নাইমুর রহমান, সিংড়া ঘুরে
নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের পাশে সিংড়ার নিংগইন এলাকা। এই পথ অতিক্রমকালে শুটকির ঘ্রাণ উপেক্ষা করা কঠিন। ফিরতি পথে ঘ্রাণের টানে অনেকেই ঢু মেরে যান চলনবিল অধ্যুষিত নাটোরের সিংড়া উপজেলার একমাত্র শুটকি পল্লীতে। ভোজনপ্রিয়দের নিকট এখনও স্বাদে-ঘ্রাণে অতুলনীয় চলনবিলের শুটকি।
আজ রোববার(১৫ই ডিসেম্বর) ভোরের আলো ফোটার পরপরই যাওয়া সিংড়ার সেই শুটকির রাজ্যে। তখনও ফাঁকা নাটোর-বগুড়া মহাসড়ক। ততক্ষণে শুটকি পল্লীতে একে একে আসা শুরু করেছেন চার চাতালের মাছ কাটা-বাছাইয়ের শ্রমিকরা। বাঁশের মাঁচায় ছৈই-এ ঢাকা চালার নীচে স্তুপ করে রাখা আধা-শুকনো চিংড়ি, টেংরা, পুঁটি, খলসে, বাতাসী, চেলা, মলা, টাকি, বাইম, শোল, বোয়াল, গজার, মাগুর, শিং, কৈসহ বাহারী মাছের শুটকি।
শেরকোল ইউনিয়নের পুঁটিমারী গ্রামে ষাটোর্ধো জহির উদ্দীন পুঁটি মাছ বিক্রি করতে এসেছেন শুটকি পল্লীতে। সকালের সূর্যালোক স্বচ্ছ-সাদা পুঁটি মাছের উপর ঠিকরে পড়ে চক্ চক্ করছিলো।
জহির উদ্দীন জানালেন, পানি শুকিয়ে বিলে এখন শুধু কাদা। তাছাড়া আগের মতো মাছও নেই। গত কয়েক দিনে তার খলইয়ে কেজি দশেক পুঁটি উঠেছে। লবন মেখে দুদিন পর প্রতিকেজি ১০০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন তিনি।
জহির উদ্দীনের থেকে কেনা পুঁটিগুলো পানিতে ধোয়া শেষে লবন মাখছিলেন শুটকি পল্লীর চার চাতালের একটির মালিক নাসির উদ্দীন। তিনি জানান, কয়েক বছর আগেও শুটকির মৌসুমে দিনে অন্তত ৫০ কেজি মাছ কিনতেন। এখন মাছ পাওয়া যায় মোটের উপর ২০ থেকে ২৫ কেজি। মাছের অভাবে আগের মতো শুটকি তৈরী হয় না।
অপর চাতাল মালিক আনোয়ার হোসেন জানান, এখন চলনবিলে মাছের সংকটের কারণে শুটকি তৈরীতে দ্বিগুণ খরচ হচ্ছে। মাছ বেশি বা কম হোক শ্রমিকদের নির্ধারিত টাকাই মজুরী দিতে হয়। সব মিলিয়ে শুটকি তৈরীতে খুব একটা লাভ হয় না।
অপর চাতাল মালিক হুমায়ুন কবীরের মাচায় এলো জিওল মাছ টাকি। পানি ভর্তি পাতিল থেকে বাঁশের ঝুড়িতে ঢালার সাথে সাথে কমে এলো টাকিগুলোর দাপাদাপি। তাজা মাছগুলো কাটতে আঁশবটি নিয়ে বসেছেন মাছ কুটুনীরা। সফুরা, আমেনা ও রুপালীরা দক্ষ হাতে টাকির আঁশ ছাড়িয়ে কানকো কেটে পিত্ত বের করে রাখছেন আলাদা ঝুড়িতে। দিনপ্রতি ১৫০ টাকা মজুরীতে তারা আধাবেলা মাছ কাটেন। কেউ বা মাছ কাটার পর কিছু বাড়তি টাকার বিনিময়ে চাতালের মাচাগুলোতে মাছগুলো রোদে শুকাতে দেন, দেন ঘন্টায় ঘন্টায় উল্টে-পাল্টে বা শুটকি বাছাই করেন। শীত মৌসুমে শুটকি পল্লীতে কাজ করেই তাদের বাড়তি জীবিকা।
