মামুন, নাটোর
করোনাকালীন সময়ে নাটোর জেলার সর্বত্রই বেড়েছে ডাবের কদর। ডাবে পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম ও ফসফরাস জাতীয় পুষ্টি গুণ থাকায় পাশাপাশি চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ডাবের দামও অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাজারে স্থানভেদে একেকটি ডাব সর্বনিম্ন ৫০ টাকা ও সর্বোচ্চ ৮০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে।
কৃষি সংশ্লিষ্ট বলছেন, প্রতিদিন অন্তত দশ হাজার পিস ডাব বিক্রি হয় নাটোরে। যার আনুমানিক মূল্য ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এ হিসেবে বছরে এখানকার উৎপাদিত প্রায় ১০ কোটি টাকার ডাব নিজ জেলার চাহিদা মিটিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে । আর এই ডাব বিক্রি করে অন্তত শতাধিক মানুষ তাদের জীবন-জীবিকা চালাচ্ছেন অনায়াসে। ডাব বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন, কৃষক, ভ্যান চালক, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা। তাদের মতে ডাব এখন দেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখছে। এ বিবেচনায় ডাবের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারলে কৃষি অর্থনীতিতে একটি বড় পরিবর্তন আসবে।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছেন, এবার জেলায় ডাবের বাম্পার ফলন হয়েছে। তাই নিজ জেলার চাহিদা মিটিয়ে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে যাচ্ছে গড়ে অন্তত ১০ থেকে ১২ হাজার পিস ডাব। বিশেষ করে জেলার বাইরে রাজশাহী, নওগাঁ, বগুড়া, চাঁপাই নবাবগঞ্জ, সান্তাহার, দুপচাঁচিয়া, দিনাজপুর, রংপুর, সৈয়দপুর, ঠাকুরগাঁও এমনকি রাজধানী শহর ঢাকার ব্যাপারীরাও নাটোর থেকে ডাব কিনে নিয়ে যান। এছাড়া জেলার বিভিন্ন উপজেলার প্রায় সব হাট বাজার ও শহরের ওলি গলিতে ভ্যান গাড়িতে করে কেনা বেচা হচ্ছে এসব ডাব। শহরের বিভিন্ন সড়কের পাশে চোখ মেললে দেখা যাবে ছেলে বুড়ো সকলেই পান করছেন কচি কচি ডাব। ভ্যাপসা গরমে প্রাণ জুড়াচ্ছে এই ডাবের পানি। অনেক ব্যবসায়ীরা দোকানে বসেই পানির পরিবর্তে ডাবের পানি পান করছেন।
আবার অনেকে ডাক্তারের পরামর্শে রোগীর পথ্য হিসেবেও কিনে নিয়ে যাচ্ছেন ডাব। ডাব বিক্রেতারা ভ্যান গাড়িতে করে ঘুরে ঘুরে কিংবা শহরের বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে এবং রেলস্টেশন ও বাসস্ট্যান্ডে ডাব বিক্রি করছেন ক্রেতাদের মাঝে। তবে ডাবের মূল্য অনেক বেশি হলেও করোনাকালীন সময়ে বাস যাত্রী, ট্রেনযাত্রী সহ পথচারীরা কোমল পানীয়র পরিবর্তে পান করছেন ডাবের পানি । শহরের মাদ্রাসা মোড় এলাকার ডাব বিক্রেতা রফিকুল ইসলাম ও সাজেদুল ইসলাম জানান, তারা গড়ে প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ ‘শ পিস পরিমান ডাব বিক্রি করে থাকেন। আগের চেয়ে মানুষের মধ্যে ডাব খাওয়ার প্রবণতা অনেক বেড়েছে। প্রতিদিন তারা বিভিন্ন গ্রাম অঞ্চল অথবা স্থানীয় মোকাম থেকে পাইকারি দরে ডাব কিনেন এবং খুচরা মূল্যে তারা বিক্রি করেন। প্রতিটি ডাবে ৫ থেকে ১০ টাকা করে লাভ হয়। এতে স্বাচ্ছন্দে তাদের সংসার চলে ।
