৭১এর ডিসেম্বর মাস। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলছে মুক্তিযুদ্ধের চুড়ান্ত লড়াই। আমরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর (মিত্রবাহিনী) সাথে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের ৭ নং সেক্টরের অধীন গঠন করা হয় তুফানি ব্যাটেলিয়ান। দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকার সহস্রাধিক মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এই তুফানি ব্যটেলিয়ান গঠন করা হয়েছিল। সঙ্গে ভারতীয় সেনা বাহিনীর সদস্যরা এক সাথে আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন।
৭১-এর ৬ ডিসেম্বর ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে শুরু হয় সম্মুখ যুদ্ধ। ভারতের পশ্চিম দিনাজপুর জেলার হিলি সীমান্ত থেকে শুরু করে পাঁচবিবি, জয়পুরহাট,রংপুরের গোবিন্দগঞ্জ ও মহাস্থানগড় হয়ে বগুড়া অঞ্চলের যুদ্ধে অংশ নিই আমরা।
মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস মনের স্মৃতিকোঠায় এখনও নাড়া দেয়। মনে পড়ে সেই দিনগুলির কথা। যে কাহিনীগুলো ছিল সত্য এবং হৃদয়ে নাড়া দেয়ার মত। মনে পড়ে সঙ্গি সহযোদ্ধাদের কথা। এছাড়া মুক্তিকামী অসংখ্য মানুষদের মুখও ভেসে ওঠে মনের মনিকোঠায়। এই মানুষগুলোর অনেকেই আমাদের মাঝে থেকে হারিয়ে গেছেন। চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তাদের মৃত্যুতে অনেক না জানা কাহিনী অন্ধকারেই থেকে গেছে। রণাঙ্গনের বাহিরে যারা থেকেছেন তারাও সব সময় বিজয়ের স্বপ্ন দেখেছেন। দোয়া করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। এসব মানুষদের ছিলনা কোন চাওয়া পাওয়া। দেশকে ভালবাসতেন। তাই কেউ পরিবার পরিজনসহ কেউবা জীবন বাঁচাতে একাকি ভারতে গিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিলেও এদের কেউ কেউ খেলাধুলা বা বিভিন্ন কর্মের মাধ্যমে বাংলাদেশের পক্ষে গড়েছেন জনমত। আবার কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহিত করাসহ যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছেন। আবার যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রিয়জনদের সাথে দেখা হওয়ার মত ঘটনাও ছিল শিহরণ জাগানো। এসব মানুষদের মধ্যে ছিলেন আমার বাবা-মা ও বড় বোন । যারা সরাসরি যুদ্ধে অংশ না নিলেও বাংলাদেশের মুক্তির জন্য নানাভাবে সহায়তা করেছেন। মনে পড়ে সদ্য প্রয়াত নাটোরে সরকারী বালক উচচ বিদ্যালয়ের (সাবেক জিন্না মডেল হাই স্কুল) সহকারী শিক্ষক মদন মোহন তালুকদার। যিনি মোহন স্যার নামে সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন। মনে পরে সে সময়ের নাটোরের কৃতি ফুটবলার শহরের মল্লিকহাটি এলাকার শ্রদ্ধেয় আব্দুস সোবাহান ভাইয়ের কথা। এই দু’জন আশ্রয় নিয়েছিলেন পশ্চিম দিনাজপুর জেলার সদর মুহাকুমা বালুরঘাট শহরে। সোবাহান ভাই তার চিরায়িত আচরণে স্থানীয় ফুটবলারদের সাথে গড়ে তুলেছেন সখ্যতা। তাদের সহায়তায় গড়ে তোলেন একটি ফুটবল দল। যে দলের খেলোয়ারদের অধিকাংশ জনই ছিলেন বাংলাদেশী শরণার্থী । স্থানীয় খেলোয়ারও ছিলেন এই দলে। তার এই আগ্রহের প্রতি সম্মান জানিয়ে বালুঘাট ক্রিড়া সংগঠকরা স্থানীয় খেলোয়ারদের জন্য তাকে ফুটবল কোচিং করার সুযোগ করে দেয়। সুনামের সাথে তিনি সেই দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি তিনিও ফুল খেলোয়ার হিসেবে তার দলের (সম্ভবত জয়বাংলা ফুটবল দল) হয়ে খেলতেন। ভারতের বিভিন্ন স্থানে এই দল নিয়ে গিয়ে খেলেছেন। ওই ফুটবল খেলার মাধ্যমে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতেন।