স্থানীয় মাছের পাশাপাশি দক্ষিণাঞ্চল থেকেও অল্পকিছু মাছ আসে এই শুটকি পল্লীতে। সেগুলো হলো রুপচাঁদা, লইট্টা, বড় ছুঁরি, ইলিশ, বড় ও মাঝারি চিংড়ি। চাতাল মালিকদের তত্বাবধানে এভাবেই মাছ কাটা থেকে শুকাতে দেয়ার কাজ চলতে থাকে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে মহাসড়কের পাশেই বসে শুটকির দোকান। মাছভেদে প্রতিকেজি শুটকি দাম সাড়ে চার’শ টাকা থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত। রুপচাঁদা মাছের শুটকি প্রতিকেজি ২০০০ টাকা, লইট্টা ৭০০ টাকা, ছুঁরি ১১০০ টাকা, ইলিশ আকারভেদে ৭০০ থেকে ১৬০০ টাকা, মলা ও কাচকি ৭৫০ টাকা, শৈল ১৫০০ টাকা, টাকি ৭০০ টাকা, পুঁটি ২৫০ টাকা, খলসে ও বাতাসি ৩০০ টাকা, বাইম ৮০০ টাকা, কই ৬০০ টাকা ও টেংরা ৮০০ টাকা। প্রক্রিয়াজাতকরণে কোনপ্রকার কেমিক্যাল ব্যবহার না করায় স্বাদ অক্ষুণ্ন থাকে। তাই খুচরা ক্রেতারও অভাব হয় না। বৃহদাকারে শুটকির মূল ক্রেতা নীলফামারীর সৈয়দপুরের ব্যবসায়ীরা। এখন পর্যন্ত প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ মণ শুটকি বিক্রি হয় এখান থেকে। এছাড়া রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, দিনাজপুর, কক্রবাজার, রাজশাহী, কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা এখান থেকে শুটকি কিনে নিয়ে বিক্রি করেন।
মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ থেকে শুটকি উৎপাদন পর্যন্ত জড়িতরা বলেন, চলনবিলে ফি-বছর কমেই চলেছে দেশীয় মাছ। তবে ভরা বর্ষায় কিছু মাছ বংশবিস্তার করে বিলের পানিতে। এক হাঁটু পানিতে নেমেই দ্রুত বর্ধণশীল এই মাছগুলো ধরা যায়। তখন বাজারেও সস্তায় বিক্রি হয় মাছগুলো। চলনবিলের চাহিদা মিটিয়ে মাছগুলো বাইরে চলে যায়। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকাররা এসে কম দামে বিলের মাছগুলো কিনে বাইরের বাজারে চড় দামে বিক্রি করে। শুটকির সাথে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এমন প্রেক্ষাপটে একটি মাছ সংরক্ষণাগার থাকলে বর্ষার সম্তা মাছগুলো ধরে রেখে শীতের শুরুতে শুটকি তৈরী করা যেত। একটি মাছ সংরক্ষণাগারই উন্মোচন করতে পারে চলনবিলের মাছকেন্দ্রিক অর্থনীতির নতুন দিগন্ত।
জেলা মৎস কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সিংড়ার শুটকিপল্লীতে প্রতি মৌসুমে ৩০০ মেট্রিক টন শুটকি উৎপাদন হয়। চলতি বছরের অক্টোবর মাস পর্যন্ত ১৫২ মেট্রিক টন পর্যন্ত শুটকি উৎপাদন হয়েছে। বিগত কয়েক বছর চলনবিলে পানি কম থাকায় মাছের জন্য অনুকূল পরিবেশ থাকছে না যার ফলশ্রুতিতে মাছ এবং মাছ থেকে শুটকির পরিমাণ কমে গেছে।
নাটোর-৩(সিংড়া) আসনের সংসদ সদস্য ও আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, সিংড়ার কৃষি ও মৎস্য সম্পদের সংরক্ষণে ইতোমধ্যে সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে যাতে মাছ সংরক্ষণের জন্য নির্দেশনা ও অবকাঠামোগত সুবিধা বিদ্যমান থাকবে। এটি প্রণীত হলে বাস্তবায়নের মাধ্যেম শুটকিসহ মাছকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে বিপ্লব সূচিত হবে।