নাটোর অফিস॥
প্রায় তিন যুগ আগে হারিয়ে যাওয়া মুন্নী খাতুন ওরফে আছিয়া ফিরে পেয়েছেন তার মা-বাবার পরিবারকে। হারানোর পর বাবা-মায়ের কাছাকাছি এক সহৃদয় ব্যক্তির বাড়িতে আশ্রয় মেলে। কাছে থেকেও দীর্ঘ ৩৩ বছরেও বাবা-মার সন্ধান পায়নি মুন্নি। আশ্রয়দাতা বাবা মুন্নিকে আদর করে ডাকতেন আছিয়া বলে। ক’দিন আগে দেখা মেলে হারিয়ে যাওয়া মা-ভাইদের সাথে। সাত বছর বয়সে নানার হাত ধরে যে গ্রামে বিয়ে খেতে এস মুন্নি হারিয়ে ছিল, ৩৩ বছর পর কাকতালীয়ভাবে সেই গ্রামেই নিকটজনের বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে মা-ও ভাইদের খুজে পায় মুন্নি ওরফে আছিয়া। যা সিনেমার গল্পকেও হার মানায়।
নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার সালাইনগর গ্রামের মৃত মনছের আলী ও নাজমা বেগমের মেয়ে মুন্নী খাতুন ৩৩ বছর আগে হারিয়ে যান। হারানোর সময় মুন্নি খাতুন ছিলেন তার বাবা-মার একমাত্র সন্তান। এখন সেন্টু ও শামীম নামে তার আরও দুই ভাই রয়েছে। বাবা গত হয়েছেন ক’বছর আগে। ১৯৮৬ সালে পাশের লালপুর উপজেলার মিলকি পাড়ায় নানার বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে হারিয়ে যায় মুন্নি।
এই প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় মুন্নি খাতুন ওরফে আছিয়া ও তার স্বামী আমিরুল ইসলাম বলেন, ১৯৮৬ সালে পার্শ্ববর্তী লালপুর উপজেলার আব্দুলপুর মিলকিপাড়া গ্রামে মায়ের সাথে নানার বাড়ি বেড়াতে গিয়ে হারিয়ে যায় ৭ বছরের শিশু মুন্নী। নানার হাত ধরে পাশের গ্রামের এক বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলে মুন্নি। আব্দুলপুর রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রেনে ওঠে পড়েন। ট্রেনে উঠে কান্নাকাটি শুরু করলে অন্য যাত্রিরা বুঝতে পারেন শিশুটি তার পরিবারকে হারিয়েছে। রেল কর্তৃপক্ষ আজিমনগর (সাবেক গোপালপুর) স্টেশনে মুন্নিকে নামিয়ে দেয়। স্টেশনে নেমে মুন্নি কাঁদতে কাঁদতে গোপালপুর স্কুলের বারান্দায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। সেখানে তাকে কাঁদতে দেখে স্থানীয়রা তাকে নিয়ে যান গোপালপুর ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান শাহাবুদ্দিন আহমেদ সাধুর কাছে। তখন থেকেই চেয়ারম্যান বাড়িতে আশ্রয় পান মুন্নি। সেদিন থেকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও শিশু মুন্নির কোন সন্ধান পাননি তার পরিবার।
এদিকে শিশু মুন্নিকে আশ্রয় দেয়ার পর চেয়ারম্যান সাধু তাকে নতুন পরিচয় দেন। মুন্নির নাম বদলে রাখেন আছিয়া। পরে বিবাহযোগ্যা মুন্নিকে প্রতিবেশী বাহার উদ্দিনের ছেলে সোনালী ব্যাংকে কর্মরত আমিরুল ইসলামের সাথে বিয়ে দেন চেয়ারম্যান সাহবুদ্দিন আহম্মেদ সাধু। বিয়ের পর মুন্নির কোলজুড়ে আসে দুই পুত্র সন্তান সাজেদুল ইসলাম সাজু এবং রাজীবুল ইসলাম।
