নাটোর অফিস॥
জীবন নদীর পারাপারে খেঁয়াহাল ভেঙে দিশে হারানো নাবিক নাটোরের নজরুল ইসলাম। প্রয়োজন যে জীবনে কোনো আইন মানে না, সত্যের এমন নির্দয় উপলব্ধি উচ্চ শিক্ষিত এই যুবকের। দেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী একজন যুবক হিসেবে দশজনের মতো সম্মানজনক কাজের মাধ্যমে নিজ ও পরিবারের রুটি-রুজির ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন নজরুল। অথচ, যে হাতে কলম ধরার কথা ছিলো, সেই হাত এখন পরিষ্কারের জন্য তুলে নেয় এঁটো থালা-বাসন!
নাটোর শহরের চকরামপুর এলাকার বিসমিল্লাহ হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট। ভেতরের রান্নাঘরে থালা-বাসন পরিষ্কার ও ধোয়া-মোছার কাজ করেন এম.এ পাস করা নজরুল ইসলাম। নাটোর সদর উপজেলার লক্ষীপুর ইউনিয়নের বড়বড়িয়া গ্রামের দরিদ্র কৃষক জমির উদ্দীনের সন্তান তিনি। আট ভাই এবং ছয় বোনের মধ্যে নজরুল সবার ছোট। বাবা জমির উদ্দীনের মৃত্যুর পর অন্যের জমিতে মজুরের কাজ করেই শেষ করেছেন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর।
২০১৬ সালে নাটোর নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা সরকারি কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে এম.এ পাস করেন নজরুল। বাড়িতে বৃদ্ধা মা আনোয়ারা, বাকপ্রতিবন্ধী স্ত্রী কুইন খাতুন ও চার বছরের পুত্র হিমেল। প্রতিদিন রাত ৯টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত ১২ ঘণ্টা পানিতে থালা-বাসন ধোয়ার কাজ করেন তিনি। প্রতিদিন কাজ করে বেতন পান ৩০০ টাকা। এই টাকায় এখন চলছে নজরুলের সংসার।
স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর থেকে চাকুরীর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন নজরুল। কিছুদিন স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে দুই হাজার টাকা বেতনে শিক্ষকতা করেছেন তিনি। বাড়তি আয়ের জন্য অন্যের জমিতে কাজও করছিলেন। সেই সাথে সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানে আবেদন করেছেন। ব্যাংক ড্রাফট আর পে-অর্ডার করতে গিয়ে জমানো অনেক টাকা খরচ হলেও চাকুরী জোটেনি ভাগ্যে। একদিন পত্রিকায় একটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থার সহকারী পরিচালক পদে চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে আবেদন করেন তিনি। চাকরির শর্ত মোতাবেক ঋণ করে ৬০ হাজার টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠান ওই প্রতিষ্ঠানকে দেন তিনি। পরে বুঝতে পারেন তিনি প্রতারণার শিকার। ঋণের ওই টাকা শোধ করতে তাকে দুটি টিউশনির পাশাপাশি হোটেলে কাজ নিতে হয়েছে। গত তিন মাস ধরে খাবারের হোটেলটিতে থালা-বাসন ধোয়ার কাজ করছেন তিনি।
নজরুল ইসলাম বলেন ‘সংসারের সব ভরণপোষণের দায়িত্ব আমার। তাই শুধু হোটেলে বাসন ধোয়ার কাজই না, সুযোগ পেলে কৃষিজমিতে মজুরের কাজও করি দিনে। হোটেলে বাসন ধোয়ার কাজে একটুও আপত্তি নেই আমার। ইচ্ছা থাকলেও যারা আমাকে সাহায্য করতে পারেন না, তারা আমায় দেখে কষ্ট পান। তাই আমি চেষ্টা করি তাদের সামনে না যেতে। চাকরি না পেলে ক্ষেতমজুর বা হোটেলে কাজ করেই জীবন পার করে দেবো।’
নজরুল স্কুল শিক্ষক আশরাফ আলী বলেন, ‘নজরুল বড়বড়িয়া হাইস্কুল থেকে এসএসসি ও আহম্মেদপুর কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে নাটোর নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা সরকারী কলেজে ভর্তি হয়। সেখান থেকেই এম.এ পাস করে। ছোট থেকেই ছেলেটা মেধাবী। অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা চালিয়েছে। অভাবের মধ্যে থেকে এখনও যেভাবে সংসার চালাচ্ছে, তার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ আরও বেড়ে গেছে।’
স্থানীয় পরিবহন ব্যবসায়ী আব্দুস সাত্তার বলেন, ‘উচ্চ শিক্ষিত যুবক নজরুলকে হোটেলে থালা-বাসন ধোয়ার কাজ করতে দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়। ওর জন্য সম্মানজনক একটি চাকরির ব্যবস্থার চেষ্টায় আছি আমি।’