নাইমুর রহমান॥ ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ, বাজারমূল্য স্থিতিশীল রাখা ও নিরাপত্তা মজুত গড়ে তোলার জন্য সরকারের খাদ্যবিভাগ চলতি বোরো মৌসুমে প্রায় ২০ লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
শুধু চলনবিল অধ্যুষিত নাটোর থেকেই সরকারের এই লক্ষমাত্রা ১১ হাজার ২০৬ মেট্রিক টন। সরকারীভাবে ধান সংগ্রহ শুরুর দুই মাসেরও বেশি সময় অতিবাহিত হলেও জেলায় এখন পর্যন্ত মাত্র ৯৯৩ মেট্রিক টন বোরো ধান সংগ্রহ করতে পেরেছে খাদ্য বিভাগ।
জেলার বড়াইগ্রাম, লালপুর ও বাগাতিপাড়া উপজেলায় লটারী করেও কৃষকদের থেকে ধান নিতে পারেনি খাদ্য বিভাগ। এবার ধানের বাজারমূল্য ভালো হওয়ায় কৃষক সরকারের কাছে ধান বিক্রিতে নিরুৎসাহিত হচ্ছে।
দেশে নিরাপত্তা মজুদ বৃদ্ধির স্বার্থে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেই খাদ্য বিভাগ বা প্রশাসনের। সরকার শেষ পর্যন্ত ধান সংগ্রহের লক্ষমাত্রা অর্জন করতে না পারলে খেসারত দিতে হবে ভোক্তাসাধারণকে।
বিপাকে কৃষি ও খাদ্য বিভাগ
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত বোরো মৌসুমে জেলায় ৫৭ হাজার ৭০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে যেখানে বিগত মৌসুমগুলোর তুলনায় বিঘাপ্রতি ১ মণ করে ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া, বিগত বছরগুলোতে বোরো কর্তনের সময় অতিবর্ষণ ও অকালবন্যায় জমি প্লাবিত হয়ে বিপুল পরিমাণে ধান নষ্ট হলেও এবার জমির সম্পূর্ণ ফসল ধরে তুলতে পেরেছে কৃষকরা।
অপরদিকে, খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, জেলায় এবার বোরোর বাম্পার ফলন হলেও খাদ্য বিভাগ নির্ধারিত ধান সংগ্রহ করতে পারছে না। বাজারে ধানের ভালো দাম পাওয়ায় কৃষক সরকারকে ধান বিক্রি করছে না।
জেলায় ফলন বনাম সরকারী ক্রয়
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় জানিয়েছে, চলতি মৌসুমে নাটোর সদর উপজেলায় ৪৫৯ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহের লক্ষমাত্রা থাকলেও অর্জিত হয়েছে মাত্র ১০২.৯৬০ মেট্রিক টন, নলডাঙ্গায় ১৬০৯ মেট্রিক টনের মধ্যে অর্জিত হয়েছে ৬২৪.৮০ মেট্রিক টন, সর্বোচ্চ বোরো ধান উৎপাদনকারী উপজেলা সিংড়ায় ৭২৪৭ মেট্রিক টনের মধ্যে সংগ্রহ হয়েছে ২১২ মেট্রিক টন ও গুরুদাসপুরে ৯০৭ মেট্রিক টনের মধ্যে সংগ্রহ হয়েছে ৫৪ মেট্রিক টন। বাকী বড়াইগ্রাম, লালপুর ও বাগাতিপাড়ায় এখন পর্যন্ত কৃষকের থেকে ধান পায়নি খাদ্য বিভাগ।
ধান সংগ্রহে ব্যর্থতা
বড়াইগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আনোয়ার পারভেজ, লালপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মুল বানীন দ্যুতি ও বাগাতিপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রিয়াংকা দেবী পাল জানান, তাদের স্ব-স্ব উপজেলায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে বোরো ধান সংগ্রহ অভিযান শুরু করেও কৃষকের সাড়া পাওয়া যায়নি। ধান বাজারে বিক্রিতে কৃষক বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন।
