আশিকুর রহমান টুটুল, লালপুর, নাটোর॥
আবাদ মৌসুমভেদে নাটোরের লালপুর উপজেলার বিস্তীর্ণ মাঠগুলোতে কখনও দোল খায় পাট, ধানের পাকা শীষ। ধান, পাটসহ রবি ফসল উৎপাদনে লালপুর উপজেলায় অনুকূল পরিবেশ বিরাজমান। তবে নায্যমূল্য না থাকায় কয়েক বছর ধারাবাহিক লোকসানের কারণে স্থানীয় কৃষকরা ধান-পাটের বদলে তামাক চাষ শুরু করছেন। তামাক চাষ করে এর বিঘাপ্রতি খরচের প্রায় ১৫ গুণ মুনাফা তুলছেন চাষীরা। এতে অন্য কৃষকরাও আগ্রহী হচ্ছেন তামাক চাষে।
উপজেলার চংধুপইল ইউনিয়নের আব্দুলপুর, বড়ময়না, কদিমচিলান, দুরদুড়িয়া ইউনিয়নের গন্ডবিল ও দুয়ারিয়া ইউনিয়নের প্রায় প্রতিটি গ্রামেই রবি মৌসুমে তামাক চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। মারাত্নক স্বাস্থ্য ঝুঁকিসম্পন্ন তামাক চাষ বন্ধে উপজেলা প্রশাসন কিছু পদক্ষেপ নিলেও মাঠ পর্যায়ে তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে তেমন সাড়া মিলছে না। তাছাড়া জনসচেতনতা সৃষ্টি করে তামাক চাষ বন্ধ করা যাচ্ছে না।
চাষীরা বলছেন, তামাক চাষে তাদের উৎসাহের নেপথ্যে সিগারেট কোম্পানীগুলোর চাষ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী বিশেষ প্রণোদনা রয়েছে। যেখানে এক বিঘা জমিতে তামাক চাষে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানী চাষীদের বীজ ও সার ক্রয়ের জন্য নগদ ৪ হাজার টাকা ও উৎপাদিত তামাক নায্যমূল্যে চাষীদের বাড়ি থেকে ক্রয় কারার নিশ্চয়তা দেয় সেখানে খাদ্যশস্য উৎপাদনে প্রণোদনা তো দূরের কথা নায্যমূল্যে নিশ্চিতের ব্যবস্থাও নেই। তবে জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস ও তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণ বিষক্রিয়ার ফলে পরিবেশের উপর বিরুপ প্রভাবসহ নিজেদের শ্বাসকষ্টজনিত অসুখের কথা স্বীকার করেছেন চাষীরা।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, লালপুরে চলতি মৌসুমে (২০২০ সালে) ৪৫ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। এর আগে, ২০১৯ সালে ৪৫ হেক্টর, ২০১৮ সালে ৪৫ হেক্টর এবং ২০১৭ সালে ৩৫ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে।
সম্প্রতি উপজেলার বড়ময়না, আব্দুলপুর, কদিমচিলান, দুয়ারিয়া, দুড়দুরিয়া ও গন্ডবিল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ধান, পেঁয়াজ বা গমের ক্ষেতে পাশাপাশি সারি সারি চাষ হচ্ছে তামাক। আর কয়েক সপ্তাহ পর থেকে তামাক পাতা কাটা ও পোড়ানোর কাজ শুরু হবে। তাই শেষ মুহূর্তের পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষীরা। তামাক পাতা সংগ্রহের পর পোড়ানোর জন্য চাষীদের বাড়িতে চুল্লী তৈরীর কাজও শুরু হয়েছে। সময়মতো তামাক বুঝে নিতে পুরো প্রক্রিয়া তদারকি করছেন চুক্তিবদ্ধ তামাক কোম্পানীর প্রতিনিধিগন।
নিশ্চিত বিক্রয়, বেশী মুনাফা ও ক্রেতা কোম্পানী প্রদত্ত প্রণোদনাকে অগ্রাধিকার দিয়ে লালপুরের চাষীরা তামাক চাষ করছেন। খাদ্যশস্যের সাথে তুলনামূলক বিচারেও তামাক চাষের মুনাফা অনেকগুণ বেশী। এক বিঘা জমিতে ধানের আবাদে খরচ হয় ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। জমি থেকে প্রায় ২৫ মন ধান পাওয়া যায় যার প্রতিকেজি ৮০০ টাকা দরে বর্তমান বাজারমূল্য ২০ হাজার টাকা। অপরদিকে, এক বিঘা জমিতে তামাক উৎপাদনে ব্যয় হয় ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। চুক্তিবদ্ধ কোম্পানী চাষীদের এই উৎপাদন ব্যয়ও আগাম প্রদান করে। একই জমিতে তামাক চাষ করলে বিঘাপ্রতি ৪০০ কেজি তামাক পাতা উৎপাদন সম্ভব যা বর্তমানে প্রতিকেজি ১৫৫ টাকা হিসেবে প্রায় ৬২ হাজার টাকা বাজারমূল্য। এক বিঘা জমিতে ধানের তুলনায় তামাক চাষ করলে ৪০ হাজার টাকা অতিরিক্ত মুনাফা পাওয়া যায়।
আব্দুলপুর গ্রামের তামাক চাষী আব্দুল ওয়াহাব চলতি মৌসুমে তিন বিঘা জমিতে তামাক চাষ করেছেন। তিনি বলেন, ‘তামাক চাষের সব খরচই কোম্পানী দেয়। আমরা শুধু শ্রম দিই। বাড়ি এসে নগদ টাকা দিয়ে তামাক কিনে নেয় কোম্পানি।’
তামাক চাষী বজলু মিয়া বলেন, ‘যখন তামাকের কাঁচা পাতা গুলো গাঁথি তখন গন্ধে খারাপ লাগে। কিন্তু যেহেতু তামাকেই আমাদের জীবিকা, তাই মেনে নিতে হয়।’
চার বিঘা জমিতে তামাক চাষ করছেন চাষী নুরুল ইসলাম। তিনি জানান, উপকরণ, শ্রমসহ নানা খরচ করেও ধানের দাম পাওয়া যায় না। এ অবস্থায় ধান চাষ করা যায় না। কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় ধান চাষের লোকসান কিছুটা হলেও পূরণ সম্ভব তামাক দিয়ে।
জাতীয় কৃষক সমিতি নাটোর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম বলেন, কৃষক তার উৎপাদিত ফসলের নায্যমূল্য প্রত্যাশা করবে-এটিই বাস্তবতা। দেশব্যপী গড়ে উঠা শক্তিশালী সিন্ডিকেট কৃষককে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। রাষ্ট্র যেখানে ফসলের নায্যমূল্য নিশ্চিত করতে পারে না, তখন তামাক চাষ নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা সমীচীন নয়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সুব্রত কুমার বলেন, বিনা পুঁজিতে লাভ বেশি পাওয়ায় কৃষকেরা তামাক চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। তামাক চাষে কৃষি ও কৃষকের ক্ষতি জেনেও নিরুৎসাহিত করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে এ লক্ষ্যে সচেতনতামূলক কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।