নাটোর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় সদর উপজেলার হারিগাছা গ্রামের ডাব বিক্রেতা মোঃ আব্দুস সামাদ জানান, আগের চেয়ে মানুষের মধ্যে ডাব খাওয়ার প্রবণতা অনেক বেড়েছে। তাই ডাব বিক্রির হার বেড়েছে এবং বিক্রেতার সংখ্যা অনেকগুন বেড়েছে। ফলে ডাব বিক্রি করে অনেকের সংসার ভালোই চলছে। তার মতে, অনেক স্থানে ব্যাপকভাবে বিক্রি হচ্ছে ডাব। পাশাপাশি ট্রেন যোগে উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলে বিপুল পরিমাণ ডাব ব্যাপারীরা এসে নিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিদিন তার ডাব বিক্রি করে গড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা করে আয় হয়। গত ১৫ বছর ধরে তিনি ডাব বিক্রি করেই সংসার চালাচ্ছেন এবং ছেলে মেয়েদের মানুষ করছেন।
নাটোর আড়তে ডাব বিক্রি করতে আসা সাগর হোসেন নামে একজন জানান, গত ২০ বছর ধরে তিনি এই ডাবের ব্যবসা করে আসছেন। তার মতে, আগে যারা ডাবের পানি খেত না মহামারি করোণা আসার পর তারা নিয়মিত ডাবের পানি পান করছেন। এজন্য ডাব বিক্রির হার বেড়েছে ।
বাগাতিপাড়া উপজেলার কামার পাড়া গ্রামের আফজাল হোসেন জানান, তিনি প্রতিদিন গ্রামে গ্রামে ঘুরে ডাব সংগ্রহ করে নাটোর আড়তে ১৫০ থেকে ১৬০ পিস করে ডাব এনে পাইকারী বিক্রি করেন। তার মতো অন্তত অর্ধশতাধিক ব্যক্তি প্রতিদিন বিভিন্ন গ্রাম থেকে ডাব এনে আড়তে বিক্রি করেন। যা লাভ হয় তাই দিয়ে স্বাচ্ছন্দে চলে তাদের সংসার। একই এলাকার ভ্যান চালক তসলিম উদ্দিন জানান, প্রতিদিন তার নিজ এলাকা থেকে ডাব বহন করেই ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা করে আয় হয়। এছাড়া অন্যান্য ভাড়া খেটে তার আরও আয় হয়। শহরের নিচে বাজার এলাকায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ডাব ক্রেতা সানজিদা পারভীন জানান, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হাসপাতালে চিকিৎসারত বাবার জন্য ডাব কিনতে এসেছেন। ৬০ টাকা পিস দরে ৫ টি ডাব কিনেছেন। তবে ডাবের দাম তুলনা মুলক একটু বেশী বলে তিনি দাবী করেন।
দিঘাপতিয়া এম কে কলেজের প্রভাষক মাহবুর রহমান জানান, করোনাকালীন সময়ে ডাব অনেক উপকারী বলে জেনেছেন। তাই প্রতিদিন তিনি একটি করে ডাব খান। শহরের প্রতিটি ডাব ৫০ থেকে ৬০ টাকা দরে বিক্রি হলেও গ্রামাঞ্চলে একই ডাব ৩৫ টাকা থেকে ৪০ টাকা পিস বিক্রি হচ্ছে। ডাবের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিক্রেতারাও সুযোগ পেয়ে ডাবের দাম বেশি নিচ্ছেন। বিষয়টি প্রশাসন দ্বারা মনিটরিং করা জরুরি । একই কথা জানালেন আরো অনেকে। শহরের মেডিপ্যাথ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক ডাঃ বারি জানান, করোনাকালীন সময়ে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় বাইরে কোথাও পানি পান করার চেয়ে একটি ডাব খাওয়া অনেক নিরাপদ। তাছাড়া ডাবের পানিতে পটাশিয়াম থাকায় এই করোনাকালীন সময়ে রোগবালাই থেকে অনেকটা মুক্ত থাকা সম্ভব। একই কথা জানালেন শহরের স্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ী।
এদিকে দিন দিন ডাবের উৎপাদন বৃদ্ধি ও ভাল বেচা কেনাকে কেন্দ্র করে নাটোর শহরের হরিশপুর বাইপাস ও ভবানীগঞ্জ মোড়ে গড়ে উঠেছে ডাবের আড়ৎ । সকাল হলেই জেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে ডাব নিয়ে আসেন এসব আড়তে। এছাড়া মান ভাল ও পানি সুপেয় হওয়ায় সুখ্যাতি আছে নাটোরের ডাবের। মোকামের আড়ৎদাররা বলছেন, রাজশাহী, নওগাঁ, বগুড়া, চাঁপাই নবাবগঞ্জ এমনকি ঢাকার ব্যাপারীরাও নাটোর থেকে ডাব কিনে নিয়ে যান।