বালুরঘাটের অযোদ্ধা সীমান্ত ক্যাম্পে থাকার সুবাদে একটি দলগতভাবে সিনেমা দেখতে গিয়ে হঠাৎ দেখা হয় সোবাহান ভায়ের সাথে। সেদিন তার আতিথিয়তায় মুগ্ধ হয়ে যাই আমারা সবাই। আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক আবেগের কথা বললেন সেদিন। সে এক অসাধরণ অনুভুতি শিহরণ তুলেছিল শরীর ও মনে। যুদ্ধে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছা ছিল তার। কিন্তু ক্রিড়া পাগল মানুষটির সব কথার মধ্যে ছিল ফুটবল। দেশ স্বাধীন হলে কিভাবে দল গড়বেন। বাংলাদেশের সুনাম বয়ে আনতে প্রশিক্ষণ দিয়ে শক্তিশালী দল গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন সেদিন। তার শিষ্য খেলোয়াররাও আমাদের দেখে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। হাত হাত ও কোলাকুলি করে মুক্তিযোদ্ধাদের সান্নিধ্য লাভের জন্য প্রতিযোগিতা করতে শরু করে তারা। ইতোমধ্যে বেশ ভীড় জমে গিয়েছিল সেখানে। বেশ মজাই পাচ্ছিলাম আমরা এবং নিজেকে গর্বিত মনে হচ্ছিল এমন দৃশ্যের অবতারনা হওয়ায়। ভাবছিলাম ভারতীয়রাও আমাদের ভালবাসে বা আমাদের নিয়ে এতোটা ভাবে। সোবাহান ভাই বললেন, খেলোয়াররা তাকে ছাড়তে চায়না। সম্ভব হলে তিনিও যুদ্ধে যাবেন। অনুরোধ করেছিলেন বালুরঘাট যখনই আসবি দেখা করবি। তার পরে আরও বেশ ক’বার বালুরঘাট গিয়েছি,কিন্তু ব্যস্ততার কারনে তার সাথে সেখানে আর দেখা হয়নি। তবে স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে দেখা হয়েছে। তিনি আক্ষেপ করে বলতেন, দেশের জন্য অনেক কিছু করেও মুক্তিযোদ্ধা হতে পারলাম না। অথচ যুদ্ধ না করে আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে থেকে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে রাষ্ট্রের সুবিধা নিচ্ছে অনেকেই। তিনি সেই ক্ষোভ নিয়েই না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তার মত আরও এজন মানুষ স্বাধীনতার অপেক্ষায় সময় কাটিয়েছেন ৯ মাস। দেখা হলেই তিনি আমাকে বলতেন, কেমন আসিছ, যুদ্ধ শেষ হলে তোর কথা বলব সকলকে। তোকে নিয়ে গর্ব করে বলব আমার সহকর্মীদের কাছে। দেশে ফিরে আমার সম্পর্কে অনেকের কাছেই গল্প করেছেন। বলেছেন, পিপলুর (আমার) ঘাড়ে কখনও স্টেনগান,কখনও এলএমজি দেখেছেন। আমাকে তখনকার সময়ের ভারতীয় সেনা বাহিনীর আদলের পোষাক পড়া অবস্থায় দেখেছেন। গল্প করেছেন, খাইয়েছেন, যুদ্ধের গল্প শুনেছেন আমার কাছে থেকে এমন নানা কথা বলেছেন তার প্রিয় মানুষদের কাছে। এই মানুষটি ছিলেন আমার স্কুল শিক্ষক নাটোর সরকারী বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের (সাবেক জিন্নাহ মডেল হাই স্কুল) সহকারী শিক্ষক মদন মোহন তালুকদার। আমরা পাশাপাশি এলাকায় বসবাস করি। তিনি নিচাবাজার এলাকার এবং আমি তার পাশে আলাইপুর এলাকার বাসিন্দা। তার বাড়ি থেকে আমার বাসা সর্ব্বোচ ৫শ গজ দুরে হবে। সম্প্রতি তিনি পরলোকগমন করেছেন। তার জীবদ্দশায় আমার সাথে দেখা হলেই বলতেন নবীউর কেমন আছো। