গোরস্থান

গোরস্থান
টি এস হিজলী

তৃতীয়বারের চেষ্টায় সফল হলো আদরী। তার এই সাফল্যে সবচেয়ে খুশি হবার কথা তার বিধবা মায়ের। হয়তো হলেনও তিনি। এই মেয়ে এর আগেও তার অনেক খুশির, অনেক আনন্দের উপলক্ষ হয়েছিল। তিন তিনটি মৃত সন্তান প্রসব করার পর এই আদরী তার ঘর আলো করেছিল। ‘তার’ মানে ‘তাদের’ ঘর। তখন আদরীর বাবা চুনু কামার বেঁচে ছিল। কী যে আনন্দ তাদের ঘরে তখন! চুনু কামার আর হুনুফা‌ বেগমের মনে হয়েছিল একটা পৃথিবীর মালিক হয়ে গেছে তারা। সাধ্যে যতটা কুলোয় মিষ্টি বিলালো। মসজিদে শিরনি দিলো দুই বড় গামলা। অনেক দোয়া হলো মেয়ের জন্য। কিন্তু সেই দোয়ার বরকত মনে হয় খুব বেশি দূর ফললো না। আদরীর বয়স যখন ছয়, চুনু কামার একদিন গাঁয়ের হাটে লোহা পেটাতে পেটাতে হঠাৎ জোরে জোরে কাশতে লাগলো এবং কাউকে কিছু বলার সুযোগ না পেয়েই পেছনে উল্টে পড়ে গেল। তার সংসার হয়ে গেল শুধু মা মেয়ের সংসার। সাত বছর চললো সেই সংসার। তারপর একমাত্র মেয়েটাকে কষ্টেসৃষ্টে বিয়ে দিয়েছিল দুই বাড়ি পরের বাড়িরটার ছেলে ভ্যানচালক হাবিলের সঙ্গে। দুটো বাচ্চা এলো সেই সংসারে, কিন্তু সুখ এলো না। অভাবের সঙ্গে কেউ বাড়তি আকাঙ্ক্ষা যুক্ত করে নিলে তাকে জগতের সবচেয়ে অসুখী মানুষ হতে হয়। আদরীর স্বামী সেটাই হলো। আর অসুখী মানুষের সঙ্গে বাস করে সুখী থাকতে পারা অসম্ভব। আদরী পারলো না।

এর আগেও দুইবার বিষ খেয়েছিল আদরী। সফল হয়নি। এই দুইবারের মাঝখানে আবার পাগল হয়ে পাবনায় মানসিক হাসপাতালে ছিল কয়েকমাস। সুস্থ হয়ে ফেরার পর স্বামী তাকে ফেরত নিয়েছে, হতে পারে শুধু বাচ্চা দুটোর জন্য। অবশ্য মনে মনে বেচারি আশা করেছিল আদরী আরও কিছু সময় পাগলা গারদে থাকলে আরেকটা বিয়ে সে করেই ফেলবে।‌ সেটা যখন হলো না এবং বাচ্চা দুটোর জন্য মায়া মমতাও যখন ভাটার মুখে, তখন দ্বিতীয়বার পাগল অভিযুক্ত হলো আদরী। এবার তাকে তার মায়ের বাড়ি পাঠিয়ে দিলো তার স্বামী, সঙ্গে বাচ্চা দুটোকেও। চেয়ে চিন্তে, এ বাড়ি ও বাড়ি কাজ করে এমনিতেই কোনমতে দিন চলে হুনুফা বেগমের, তার উপর আবার বাড়তি তিনটি পেট। আদরীও অবশ্য কম পরিশ্রমী ছিল না। কিন্তু পাগলকে কাজে ডাকবে কে! আসলেই কি সে এখন পাগল! কেমন পাগল আসলে সে! ডাক্তার বলেছিল অতিরিক্ত অপুষ্টির শিকার হবার পরও ঘুমের অনিয়ম হলে মাথায় সমস্যা দেখা দিতে পারে। আদরীর সেটাই হয়েছিল। ১৩ বছর বয়সে বিয়ে, দেড় বছরের মাথায় প্রথম বাচ্চা, মেয়ে। বছর ঘুরতেই আবার দ্বিতীয় কন্যার জন্ম। ছোট ছোট বাচ্চারা একজন ঘুমায় তো আরেকজন জাগে, একজন জাগে তো আরেকজন খাবারের জন্য কান্নাকাটি করে। রাতেও ভালো ঘুম হয় না। আবার সকাল থেকেই কাজের শুরু, এ বাড়ির, ও বাড়ির, স্বামীর বাড়ির! পাটের মৌসুমে শোলা থেকে পাটের আঁশ ছাড়ানোর কাজ, ধানের মৌসুমে এ বাড়ি ও বাড়ি কাজ। সতেরো কি আঠারো বছর বয়সের মধ্যেই‌ প্রাণশক্তি শেষ! মায়ের বাড়ি এসে কিছুদিন থাকলে যেন ফিরে পায় সেই প্রাণশক্তির অনেকটা। মেয়ে আর যেতে চায় না তার স্বামীর বাড়ি, কিন্তু বিধবা মায়েরও তো অতিরিক্ত তিন পেটের বোঝা বহন করার শক্তি থাকতে হবে!