নাটোর শহরের ভবানীগঞ্জ মোড়ের ডাবের আড়ৎদার ও জান্নাত ফল ঘরের স্বত্বাধিকারী মোঃ আব্দুল জলিল জানান, তার আড়তে প্রতিদিন গড়ে ৫/৬ হাজার পিস ডাব পাইকারি বিক্রি হয়। প্রতি ১০০ টি পিস ডাব সর্ব নিম্ন ২ হাজার ৫০০ টাকা ও সর্বোচ্চ ৩ হাজার দরে বিক্রি হয়। প্রতিদিন গড়ে ১২ থেকে ১৫ জন বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা পাইকারি ক্রেতারা তার আড়ত থেকে ডাব কিনে নিয়ে যান। একই কথা জানালেন হরিশপুর বাইপাস এলাকার ডাবের আড়তদার মোঃ রুহুল আমিন।
ডাবের পাইকারি ক্রেতা জয়পুরহাটের আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, নাটোর এলাকার ডাবের কদর তার এলাকায় অনেক বেশি। কারণ এখানকার ডাবের পানি অনেক বেশি হয় এবং সুমিষ্ঠ। তাই নাটোর থেকে প্রতিদিন ডাব কিনে নিয়ে তার এলাকায় বেশি দামে বিক্রি করেন। ডাবের গুনাগুন সম্পর্কে নাটোরের সিভিল সার্জন ডাঃ কাজী মিজানুর রহমান জানান, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম এবং ফসফরাস মানুষের শরীরের জন্য খুবই প্রয়োজন। যা বর্তমান পরিস্থিতিতে করোনাকালীন সময়ে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে । আর ডাবে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম এবং ফসফরাস আছে যা শরীরের জন্য খুবই প্রয়োজন। বাজারের কোমল পানীয় পান না করে প্রতিদিন ১টা করে ডাব পান করা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। কেননা কোমল পানীয়র চেয়ে ডাবের পুষ্টিগুণ অনেক বেশী। বর্তমান পরিস্থিতিতে করোনাকালীন সময়ে ডাবের পানি অনেক উপকারী। ডাবের পানি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ( ডিডি) সুব্রত কুমার সরকার জানান, জেলায় ২২৫ হেক্টর জমিতে ডাব গাছ আছে। এরমধ্যে সদর উপজেলায় ৭২ হেক্টর, নলডাঙ্গায় ১৫ হেক্টর, সিংড়ায় ৫৭ হেক্টর, গুরুদাসপুরে ৩৫ হেক্টর, বড়াইগ্রামে ১০ হেক্টর, লালপুরে ৩০ হেক্টর ও বাগাতিপাড়ায় ৬ হেক্টর জমিতে ডাবের আবাদ হয়েছে। যেখান থেকে ২ হাজার ৪১৫ মেট্রিক টন ডাব উৎপাদন হবে। গত বছর ২১২ হেক্টর জমিতে ডাবের আবাদ হয়েছিল। আর ডাব উৎপাদন হয়েছিল ২ হাজার ২২৬ মেট্রিক টন। তিনি বলেন, ডাবের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় ডাব গাছ উৎপাদনের পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আরও বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে। ইতোমধ্যে গত বছরের তুলনায় ১৮৯ হেক্টর জমিতে ডাবের চাষাবাদ বেড়েছে। এবছর জেলায় ৪৭৫ টি উন্নত জাতের ও অধিক উৎপাদনশীল ভিয়েতনামি জাতের নারিকেল গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে । আগামী ২/১ বছরের মধ্যে তা উৎপাদনে যাবে । কৃষকরাও নারিকেলের চারা সংগ্রহ করে রোপন করছেন। স্থানীয় নার্সারিগুলোতে নারিকেল গাছের চারা বিক্রি হয়েছে ব্যাপকভাবে। ডিডি সুব্রত কুমার সরকার বলেন, ডাবের উৎপাদন যেমন একদিকে বেড়েছে, অন্যদিকে মানুষের মধ্যে ডাব খাওয়ার প্রবণতাও অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ডাবের মূল্যও বৃদ্ধি পেয়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। তাই বাণিজ্যিকভাবে ডাব উৎপাদন করা গেলে অর্থনৈতিকভাবে মানুষ লাভবান হবেন । আর্থিক বিবেচনার ডাব এখন অর্থনৈতিক ফসল। তাই এই ব্যাপারে কৃষকদেরকে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।