সাধু চেয়ারম্যান বাড়িতে একজন পালিত কন্যা থাকার কথা এলাকার প্রায় সকলেই জানতেন। তাই কন্যাহারা অনেক দম্পতি নিজ সন্তানকে খুঁজতে চেয়ারম্যান বাড়িতে আসতেন। গত সপ্তাহে মুন্নি তার এক প্রতিবেশীর বিয়ের অনুষ্ঠানে সেই মিলকি পাড়া গ্রামে যান। একই সময় ওই বিয়ের অনুষ্ঠানে দুই ছেলেকে নিয়ে আসেন মুন্নির মা নাজমা বেগম। অনুষ্ঠানের অবসরে হারিয়ে যাওয়ার নানা গল্প শুরু হয়। এসময় মুন্নির হারিয়ে যাওয়ার গল্প বলেন নাজমা বেগম। সেই গল্পের রেশ ধরে মা নাজমা বেগম খুজে পান তার হারিয়ে যাওয়া মেয়ে মুন্নিকে। তিনি জানতে পারেন চেয়ারম্যান বাড়িতে একটি মেয়ে পালিত হয়েছে যে প্রায় ৩৩ বছর আগে ওই বাড়িতে আসেন। বিষয়টি জেনে মুন্নির মায়ের হৃদয় ব্যকুল হয়ে ওঠে ওই মেয়েকে দেখার জন্য। ছুটে যান প্রয়াত চেয়ারম্যান সাহবুদ্দিন সাধুর বাড়িতে। মুন্নিকে পর ভালভাবে পরখ করেন। মুন্নির চোখের পাতার নিচে তিল, হাতে পোড়া দাগ দেখে নিজের নাড়ি ছেঁড়া ধনকে চিনতে পারেন মুন্নির মা। সাথে আত্মীয় স্বজনরা সনাক্ত করেন মুন্নিই তাদের হারিয়ে যাওয়া মেয়ে। দীর্ঘ ৩৩ বছর পর মা তার সন্তানকে পেয়ে যেমন খুঁশি, মা-পরিবারকে খুঁজে পেয়ে তেমনি খুঁশি হয়েছেন মুন্নি ও তার পরিবার। দীর্ঘ সময় পর সেদিন চেয়ারম্যান বাড়িতে মা ও মেয়ের সেই মিলনদৃশ্যে অশ্রুসিক্ত চোখে অবলোকন করেছিলেন উপস্থিত সকলে।
মা-মেয়ের দেখা হওয়ার পর দু ভাই সেন্টু ও মামীম শুক্রবার মুন্নি তার স্বামী সন্তানকে নিয়ে আসেন তাদের বাড়িতে। মেয়ে-জামাই-নাতিদের জন্য রীতিমতো উৎসব লেগে গেছে বাড়িতে। হারিয়ে যাওয়া মুন্নিকে দেখতে বাগাতিপাড়ার সালাইনগরের বাড়িতে ভীড় জমিয়েছেন প্রতিবেশীরা। দু ভাই তাদের হারিয়ে যাওয়া বোনকে পেয়ে মহা খুশী।
কান্নাজড়িত কন্ঠে মুন্নী বলেন, দীর্ঘ ৩৩ বছর অনেক বাবা-মা তাদের হারিয়ে যাওয়া সন্তান খুঁজতে আমাকে দেখতে এসেছে। আজ আমার পরিবারকে আমি পেয়ে আনন্দিত, অনেক খুঁশি। একটাই দুঃখ থেকে গেল, আমার বাবা আজ বেঁচে নেই। বাবা আমাকে দেখতে পারলেন না। বাবার মুখটা দেখা হল না।
মুন্নির মা নাজমা বেগম বলেন, মেয়েকে কত যে খুঁজেছি। মাত্র ৩০ কিলোমিটার দুরে ছিল আমার মেয়ে। এতো কাছে থেকেও দেখা হয়নি আমাদের। সন্তানকে পেয়ে অনেক খুঁশি আমি। জামাই-নাতিদের পেয়ে আনন্দে ঘরটা ভরে উঠেছে।
মুন্নির স্বামী আমিরুল ইসলাম বলেন, আমার স্ত্রী তার পরিবারের সন্ধান না পেয়ে অনেক কষ্টে ছিলো। তার অপেক্ষার অবসান হয়েছে। এখন তার চোখে মুখে আনন্দ দেখে আমি অনেক খুশি।
চেয়ারম্যান সাহাবুদ্দিন আহম্মেদ সাধুর ছেলে সাইফুল ইসলাম রানা বলেন, বাবা ১৯৮৫-৮৬ দিকে আমাদের বাড়িতে আনে আছিয়াকে। এক সাথে বড় হয়েছি আমরা সবাই। আছিয়া তার মা-ভাইদের খুজে পাওয়ায় আমাদের খুব ভাল লাগছে। আজ বাবা বেঁেচ থাকলে তিনি বেশী খুশী হতেন।