নবীউর রহমান পিপলু ও নাইমুর রহমান, কদিমচিলান ঘুরে॥
উচ্চ আদালতে আসামীপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে নাটোরের লালপুর উপজেলার কদিমচিলান ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক খাইরুল ইসলাম হত্যাকান্ডের বিচারিক কার্যক্রম স্থগিত হওয়ার পর এবার হত্যা মামলার নথির কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। ২০১৩ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারী জামাত ইসলামীর নায়েবে আমীর দেলোয়ার হোসেন সাইদীর বিরুদ্ধে যুদ্ধপারাধ মামলার রায় ঘোষণার দিন নিজ বাড়িতে খাইরুলকে কুপিয়ে হত্যা করে জামাত শিবিরের বিক্ষুদ্ধ নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় খায়রুলের পরিবারের পক্ষ থেকে দায়ের করা হত্যা মামলা দ্রুত বিচার আইনে বিশেষ ট্রাইবুনালে স্থানান্তর হলেও সাক্ষগ্রহণ চলাকালীন মামলার কার্যক্রমে হঠাৎ স্থগিতাদেশ জারি করে উচ্চ আদালত। বিচারিক কার্যক্রম থেমে যাওয়ার পর এখন মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করতে গিয়ে কোনো নথি খুঁজে পাচ্ছে না ভুক্তভোগী পরিবারটি। তাই এখন বিচার নিয়ে অনিশ্চয়তার শঙ্কা নিহত খাইরুলের পরিবারে।
২০১৩ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারী দেলোয়ার হোসেন সাইদীর যুদ্ধাপরাধ মামলার রায়কে কেন্দ্র করে সারাদেশে তান্ডব চালায় জামাত-শিবির। ওই তান্ডবে সারাদেশে নিহত হন অন্তত ৪২ জন। এদের মধ্যে একজন নাটোরের লালপুর উপজেলার কদিমচিলান ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক খাইরুল ইসলাম। সেদিন রায় ঘোষণার পর জামাত-শিবিরের নেতাকর্মীরা লালপুরের কদিমচিলান বাসস্ট্যান্ড থেকে মিছিল বের করে পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে টহলগাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এসময় জামাত-শিবিরের হামলায় লালপুর থানার উপ-পরিদর্শক আবদুর রউফ, হাবিলদার আবদুল মান্নান, কনস্টেবল সাইদুর রহমানকে পিটিয়ে গুরুতর জখম করে তারা। এরপর জামাত-শিবিরের কর্মীরা পাশ্ববর্তী পুকুরচিলান গ্রামে যুবলীগ নেতা খাইরুলের চাচা সার্জেন্ট মজনুর রহমানের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। বাড়িতে থাকা মজনুর রহমানকে বাইরে বের করে কোপাতে থাকেন জামাত-শিবিরের নেতাকর্মীরা। সেসময় পাশে নিজের বাড়িতে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন খাইরুল। চাচার চিৎকার শুনে ঘর থেকে বের হওয়া মাত্রই খাইরুলকেও উপর্যুপরি কোপাতে থাকেন ইউনিয়ন জামাত নেতা আব্দুল করিম, মতি সরদার ও আবুল কালাম আজাদ। গুরুতর আহত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়লে খাইরুলকে হামলাকারীরা লাঠিসোটা দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। হামলার সময় ভাই শাহীনুর রহমানের সাথে খাইরুলের ছেলে জুবায়ের হোসেন লিখন ও পাশে এক শিক্ষিকার বাড়িতে কন্যা খাদিজাতুল কোবরা পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচান। খাইরুলের স্ত্রী ফাবিয়া বেগম লিপিও লুকিয়ে প্রাণ বাঁচান।
ঘটনার রাতে খাইরুলের ভাই শাহীনুর রহমান বাদী হয়ে ৬২ জনের নাম উল্লেখ করে লালপুর থানায় একটি এজাহার দায়ের করেন। পরবর্তীতে একই বছরের ৬ই মার্চ আরও ৫৪ জনের নাম উল্লেখ করে আরেকটি এজাহার দায়ের করেন খাইরুলের চাচা মজনুর রহমান। পুলিশও বাদী হয়ে জামাত-শিবিরের স্থানীয় ৮৫ নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ২৭৪৭ জনকে আসামী করে দুইটি মামলা দায়ের করে। শাহীনুর রহমানের দায়ের করা এজাহারে আব্দুল করিম, মতি সরদার, আবুল কালাম আজাদ, মিজানুর রহমান, মখলেস সরদার, মহসীন, খলিল, রানা, সানা, আনিসুর, রাজ্জাক, জারজিস, কালাম, আকরামসহ জামাত-শিবিরের ৬২ নেতাকর্মী ও মজনুর রহমানের এজাহারে কদিমচিলান ইউপি জামাতের সভাপতি মোখলেস সরদার, রানা, মকবুল প্রামানিক, বানছার আলী, আব্দুল কুদ্দুস, রুস্তম আলী, সাগর, লুৎফর, হজরত, প্রিন্স, সুইট, মহসীন, করিমসহ সহ আসমী করা হয় জামাত-শিবিরের ৫৪ নেতাকর্মীকে। বিধি অনুযায়ী দুইটি এজাহার একত্রিত করে একটি মামলা গ্রহণের নিয়ম থাকলেও পরবর্তীতে তদন্তকারী কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক আনিসুর রহমান