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতেন। আমাকে নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললে তিনি প্রতিবাদ করে বলতেন, আমাকে তিনি যুদ্ধের মাঠে দেখেছেন। তালিকাভুক্ত অনেক যোদ্ধাকে স্বজনদের বাড়িতে সময় কাটাতে দেখেছেন তিনি। আমার প্রতিবেশী মোহিত ধোপার ছেলে দিলীপ কুমার দাস ক্ষোভে ভারতে চলে গেলে তিনি কষ্ট পেয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর বেকার জীবন ও সেসময়ের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রাষ্ট্রের কোন উদ্যোগ না থাকায় দিলীপ পরিবার সহ ভারতের মালদায় চলে যায়। সেখানে গিয়েও তার সুখ হয়নি। ঠাঁই হয়েছিল পদ্মা পাড়ের সরকারি জায়গায়। সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ায় না ফেরার দেশে চলে যায় সে। প্রয়াত যোদ্ধা সেই দীলিপ কুমার দাসকেও আমার সাথে যোদ্ধা হিসেবে দেখেছেন। আমরা একসাথে এক ক্যাম্পে থেকেছি এবং যুদ্ধ করেছি। কিন্তু সে অন্য কোম্পানীতে থাকত, তাই তার সাথে নিয়মিত দেখা হতনা আমার। তবে একসাথে বালুরঘাটে বাজার করতে এসেছি ২/৩ বার সে সময় মোহন স্যারের সাথে দেখা হয়েছে। দুজনই প্রতিবেশী হওয়ায় কিছু সময়ের জন্য হলেও বেশ অন্তরঙ্গ থেকেছেন আমাদের সাথে। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে আসার পর স্কুল চত্বরে প্রথম দেখাতেই স্যার আমাকে স্যালুট জানিয়ে ছিলেন একজন বীর হিসেবে। স্নেহের ছাত্র হিসেবে পরক্ষণেই জড়িয়ে ধরেছিলেন। আলিঙ্গন করে কুশল জানতে চেয়েছিলেন। এরপর যতদিন জীবিত ছিলেন আদরের সুরে হেঁসে কথা বলেছেন। তবে কখনও কখনও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অমুক্তিযোদ্ধাদের কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম দেখার পর। বলতেন, নবীউর তোমরা প্রতিবাদ করনা কেন? স্যারের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি। নিশ্চুপ থেকেছি। জীবিত থাকা পর্যন্ত ভালবেসেন আমাকে। পরার্শ দিয়েছেন সংসারের ভাল মন্দ বিষয় নিয়ে।
যাদের আগ্রহে অল্প বয়সেই মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম তারা হলেন আমার বাবা ও মা। হয়েছিলাম কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। তবে বখাটেপনার দিক থেকে কোন অংশেই কমতি ছিলনা। বাবা খন্দকার রশীদুর রহমান নিজেও ভারতের জলঙ্গি ক্যাম্পে থেকেছেন। সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের তৈরি করা স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে যোগ দিয়ে মানব সেবা করেছেন। একজন নাসিং এ্যটেন্ডেন্ট হিসেবে ওই কেন্দ্রে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সহ শরণর্থীদের সেবা করেছেন। আমার মা তার পাশে থেকেছেন। যুদ্ধকালীন কমান্ডার শেখ আলঅউদ্দিনদের সাথে প্রায় দেখা হত আমার বাবার। শেখ আলাউদ্দিনরা এক সময় সাবরামপুর ট্রেনিং ক্যাম্পে থাকার সময় বাবার সাথে সখ্যতা হয়। কখনও কখনও আমার বাবা খাবার নিয়ে যেতেন আলাউদ্দিনদের ক্যাম্পে। স্বাধীনতার পর বাবা-মা ও আলাউদ্দিনের মুখে শুনেছি এসব কাহিনী। এত কিছু করার পরও আমার বাবা তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেননি। আমি নিজে বাবার জন্য চেষ্টা করেও মুক্তিযোদ্ধা বানাতে পারিনি। আমার বাবা-মা নিজেরা মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্য লালায়িত ছিলেন না কখনও। বাবা বলতেন তিনিত কখনও সরাসরি যুদ্ধ করেননি। