নাটোর অফিস ॥
চলনবিলের উন্মুক্ত জলাশয় এখন ক্ষমতাসীন দলের নেতা কর্মীদের দখলে। বিলের পানি নামার সাথে সাথে এসব উন্মুক্ত জলাশয় দখলে নিতে বানার বাঁধ ও নেট জাল দিয়ে ঘিরে মাছ শিকার করা হচ্ছে। দলের কেউ কেউ এসব জলাশয় মসজিদের নামে ইজারা নিয়েছেন। আর এসব মুক্ত জলাশয়ে মাছ ধরতে পারছেন না প্রকৃত মৎস্যজীবীরা। ফলে উপার্জনের পথ হারিয়ে তাদের মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, চলনবিলের পানি নামার সাথে সাথে সিংড়া,নলডাঙ্গা,গুরুদাসপুর ও তাড়াশ সহ চলনবিল অধ্যুষিত বিভিন্ন উপজেলার প্রভাবশালীরা উন্মুক্ত এসব জলাশয় বানার বাঁধ ও নেটজাল দিয়ে ঘিরে দকলে নিয়েছে। ইতিমধ্যে নাটোরের সিংড়া উপজেলার সাতপুকুরিয়া, শেরকোল-রাণীনগর, দমদমা ও জোলার বাতাসহ চলনবিল অধ্যুষিত এলাকার কয়েক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে রাজনৈতিক সমর্থনপুষ্ঠ প্রভাবশালীরা নেট জাল ও বানা দিয়ে ঘিরে মাছ শিকার করা শুরু করেছে। উন্মুক্ত জলাশয় নেট জাল দিয়ে ঘিরে মাছ শিকারের কারনে জলজ প্রাণি কাঁকড়া ও শামুকও নিধন করা হচ্ছে। এতে করে চলনবিলের জীববৈচিত্র নষ্ট হচ্ছে।
সিংড়ার সেরকোল-রাণীনগর এলাকায় বিলে এসব বানার বাঁধে মাছ শিকারের উপকরন পাতার কাজে কর্মরত খলিলুর রহমান জানান, প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকা স্থানীয় একটি মসজিদের নামে ৭০ হাজার টাকায় ইজারা নিয়েছেন ইউনিয়ন আওয়ামীলীলীগ সভাপতি হযরত আলী ও তার ছেলে রানা। তাদের নির্দেশে এই এলাকায় বানার বাঁধ ও নেট জাল দিয়ে ঘিরে মাছ শিকার করা হচ্ছে। এই উন্মুক্ত জলাশয়ে (বিলে) এখন অন্য কাউকে মাছ ধরতে দেয়া হয়না।
তবে হযরত আলী বলেন, বিল ইজারা নেয়ার বিষয়টি ঠিক নয়। তবে এলাকার রাণীনগর ভাটোপাড়া মসজিদের উন্নয়নের জন্য কুড়ি হাজার টাকা দেয়া দিয়েছেন তিনি। আরও কিছু টাকা দেয়ার কথা রয়েছে। এলাকার মৎস্যজীবি সহ প্রায় ১৫ জন এই মাছ শিকার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন।
মৎস্যজীবিদের সাথে নিয়ে মাছ শিকারের দাবী সঠিক নয় বলে জানান এলাকার বাসিন্দা দেবেন্দ্রনাথ। তিনি বলেন আগে এই বিলে মৎস্যজীবি সহ এলাকার শত শত মানুষ মাছ শিকার করে নির্বাহ করতো। কিন্তু বিল ইজারা দেয়ায় মৎস্যজীবিরা বিপাকে পড়েছেন। এভাবে উন্মুক্ত জলাশয় দখলে নেয়ায় অনেকেই তাদের কর্ম হারিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।
হারান নামে এক মৎস্যজীবি জানান, তিনি মাছ শিকার করে যা আয় হতো তা দিয়েই সংসার চালাতেন। অন্য কোন কাজও ঠিকমত করতে পারেনা। মুক্ত জলাশয়েও এখন মাছ ধরতে পারছেননা। ফলে পরিবার পরিজন নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে।
শেরকোল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক লুৎফুল হাবিব রুবেল সাংবাদিকদের বলেন, তার ইউনিয়নের শেরকোল-রাণীনগর বিলে নেট ও বাঁনা দিয়ে মাছ শিকারের বিষয়টি তিনি শুনেছেন। তবে তার কোন লোকজন সেখানে জড়িত নন বলে জানান তিনি।
অপরদিকে সিংড়া উপজেলার ডাহিয়া.সাতপুকুরিয়া ও জোলার বাতা এলাকাতেও মসজিদের নামে উন্মুক্ত জলাশয়ে বানার বাঁধ দিয়ে মাছ শিকার করছে স্থানীয় আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা। এসব উন্মুক্ত জলাশয়ের কয়েক কিলোমিটার জুড়ে বানার বাঁধ ও নিষিদ্ধ নেট জাল দিয়ে মাছ শিকার করছেন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশীলী নেতা কর্মীরা। এতে করে চলনবিলের স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।
উপজেলা আওয়ামীলীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক আইসিটি প্রতিমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী মওলানা রুহুল আমিন বলেন, প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের নির্দেশে এসব বানা ও নেট জাল অপসারন শুরু করেছে উপজেলা প্রশাসন ও মৎস্য বিভাগ। গতরাতে (মঙ্গলবার) ডাহিলা এলাকা সহ কয়েকটি এলাকার এসব বানার বাঁধ ও নেট অপসারন করা হয়েছে। ২/১ দিনের মধ্যে সবগুলি অপসারন করা হবে বলে তিনি জানান।
চলনবিল পরিবেশ উন্নয়ন ও প্রকৃতি সংরক্ষন ফোরামের সভাপতি রাজু আহমেদ এবং চলনবিলের জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির সাধারন সম্পাদক সাইফুল ইসলাম জানান, স্থানীয় একশ্রেণীর প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক ব্যক্তি অবৈধভাবে চলনবিলের উন্মুক্ত জলাশয় দখলে নিয়ে বানার বাঁধ ও নেটজাল দিয়ে পোণা সহ মা মাছ শিকার করছে। এতে করে এক দিকে মাছের প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট হচ্ছে ,অপরদিকে চলনবিলের স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হয়ে ফসল আবাদের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। এছাড়া বানার বাঁধ ও নেটজাল দেওয়ায় মাছ, কাঁকড়া, শামুকসহ ছোট পোকামাকড় বিলুপ্ত হচ্ছে। এসব দ্রুত অপসারনের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে অনুরোধ করেছেন তারা। এবিষয়ে প্রশাসনসহ পরিবেশ কর্মীরা বিভিন্ন দিক থেকে এলাকাবাসীকে সচেতন করার চেষ্টা করছেন।
উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা ওয়ালী উল্লাহ মোল্লা সাংবাদিকদের বলেন, প্রতিনিয়তই অভিযান পরিচালনা করে বিলের অবৈধ সোঁতিজাল ও বানার বাঁধ অপসারণ করা হচ্ছে। এরপরও কিছু এলাকায় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নামে বিল ইজারা নিয়ে বাঁধ দেয়া হয়েছে। সেগুলোর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সিংড়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রকিবুল হাসান বলেন, উন্মুক্ত জলাশয় বা বিল দখল করে কেউ মাছ শিকার করতে পারবে না। যদি করে থাকে দ্রুত তা উন্মুক্ত করা হবে। এসব অপসারনে অব্যাহভাবে অভিযান চালানো হচ্ছে।