নাটোর অফিস॥ নাটোর শহরের বনবেলঘড়িয়া বাইপাস সংলগ্ন আবাসিক এলাকা। বাইপাস মসজিদের রাস্তা ধরে কিছুদুর গেলেই হাতের বামে একটি পাকা বাড়ি। বাড়ির মালিকের নাম আব্দুল মান্নান।
এই বাড়ির আশেপাশের কয়েকটি বাড়ির মানুষদের দাবী, তারা জানেন এই বাড়িতে সপরিবারে বাস করেন আব্দুল মান্নান।
অথচ রোববার দুপুরে বাড়ির সামনে গোয়েন্দা সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ভোক্তা অধিদপ্তরের কর্তাব্যক্তিদের গাড়ি দেখে যারপরনাই অবাক স্থানীয়রা।
এই বাড়িতেই ইলেকট্রিক তার তৈরীর প্লান্ট স্থাপন করা। আবাসিক এলাকায় তার তৈরীর প্ল্যান্ট যে আসল না, নকল-তা বুঝতে দেরী হয়নি স্থানীয়দের। ভেতরে যেতেই দেখা গেলো বাড়ির নীচের পুরাতন কয়েকটি ঘর ভর্তি নকল ইলেকট্রিক তার। মূল ভবনের নীচতলার একটি বড় কক্ষে স্থাপন করা হয়েছে তার তৈরীর প্ল্যান্ট।
বাড়ির মালিক আব্দুল মান্নান শুধু ২০১৩ সালে মেয়াদোত্তীর্ণ ফায়ার সার্ভিসের একটি লাইসেন্স নিয়েই এসব নকল তার তৈরী করে আসছিলেন। ছিলোনা বিএসটিআই লাইসেন্স, ট্রেড লাইসেন্সসহ অনান্য আনুষাঙ্গিক কাগজ।
এই অপরাধে রোববার দুপুরে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর আব্দুল মান্নানকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে। অভিযানে যৌথভাবে অংশ নেয় জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা(এনএসআই)। অভিযানে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার(এনএসআই) পক্ষে অংশ নেন সহকারী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম।
তবে এই অভিযানে জব্দ করা ১০ লাখ টাকার নকল ইলেকট্রিক তার এক মাসের সময়ে বিভিন্ন শর্তে ‘মুচলেকায়’ ফের কারখানার মালিকের জিম্মায় দিয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
অভিযানে জব্দ মালামাল উৎপাদকের জিম্মায় দেয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ১০ লাখ টাকার নকল তার নানাবিধ শর্তে এক মাসের মুচলেকায় জিম্মায় দেয়ার পর প্রয়োজনীয় শর্ত পালনের হলে ওই তার পুনরায় বিক্রি করবেন কারখানার মালিক, এ নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।
শর্ত পূরণ করেই যদি নকল তার আবার ব্যবহার করা যায় তবে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থেকেই যায়।
সমজাতীয় তার উৎপাদনকারী বৈধ প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য থেকে জানা যায়, স্পর্শকাতর এই তার উৎপাদনের জন্য যেসকল শর্ত মেনে চলতে হয়, তা খুবই জটিল। তার উৎপাদনে পরিবেশ অধিদপ্তর, বিএসটিআই লাইসেন্সসহ আনুষাঙ্গিক অনুমতিপত্র এবং সার্বক্ষণিক মান নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা প্রকৌশলীর তত্বাবধান নিশ্চিত করেই তার উৎপাদন করতে হয়। অথচ আব্দুল মানান কোনো প্রকার বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই নকল ও নিম্নমানের ইলেকট্রিকের তার উৎপাদন ও বাজারজাত করে আসছিলেন।
নকল ইলেকট্রিক তারগুলো মানের দিক থেকে নিম্নমানের হওয়ায় খুব সহজেই ত্রুটি দেখা দিতো। এসব তারের মূল ক্রেতা ছিলেন বিভিন্ন নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদাররা। অফিস আদালতে এই তারের ব্যবহার বেশী ছিলো। খুব দ্রুতই ত্রুটি দেখা দেয়ায় মেরামত ও সংস্থাপনে বারবার ব্যয় করতে হতো এরুপ তার ব্যবহার করা বাসাবাড়ি বা প্রতিষ্ঠানে। এসব ত্রুটিপূর্ণ তার পরবর্তীতে সহজে শর্ট সার্কিটের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক বিপর্যয়সহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটতো।
জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক শামসুল আলম জানান, আব্দুল মান্নানের তার উৎপাদন কার্যকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০১৯ সালের ৫০ ধারার অধীনে দন্ডযোগ্য ভোক্তা অধিকার বিরোধী কার্য, অপরাধ ও ভোক্তা অধিকার বিরোধী দণ্ডযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় এবং জব্দকৃত ১০ লাখ টাকার মালামাল মালিকের নিজ জিম্মায় দিয়ে আগামী এক মাসের মধ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরীর শর্ত দেয়া হয়েছে। যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তারা শর্ত পূরণ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে কারখানাটি সিলগালাপূর্বক নিয়মিত মামলা রুজু করা হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন জানান, দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক ছাত্রছায়ায় থাকা পরিবারটি নকল এই ইলেকট্রিক তারের ব্যবসা বাঁচাতে নানা উপায় অবলম্বন করেছে। তাদের ভয়ে কেউ কথা বলতে চাননা ঠিকই, কিন্ত যখন নকল তার তৈরী করার জন্য মেশিন স্টার্ট দেয়া হতো, তখন সে শব্দ সকলের কানেই যেতো।
তবে অভিযানে অংশ নেয়া এক কর্মকর্তার দাবী, বিপুল পরিমাণ নকল তার জব্দের পর এনে রাখার কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। তাই মুচলেকা নিয়ে কারখানা মালিকের জিম্মায় রাখা হতে পারে।