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের সেবা করেছেন মাত্র। তবে তাদের শান্তি ছিল তাদের ছেলে হিসেবে আমি মুক্তিযোদ্ধা হওয়া নিয়ে এবং গর্ববোধ করতেন আমাকে নিয়ে। স্বশিক্ষিত হলেও আমার মা আমাকে মাঝে মধ্যেই স্যালুট করতেন। বলতেন তোকে স্যালুট করে আমি শান্তি পাই। বাবা-মার সাথে প্রায় বন্ধুর মত সম্পর্ক ছিল আমাদের ভাই বোনদের। আমরা ১১ ভাই বোন। সে হিসেবে আমরা একটি ফুটবল টিমের মত। ৬ বোন ও ৫ ভাই। এক বোন না ফেরার দেশে চলে গেছেন। আমারা ভাইবোন সকলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী।
চুড়ান্ত লড়াই শেষে বিজয় অর্জনের পর ৭১ এর ২০ ডিসেম্বরে শেষ বিদায় নিয়ে যার যার মত বাড়ির পথে রওনা হই আমরা। এরপর আর দেখা হয়নি একে অপরের সাথে। বিজয় অর্জিত হওয়ার পর তুফানি ব্যাটেলিয়নের ক্যাম্প করা হয় বগুড়ার পুলিশ লাইনে। সেখানে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর কাছে অস্ত্র বুঝিয়ে দিয়ে যার যার বাড়ির উদ্দেশ্যে একে অপরের কাছে থেকে বিদায় নিই। অনেকে সেখানে আরও কয়েকদিন অবস্থান করেন। ওই দেখাই ছিল আমাদের কোম্পাণীর সহস্রাধিক মুক্তিযোদ্ধাদের শেষ দেখা বা শেষ বিদায়। তবে ৫ ডিসেম্বর বিজয়ের ৪৯ বছর পর আবারো বিজয়ের মাসেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে একত্রিত হই আমরা ৪ মুক্তিযোদ্ধা। ছিলাম আমি নাটোরের আলাইপুর গ্রামের দৈনিক সমকালের নাটোর প্রতিনিধি মুক্তিযোদ্ধা নবীউর রহমান পিপলু, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ হাদিনগর গ্রামের নোমান আলী,জেলার গোমস্তাপুর উপজেলার আলীনগর গ্রামের মহসিন আলী বুলু এবং শিবগঞ্জ পৌর এলাকার চতুরপুর গ্রামের তৈমুর রহমান মাষ্টার। আমাদের চার মুক্তিযোদ্ধার খবর পেয়ে তৈমুরের বাড়িতে ছুটে আসেন গোমস্তাপুরের প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা অহিদুল আলমের ছেলে শহিদুল আলম এবং শাহবাজপুর ইউনিয়নের মড়লটোলা গ্রামে মুক্তিযুদ্ধকালীন ক্যাম্পে যুদ্ধকারী মৃত আমানুল্লাহ বিশ্বাসের ভাই মোঃ আকবর হোসেন। বিষয়টি জানতে পেরে অন্যান্য মৃত মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যরাও আমাদের একনজর দেখার জন্য ও মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতি শোনার জন্য ভীড় করেন। আর এতে একে অপরকে কাছে পেয়ে আনন্দে আত্নহারা হয়ে পড়ি আমরা। যুদ্ধকালীন সময়ে নিজেদের সেই সব স্মৃতিগুলো আবারো নিজেদের মধ্যে ঝালাতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ি সবাই।
৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমরা অনেকেই দেশের অভ্যন্তরে গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেই। কিন্তু পরিস্থিতি অনুকুলে না থাকায় মুক্তিযুদ্ধোরা অনেকেই প্রতিবেশী দেশ ভারতে যাই। সেখানে গিয়ে বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যোগ দিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। আমি পশ্চিম দিনাজপুর জেলার বালুরঘাটের কামারপাড়া কুড়মাইলে পাবনার বেড়া এলাকার তৎকালীন এমসিএ অধ্যাপক আবু সাঈদ পরিচালিত ইয়থ ক্যাম্পে আশ্রয় পাই। সেখানে অনেকের মধ্যে আমার সঙ্গে সঙ্গী