পৃথকভাবে দুইটি এজাহারকে দুইটি মামলায় রুপান্তরিত করেন। পরে ২০১৬ সালের ২৬শে অক্টোবর নিহতের পরিবারের দায়ের করা মামলা দুটি দ্রুত বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইবুনাল রাজশাহীতে স্থানান্তর হয়। তবে পুলিশের দায়ের করা মামলাদুইটি চলতে থাকে নাটোর জেলা ও দায়রা জজ আদালতে। রাজশাহী দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে স্থানান্তর হওয়া মামলা বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়। এই সময়ে জামিনে মুক্তি পান মামলার সকল আসামী। বের হয়েই মামলা প্রত্যাহারে তৎপরতা শুরু করেন তারা। হঠাৎ ২০১৭ সালের ১৮ই জুলাই মামলার আসামী কদিমচিলান ইউনিয়ন জামাত ইসলামীর সভাপতি মোখলেসুর রহমানের আবেদনের প্রেক্ষিতে বিচারপতি মিফতাহ উদ্দীন চৌধুরী ও আ ন ম বশির উদ্দীনের হাইকোর্ট বেঞ্চ মামলার কার্যক্রমে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এই নিষেধাজ্ঞার পরই থেমে যায় মামলার বিচারিক কার্যক্রম।
খাইরুল পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হওয়ায় তার মৃত্যুতে পথে বসার উপক্রম হয় পরিবারের। ওই বছর আগস্ট মাসে খাইরুলের পরিবারকে ১০ লাখ টাকার আর্থিক সহায়তা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই টাকা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে তার মুনাফা দিয়ে চলছে স্ত্রী-সন্তানের ভরণপোষণ ও পড়ালেখার খরচ। খাইরুল ছেলে জুবায়ের হোসেন লিখন ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র এবং কন্যা খাদিজাতুল কোবরা এবার এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে।
খাইরুলের চাচা অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট মজনুর রহমান বলেন, উচ্চ আদালত মামলার ৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ চলাকালে স্থগিতাদেশ দিয়েছে। এখন মামলার আসামীরা জামিনে বাইরে রয়েছে। তারা বিভিন্নভাবে মামলা প্রত্যাহারে চাপ দিচ্ছে। মামলা প্রত্যাহার করলে এক কোটি টাকা দেয়ার প্রস্তাবও দিয়েছে ওরা। স্থগিতাদেশ বাতিল করে পুনরায় বিচার কাজ শুরু করার জন্য মামলার নথি চেয়ে হাইকোর্টের রেজিস্টার ও এটর্নি জেনারেলের দপ্তরে ধর্ণা দিয়েও কোন কাজ হয়নি।
মামলার বাদী ও খাইরুলের ভাই শাহীনুর রহমান বলেন, মাঝপথে বিচারির কার্যক্রম থেমে যাওয়ায় আমরা হতাশ। হত্যাকারীরা অনেক শক্তিশালী। তাদের খুঁটির জোরে মামলার নথিও গায়েব হয়ে গেছে। আমাদের দিন এখন কাটে ভয়ে। মামলার বাদী হওয়ায় দুই বার গুলি করে আমাকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়।
খায়রুলের স্ত্রী ফাবিয়া বেওয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বলে সন্তানদের মানুষ করতে পারছি। স্বামী হত্যার পর সাত বছর হতে চললো। এবার বিচারটা চাই। যে দল করার জন্য আমার স্বামীকে জামাত-শিবির হত্যা করলো, সেই দল ক্ষমতায় থাকার পরও আমরা বিচার পাচ্ছি না।
নাটোর জজকোর্টের পাবলিক প্রসিকিউটর এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম বলেন, খাইরুল হত্যা মামলাটি গুরুত্বের সাথে নিয়ে নাটোর আদালতে বিচারিক কার্যক্রম শুরু করা হয়। সাক্ষীদের সমন পাঠিয়ে যখন মামলাটিতে গতি আনা শুরু হয়, তখন মামলাটি বিশেষ ট্রাইবুনালে স্থানান্তরিত হয়। বর্তমানে মামলার অগ্রগ্রতি জানা বা তরান্বিত করার সুযোগ নেই। তবে প্রত্যাশা করি মামলাটি যেনো খুব দ্রুত শেষ হয় এবং খায়রুলের পরিবার ন্যায়বিচার পায়।
জেলা যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমীন বিপ্লব বলেন, জামাত শিবিরের নৃশংসতার শিকার যুবলীগ নেতা খাইরুল হত্যাকান্ডের বিচার উচ্চ আদালতে স্থগিত হওয়ার ঘটনাটি বেদনাদায়ক। জামাত-শিবিরের অর্থনৈতিক শক্তির কাছে যেনো আইন আত্নসমর্পণ না করে আমরা সেই প্রত্যাশা করছি।
নাটোরের পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা বলেন, পুলিশের দায়ের করা মামলার বিচারিক কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সাক্ষ গ্রহন চলছে। স্পর্শকাতর এ মামলার দীর্ঘসূত্রিতার কারণ খতিয়ে দেখা হবে। পাশাপাশি খাইরুলের পরিবারের খোঁজ নিয়ে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে যা যা করণীয়, সবই করা হবে।