নাটোর অফিস॥
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মহান মুক্তিযুদ্ধে পাক সেনাদের সহায়তাকরী এদেশীয় প্রধান দোসর রাজাকারদের আংশিক নাম প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রথম দফায় প্রকাশিত ১০ হাজার ৭৮৯ রাজাকারের নামের তালিকার মধ্যে তৎকালীন রাজশাহী বিভাগের নাটোর মহকুমায় ৪৬ জন রাজাকার স্বাধীনতা বিরোধীতা করে পাক বাহিনীকে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করে। এর মধ্যে নাটোর সদরের ৩ জন, গুরুদাসপুর উপজেলার ৩ জন, নলডাঙ্গা উপজেলার ৬ জন এবং সিংড়ার ৩৪ জন রাজাকার রয়েছেন। প্রকাশিত তালিকানুসারে তৎকালীন নাটোর মহকুমার সিংড়া এলাকায় রাজাকারের সংখ্যা সবচেয়ে বেশী।
আজ রোববার(১৫ই ডিসেম্বর) প্রথম দফায় প্রকাশিত তালিকায় জেলার মধ্যে সিংড়া রাজাকারদের নাম বেশি আসার যৌক্তিকতা তুলে ধরেছেন সেসময়ের রণাঙ্গনের যোদ্ধারা।
তৎকালীন নাটোর মহকুমায় মুক্তিযোদ্ধাদের সমান্তরালে রাজাকারদের তৎপরতা সবচেয়ে বেশি ছিলো দূর্গম সিংড়া এলাকায়। বিল ও ঘন বন-জঙ্গল পরিবেষ্টিত সিংড়া ছিলো মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের ডেরা। মূলত সিংড়া থেকেই নাটোরসহ পাশ্ববর্তী এলাকাগুলোতে অপারেশন পরিচালনা করতেন মুক্তিযোদ্ধারা।
সিংড়া উপজেলার ৩৪ জন রাজাকর হলেন- হাতিয়ান্দহ ইউনিয়নের বড়সাঐলের কফিল উদ্দিনের ছেলে আবদুল খালেক, নুরপুরের ইয়াকুব আলীর ছেলে জসীম সরকার, হাটকদমতুলি এলাকার সাবিল উদ্দিনের ছেলে ইসমাইল হোসেন সরদার, কদমতুলি এলাকার ইমান শাহের ছেলে মহসীন আলী, দবীর উদ্দীন সরকারের ছেলে আবদুল কাদের সরকার, মতিউর রহমানের ছেলে মুহাত আলী মাস্টার, সিংড়া উপজেলার দমদমা এলাকার মুন্সী রহিম উদ্দিন ছেলে রেজা মুন্সি, খয়রুদ্দীনের ছেলে এরশাদ, রহমান আলী মোল্লার ছেলে জাবের আলী মোল্লা, খয়ের সরকারের ছেলে নিজাম সরদার, গোপালের ছেলে চন্দন আলী, আলহাজ্ব রমজান আলী সরদারের ছেলে রওশন আলী সরদার, চৌগ্রামের তোসীর উদ্দিনের ছেলে মোজাফর হোসেন, রহমত উল্লাহর ছেলে মুজিবর রহমান, পরান উদ্দিনের ছেলে মফিজ উদ্দিন, বড়সাঐলের নজরুল ইসলাম, বোয়ালিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহাদত হোসাইন, কলমের সাবেক চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী, কলমপুন্ডরি গ্রামের হাজী সায়েমের ছেলে নাসির উদ্দীন, ইয়াসিন প্রামানিকের ছেলে সোলেমান আলী, কানপুর গ্রামের নবীর উদ্দিন, বাজনপাড়া এলাকার লাল মিয়ার ছেলে হাজের আলী, পাকুরিয়া গ্রামের নাসির আলী, রমজান আলীর ছেলে ওসমান আলী ফকির, বাসিরুদ্দিনের ছেলে ময়েজ উদ্দিন, বেগু ফকিরের ছেলে মেছের ফকির, হাঁসপুুকুরিয়া গ্রামের হারান আলীর ছেলে জালাল উদ্দিন, হাট সিংড়ার জলিলের ছেলে আবু বকর ছিদ্দিক, ওমর আলীর ছেলে আব্দুর রাজ্জাক, রমজান খানের ছেলে আব্দুর রাজ্জাক খান, চৌগ্রামের ফজলুর রহমানের ছেলে মাহমুদুল আলম, বানশার গ্রামের আয়েজ প্রামানিকের ছেলে আজিজ প্রামানিক, মধু খানের ছেলে আয়েজ উদ্দিন খান, সাবেক চেয়ারম্যান মাওলা বক্সের ছেলে আজিজুল হক, ভুলবাড়িয়া গ্রামের আজীম উদ্দিন।
এছাড়া নাটোর সদরের ৩ রাজাকার হলেন- জংলি এলাকার সোলেমান মুন্সী,আবুল কাসেম খান চৌধুরির ছেলে আব্দুস সাত্তার খান চৌধুরী মধু মিয়া এবং দিঘাপতিয়া এলাকার পোস্ট মাস্টার হাফিজুর রহমান।
এছাড়া নলডাঙ্গা উপজেলার ৬ রাজাকার হলেন বহ্মপুরের হামেদ আলী মোল্লা, সবুর মোল্লা, মোজাহার আলী , আবেদ আলী মোল্লা এবং সামছুল মোল্লা।
গুরুদাসপুর উপজেলার নাজিরপুরের ডা. আব্দুল মজিদ, হাফেজ পেশোয়ারীর ছেলে শের-ই-মুহাম্মাদ ও পোসশান সরকারের ছেলে কাসেম আলী সরকার।
প্রসঙ্গত, নাটোর ছিল পাক হানাদারদের ২নং সামরিক হেডকোয়ার্টার। নাটোর থেকেই দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের যুদ্ধ পরিচালনা করত পাকিস্তান বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধে নাটোরে বড় ধরনের কোনো লড়াই না হলেও একাধিক স্থানে চালানো হয় গণহত্যা। তবে ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ লালপুর উপজেলার দুর্গম ময়না গ্রামে পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিকামী জনতার সম্মুখযুদ্ধ হয়, যা ছিলো তৎকালীন সময়ে দেশের প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস হানাদার ও তাদের দোসর রাজাকারদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় নাটোর সদর উপজেলার ফুলবাগান, ছাতনী, দত্তপাড়া, মোহনপুর, লালবাজার, কাপুড়িয়াপট্টি, শুকলপট্ট, মল্লিকহাটি, বড়াইগ্রামের বনপাড়া ক্যাথলিক মিশন, গুরুদাসপুরের নাড়িবাড়ি, সিংড়ার হাতিয়ান্দহ, কলম এবং লালপুর উপজেলার গোপালপুরের নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল চত্বরে গণহত্যা চালায়।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলেও নাটোর শহর শত্রুমুক্ত হয় ২১শে ডিসেম্বর ১৯৭১।