যে কারণে ধান দিচ্ছে না কৃষক
চলনবিল অধ্যুষিত সিংড়ার চৌগ্রাম ইউনিয়নের কৃষক মোতাহার আলী বলেন, “আমরা কয়েক বছর ধরে বন্যার কারণে সম্পূর্ণ ধান পাইনি। এবার পুরো ধান ঘরে তুলতে পেরেছি। বাজারে ধানের মণ দেড় হাজার টাকা বা তার চেয়েও বেশি। তাই এবার ধান বিক্রি করে বিগত বছরের কিছুটা লোকসান তুলতে পেরেছি।”
বড়াইগ্রামের হারোয়া এলাকার কৃষক শ্যামল কুন্ডু বলেন, “গুদামে ধান দিতে গেলে অনেক ঝামেলায় পড়তে হয়। আদ্রাতা না থাকার কথা বলে আমাদের হয়রানি করা হতো। আগে ধান বিক্রি হতো না বলে লটারীর মাধ্যমে বিক্রির চেষ্টা করতাম। এবার বাজারেই নায্য দাম পাওয়া যাচ্ছে।”
সুযোগ নিতে পারে সিন্ডিকেট
বোরো সংগ্রহের সময়সীমা আগস্ট পর্যন্ত নির্ধারিত থাকলেও শেষ পর্যন্ত খাদ্য বিভাগ লক্ষমাত্রা অর্জন করতে পারবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। ভোক্তাদের ধারণা, ধানের ভালো দাম পেয়ে কৃষক উপকৃত হলেও যে মজুদ সরকারের গড়ে তোলার কথা তা গড়ছেন বড় ব্যবসায়ী ও আড়ৎদাররা। যে কোনো পরিস্থিতিতে কৃত্তিম সংকট তৈরী করে চালের দাম বাড়াতে পারেন তারা।
কনজুমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের(ক্যাব) বাগাতিপাড়া শাখার যুগ্ম সম্পাদক আল আফতাব খান বলেন, “সম্প্রতি বাজার চালের দাম বৃদ্দি পেয়েছে। শেষ পর্যন্ত সরকার যদি ধান সংগ্রহের লক্ষমাত্রা পূরণ করতে না পারে তবে সেই সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়াতে পারে। করোনা পরিস্থিতেতে চালের দাম আরো বাড়লে ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
খাদ্যবিভাগ ও প্রশাসনের বক্তব্য
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ওমর ফারুক বলেন, “কৃষক বাজারে ধান বিক্রি করে নায্যমূল্যের চেয়েও অতিরিক্ত মূল্য পাচ্ছে। আমরা এখনো ধান সংগ্রহে পিছিয়ে আছি। তবে আশা করছি নির্ধারিত সময়ের আগে লক্ষমাত্রা পূরণ করতে পারবো।”
জেলা প্রশাসক মোঃ শাহরিয়াজ বলেন,”কৃষকের ধান বাজারে বিক্রির সুযোগে কোনো ব্যবসায়ী বা আড়ৎদার যেনো ধান মজুদ করে চালের কৃত্তিম সংকট সৃষ্টি না করতে পারে, সেদিকে নজর রাখা হয়েছে।”
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তার দাবী
এ ব্যাপারে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম শনিবার দুপুরে জাগোনাটোর২৪.কমের সাথে কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, “নায্যমুল্য দিতেই সরকার সরাসরি কৃষকদের থেকে ধান ক্রয় করে। এবার ধানের ফলন ও দাম দুটোই ভালো। আমরা ইতোমধ্যে বিভাগীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করেছি। তারা চালের দাম না বাড়ানোর আশ্বাস দিয়েছেন। পাশাপাশি জেলা পর্যায়ে বাজার মনিটরিংয়ের জন্য জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আশা করছি কেউ ধানের মজুদ করে চালের দাম বাড়াতে পারবে না।”