হন বগুড়া নট্রামসের প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল মান্নান ও আমার মামাতো ভাই আক্তারুজ্জামান হিরু। এই ক্যাম্পে মাঝে মাঝে হাজির হয়ে প্রশিক্ষণরত মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা যোগাতেন বাংলাদেশ চলচিত্রের শক্তিমান অভিনেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হাসান ইমাম, আনোয়ার হোসেন, চিত্র নায়ক জাফর ইকবাল এবং চিত্র নায়িকা কবরী প্রমুখ এখান থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য প্রথমে ভারতের রায়গঞ্জ সেনা ক্যাম্প এবং পরবর্তীতে দার্জিলিং জেলার শিলিগুলির পানিঘাটা (বাগডোকরা) ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। এসব ক্যাম্পে গেরিলা, এ্যাডভান্স ও জেএলসি (জুনিয়র লিডার কোর্স) প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। সেখানে পরিচয় থেকে সখ্যতা বাড়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর থানার আলীনগর গ্রামের মহসীন আলী ভুলু,শিবগঞ্জ উপজেলা সদরের তৈমুর,বগুড়ার এরুলিয়ার এটিএম জাকারিয়া তারুকদার, মাংগু, আব্দুস সামাদ, ইলিয়াস, সোনাতোলার মোফাজ্জলসহ অনেকের সাথে। প্রশিক্ষণ শেষে রায়গঞ্জের পতিরামপুর (গঙ্গারামপুর)এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয় আমাদের। বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের মন্ত্রী এএইচ এম কামরুজ্জামান এই ক্যাম্প পরিদর্শনে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহিত করেন। পরে আমাদের একাধিক রণাঙ্গনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেই। বছর ঘুরে মহান বিজয় দিবস কিংবা স্বাধীনতা দিবস ফিরে আসলে মনের স্মৃতি কোঠায় অনেক কিছুই মনে পড়ে। মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার সুবাদে পরিচিতদের অনেকেই কথাই মনে পড়ে।
আমার পরিবারের একজনের কথা না বললেই নয়। ১১ ভাইবোনের মধ্যে বড় আমার বোন রওশন আরা জোৎসনা। সম্প্রতি তিনি পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত। ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় বগুড়ায় শ্বশুর-শ্বাশুরীর সাথে বাস করতেন আমার এই বড় বোন। তার স্বামী তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তনে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই পাকসেনারা তাঁর শ্বশুরকে ধরে নিয়ে যায়। তার শ্বশুর চাকরী করতেন আবগারী বিভাগে। তাঁর স্বামী পাকিস্তান থেকে পালাতে গিয়ে সীমান্তে ধরা পড়ে পাকিস্তানী বাহিনীর গুলিতে নিহত হন। আমার বোন রওশন আরা জোসনা মুক্তিযুদ্ধের সময় বগুড়ার মালতিনগর স্টাফ কোয়াটারে থাকতেন শ্বশুর-শ্বাশুরীর সাথে। পাক হানাদাররা তাঁর শ্বশুরকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় কোলের নবজাতক কন্যা সন্তানকে হত্যার চেষ্টা করে। সে সময় নিজের সম্ভ্রম রক্ষাসহ নবজাতক কন্যা সন্তান ও শ্বাশুরীকে সঙ্গে নিয়ে বগুড়ার খরস্রোতা করতোয়া নদী পার হয়ে সে সময়ের দুর্গম বলদিপালান গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। অন্যের বাড়িতে কাজ করে এক বেলা খেয়ে না খেয়ে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস কষ্ট করে কাটিয়েছেন। ৭১ এর ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সাথে যুদ্ধরত অবস্থায় আমার বোনের অবস্থানরত সেই গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে যখন আমরা বগুড়া শহরের দিকে যাচ্ছিলাম, তখন আমার বোন আমাকে চিনতে পেরে চিৎকার করে ডাকাডাকি করছিল। কিন্তু আমি খেয়াল করিনি। আমার সহযোদ্ধা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর উপজেলার আলীনগর গ্রামের মহসীন আলী বুলু তা দেখে আমাকে বলেন। বগুড়া শত্রুমুক্ত হওয়ার পর আমরা ক’জন সেই গ্রামে যাই। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল গ্রামে প্রবেশের খবর পেয়ে আমার বোন ছুটে আসেন। আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। আমিও নিজেকে সংবরণ করতে পারিনি। দুই ভাইবোনের এই মিলনে অনেকেই আনন্দে কেঁদে ফেলেন। যাই হোক দেশ স্বাধীনের পর কন্যা সন্তান সহ বোনকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসি। স্বাধীনতার পর থেকে আমরা সব ভাইবোন বড় বোনের আদর, সোহাগ ও ভালবাসায় প্রায় ৫০ বছর ধরে এক সঙ্গে কাটাচ্ছি। ইতিমধ্যে বোনের একমাত্র কন্যার বিয়ে হয় বিমান বাহিনীর এক সাজেন্টের সাথে। বর্তমানে তিনি অবসরে। ঢাকায় একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। আমার সেই ভাগিনীর গর্ভে এক পুত্র ও এক কন্যা জন্ম হয়। আমার বোনের সেই নাতি বর্তমানে বিমান বাহিনীতে কর্মরত। আমার বোন আমাদের কাছে থাকতেই বেশী স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। তাই মেয়ে-জামাই বা নাতি-নাতনির ডাকেও তিনি সেখানে না গিয়ে আমাদের কাছেই থেকে যান। আমাদের কাছে থাকলেও দিন রাত শুধু মানুষের সেবা করেছেন। প্রতিবেশীদের কেউ অসুস্থ হলে ছুটে গিয়েছেন তার সেবায়। রাতকে রাত সেবা করেছেন সে সব অসুস্থ মানুষদের। ঝড়-বৃষ্টিতেও তাকে থামানো যায়নি মানুষের সেবা থেকে। এছাড়া কোন মহিলার মৃত্যু হলে তিনি ছুটে গেছেন তাকে গোসল করে কাফনের কাপড় পড়াতে। নিজে পান না খেলেও প্রতিবেশী মহিলাদের জন্য পান রেখেছেন ঘরে। নিজের খরচের জন্য সেলাই মেশিনে কাপড় সেলাই সহ হাতের কাজ করতেন। আমাদের কারো কোন বাধা নিষেধ মানতেন না। প্রিয়জন কাউকে কাছে পেলে আমার বোন ৭১ স্মৃতিময় দিনগুলোর গল্প করেন। পাকসেনা ও তাদের দোসর রাজাকার আলবদরদের নির্মমতা ও নৃশংসতার আজও ভুরতে পারেনি আমার বোন। তিনি পাকসেনাদের সাথে সরাসরি যুদ্ধে অংশ না নিলেও ৯ মাস যুদ্ধ করেছেন সন্তানকে বড় করে তোলা ও নিজের সম্ভ্রম রক্ষার। তার হৃদয়েও রয়েছে পুঞ্জিভুত ক্ষোভ। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে নিজে অনুপ্রাণিত হয়ে তার প্রয়াত শ্বশুরকে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার জন্য উৎসাহ দিয়েছিলেন আমার এই বড় বোন। স্বাধীনতার দীর্ঘদিনেও তার ভাগ্যে জোটেনি কোন রাষ্ট্রিয় সুযোগ সুবিধা। এই আক্ষেপ তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে গত ৪৮ বছরও ধরে। তবে রাজাকার ও স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচার হওয়ায় মহাখুশী আমার বড় বোন। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের বিজয় তাকে উল্লসিত ও আনন্দিত করেছে।
লেখক নবীউর রহমান পিপলু
বীর মুক্তিযোদ্ধা
সাংবাদিক, একুশে টেলিভিশন ও দৈনিক সমকাল
প্রকাশক, জাগোনাটোর২৪ডটকম
সভাপতি, ইউনাইটেড প্রেসক্লাব, নাটোর