গ্রাম্য সালিশের রায়ে সেবার স্বামীর বাড়ি ফেরার দুই মাসের মধ্যেই এই ঘটনা, তৃতীয়বার বিষ খেয়েছে আদরী, মারাত্মক কীটনাশক। মেয়ে দুটো নানীর কাছে ছিল। কেউ কেউ যদিও কানাকানি করছিল যে রাতে তার স্বামীই বিষ খাইয়ে দিয়েছে কোনোভাবে, নইলে কোনো শোরগোল ছাড়া সকাল বেলা লাশ বের হয়ে আসলো ঘর থেকে!! মা ছুটে এলো কাঁদতে কাঁদতে। এক ঘণ্টার মধ্যে এলো পুলিশের গাড়ি হর্ন বাজাতে বাজাতে।

খেজুর পাতায় বোনা বড় পাটিতে জড়িয়ে লাশটা তোলা হলো ভ্যানে। পাটিটা আদরীর মায়েরই বোনা ছিল, আর ভ্যানটা তার স্বামীর। আত্মহত্যা! অতএব পোস্ট মর্টেম তো করতেই হবে! প্রাণহীন মানুষকে নিয়ে হৃদয়হীন মানুষদের কাটাছেঁড়া করার অনর্থক নিষ্ঠুরতা।

লাশ এলো পরেরদিন। যাদের জীবনটাই একেবারে সস্তা তাদের মৃত লাশ গুরুত্ব পাওয়ার কোনো কারণ থাকে না। লাশ ভ্যানে করে হাবিল বয়ে নিয়ে এলো হুনুফা বেগমের বাড়ির সামনে। বললো, “আমার কাম আমি কইরা দিছি! আমার ঘাড়ে বলে আবার দোষ চাপাইত্যাছে কেডা! আমার যা অওয়ার অইবো! লাশ কনে কব্বর দিবেন দেন গা!” বলেই লাশ রেখে সে চলে গেল সেখান থেকে।
আদরীর লাশ পড়ে আছে হুনুফা বেগমের বাড়ির সামনে। বাড়ি বলতে একটা ঘর। ঘর বলতে কুঁড়েঘরের চেয়ে বেশি কিছু নয়। গন্ধ ছড়ানো শুরু হয়ে গেছে। দ্রুত দাফনের ব্যবস্থা করতে হবে। যাদের বাড়ি বলতে একটা কুঁড়েঘর, যাদের জীবনটাই একটা গোরস্থান, তাদের দাফনের জন্য পারিবারিক গোরস্থান থাকার চিন্তা করা হাস্যকর। হাবিলের বাড়িতেও যে অবস্থা এখানেও তাই। এক খণ্ড জমিও নেই যেখানে কবর দেওয়া যায়। স্বাভাবিক মৃত্যু হলে গ্রামের গোরস্থান পেত। কিন্তু এই গ্রামে কোনো আত্মহত্যা করা মানুষের কবর সেখানে দেওয়া নিষেধ। কবর তো দূরের কথা এরকম লাশের জানাজা পড়ানোও‌ নিষেধ। গ্রামের চার মসজিদের চার ইমামের অন্য অনেক ক্ষেত্রে অনৈক্য থাকলেও, এই সিদ্ধান্তে তারা এক। সর্বনাশ! আত্মহত্যা করা মানুষ! নিশ্চিত জাহান্নামী! তার জন্য এই গোরস্থানে কোনো স্থান নেই। আদরীর মূর্খ মায়ের মাথায় চিন্তা আসে, তাহলে কি যারা আত্মহত্যা না করে মরেছে তারা সবাই বেহেশতে যাবে? গ্রামের গোরস্থানে যাদের কবর দেওয়া হয়েছে তারা সবাই কি বেহেশতের টিকেট কেটে মরেছে? তার মেয়ে যেভাবেই মরুক, তার বিচার করার জন্য তো আল্লা আছে! তার চেনা কত অত্যাচারী, খুনিও তো আছে এই গোরস্থানে! আদরী কি তাদের চেয়েও বেশি পাপী! লাশ রেখে গ্রামের কতজনের কাছে হাতে পায়ে ধরতে গেল সে। কারও দিলে রহম হলো না একটুও। অবশেষে বাড়ির পেছনের এক ছটাক জায়গায় কবর খুড়তে চাইলো সে। বাধা দিল তার দুই দেবর, আদরীর দুই চাচা। তবে তাদের একজন অনুগ্রহ করলেন বেশ, একটা কোদাল দিয়ে। আদরীর মা সেই তার ছোট্ট ঘরের মেঝেতে বসাতে লাগলো সেই কোদালের কোপ। একটা কবরের জন্য প্রয়োজনীয় আয়তন তার ঘরের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *