে নাটোর মোকামে চামড়ার প্রাথমিক প্রক্রিয়াকরণ কাজ ছেড়েছে বহু শ্রমিক। তারা অটোরিক্সা চালনা, কৃষিকাজসহ অনান্য দিনমজুরির কাজে নিয়োজিত হয়েছেন। ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, ঈদ মৌসুম শুরুর আগে প্রতিবছর তারা নিজেদের ঘরে কাজের জন্য শ্রমিকদের অগ্রীম টাকা দিতেন। তবে ব্যবসায়ীরা এবার কাজের জন্য শ্রমিক খুঁজে পাচ্ছেন না । যারা বর্তমানে কাজে নিয়োজিত আছেন, তারাও ঈদের পর কাজের জন্য বাড়তি টাকা দাবী করছেন। মৌসুমে প্রতি রাতে এক জন শ্রমিককে চামড়ায় লবন লাগানোর জন্য ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা দিতে হতো। এবার তা বাড়তে পারে। তবে সময়মত শ্রমিক পাওয়া না গেলে চামড়া সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে না। এতে করে কাঁচা চামড়া পঁচেও যেতে পারে।
পরিচলন ব্যয় বৃদ্ধি চামড়া ব্যবসার এমন দৈনদশার পরও ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’- হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যবসায় পরিচালনার আনুষাঙ্গিক ব্যয় বৃদ্ধি। ট্যাক্স, ট্রেড লাইসেন্স, কৃষিপণ্য লাইসেন্স, সমিতির চাঁদাসহ বেশ কিছু স্থায়ী পরিচলন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, চকবৈদনাথ মোকামটি রেলের জায়াগায় স্থাপিত হওয়ায় রেলকে খাজনা দিতে হয়। দোকানভেদে প্রতি বর্গফুট জায়গার জন্য খাজনার পরিমাণ ৮ টাকা হলেও চারগুণ বেড়ে তা হয়েছে ৩২ টাকা। সাথে রয়েছে ২০% ভ্যাট। এতে একেক জন ব্যবসায়ীর বছরে প্রায় লাখ টাকা খরচ হচ্ছে। বর্ধিত খাজনার কারণে বিপাকে তারা। ব্যবসায় ভালো হলে এমন বর্ধিত খাজনার যৌক্তিক হতো। কিন্ত ক্রমাগত মন্দাভাব বিরাজ করায় অস্বস্তিতে রয়েছেন তারা। অপরদিকে, ট্রেড লাইসেন্স ৩০০টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৭৫০ টাকা, কৃষিপণ্য লাইসেন্স ৩০০ টাকা থেকে বেড়ে ৭০০ টাকা এবং সমিতির চাঁদা ৩০০ টাকা থেকে বেড়ে ১ হাজার টাকা করার কারণে বাড়তি টাকা গুণতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।
সংগ্রহমূল্য ও নির্ধারিত দামের ব্যবধান ঈদের সপ্তাহখানেক আগে শিল্প মন্ত্রণালয়ের বেঁধে দেয়া দামে চামড়া কেনা সম্ভব নয় বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের। ব্যবসা চালু রাখার জন্য বাড়তি অথবা নির্ধারিত দামে কিনলেও খাসি/বকরীর চামড়ায় কোন লাভ থাকে না। বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী প্রতিটি খাসির চামড়া ৪০ টাকা করে কিনলে লবন দ্বারা সংরক্ষণের পর শ্রমিক ও লবন বাবদ খরচ হয় আরো ২০ টাকা। ব্যবসায়ীদের দাবী, প্রতিপিস বিক্রি করতে গেলে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা পাওয়া যায়। এতে লাভের মুখ দেখা যাচ্ছে না।
ব্যবসায়ীদের বক্তব্য ঈদের আগে চকবৈদ্যনাথ চামড়া মোকামের প্রতিটি ব্যবসায়ীর বক্তব্য প্রায় একই তারা বকেয়া টাকা আদায় নিয়েই চিন্তিত ।
স¤্রাাট এন্টারপ্রাইজের সত্বাধিকারী নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বিগত ৩ থেকে ৪ বছর আগের বকেয়া টাকা এখনো পুরোপুরি পাইনি। চামড়ার বাজারও মন্দা। চামড়া কিনতে আমদানীকারকদের অনীহার জন্য বকেয়া টাকা পাচ্ছি না আমরা। টাকা প্রাপ্তি সাপেক্ষে আসন্ন কোরবানী ঈদে চামড়া কিনতে সিদ্ধান্ত নেবো।’
নাহিদ এন্টারপ্রাইজের সত্বাধিকারী নুরুল ইসলাম নুরু বলেন, ‘লবনসহ চামড়া সংরক্ষণের ব্যয় বেড়ে গেছে। পেমেন্ট না থাকায় এখন পর্যন্ত নতুন চামড়া কেনার টাকা নেই। ব্যয়ের সাথে পেমেন্টের সামঞ্জস্য না থাকলে এবারও লোকসান গুণতে হতে পারে।’
আলতাব ট্রেডার্সের সত্বাধিকারী আলতাব হোসেন বলেন, ‘গত চার দশকে চামড়া ব্যবসায়ে এমন দৈন্যদশা দেখিনি যেমনটা এবার দেখছি। সংরক্ষিত চামড়া ট্যানাররা বিক্রি করতে না পারায় এখনও পেমেন্ট পাইনি। নতুন করে চামড়া কিনবো কি না তা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি।’
চামড়া ব্যবসায়ী রইস খান বলেন, ‘চামড়া কেনা পুরোপুরি নির্ভর করছে বকেয়া টাকা প্রাপ্তির উপর। যে হারে খরচ বেড়ে গেছে, তাতে কতো টাকা বকেয়া আদায় হবে, তার উপর ভিত্তি করেই এবার চামড়া কিনবো।’
চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির বক্তব্য চামড়া ব্যবসায়ীদের বক্তব্যকে সমর্থন জানিয়েছে ব্যবসায়ী সমিতি। তাদেরও বক্তব্য, পাওনা টাকা আদায়ের ওপর নির্ভরশীল এখানকার ব্যবসায়ীরা। ঢাকার ট্যানারি মালিকরা টাকা দিলেই নাটোর মোকামে কেনা-বেচার প্রস্ততি নেয়া হবে বলে জানান সমিতি নেতৃবৃন্দ।
সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হালিম সিদ্দীকি বলেন, ‘আসন্ন ঈদ উপলক্ষে মোকামগুলো সংস্কার ছাড়া ব্যবসায়ীদের আর কোন প্রস্ততি নেই। বকেয়া আদায় পর্যন্ত এমনটাই সর্বশেষ প্রস্ততি। ট্যানাররা টাকা দিলেই তবে কেনা-বেচার প্রস্ততি নেয়া হবে।
নাটোর চামড়া ব্যবসায়ী মালিক গ্রুপের উপদেষ্টা সায়দার খান বলেন, ‘চলতি বছর নাটোরে উদ্বৃত্ত পরিমাণ পশু থাকায় কোরবানীও বেশি হবে। একদিকে চামড়া আমদানীতে ধ্বস, তার ওপর বকেয়া পরিশোধ না হওয়ায় আর্থিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এমন অবস্থায় বুঝেশুনে চলতি বছর চামড়া ক্রয় করতে হবে।’
পাওনা টাকা আদায়ের ওপর নির্ভরশীল এখানকার ব্যবসায়ীরা। ঢাকার ট্যানারি মালিকরা টাকা দিলেই নাটোর মোকামে কেনা-বেচার প্রস্ততি নেয়া হবে বলে জানান তারা।