নবীউর রহমান পিপলু, গুরুদাসপুর ঘুরে॥
নাটোরের গুরুদাসপুরের বঙ্গবন্ধুর আদর্শের তিন সৈনিক প্রবীর কুমার বর্মন, নির্মল কর্মকার ও অশোক কুমার পাল। উনিশ’ পচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ পরিবারের হত্যার প্রতিবাদ করাসহ বিচার চাওয়ায় কারাভোগ সহ পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তারা। অপরাধ হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ ও বিচার দাবী করে বিশৃংখলা সৃষ্টির চেষ্টা। বিচারে ৬ মাসের স¤্রম কারাদন্ড সহ ২৯ মাস কারাভোগের পর ১৯৭৭ সালে মুক্তি পান তারা। মুজিব হত্যার ৪৩ বছর কেটে গেলেও তাদের খবর রাখেননি কেউ। অথচ তথ্যানুসারে তারা তিনজনই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর উত্তরাঞ্চলে প্রথম প্রতিবাদকারী। তারা যখন নিজে হাতে বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ এবং বিচার দাবী করেন,তখন তারা ছিলেন কলেজ পড়ুয়া টগবগে যুবক। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাদের এতটা ভালবাসা ছিল যে এই হত্যাকান্ড কোনভাবেই মেনে নিতে পারছিলেননা। তাই তারা প্রতিবাদ জানাতে নিজে হাতে লিখে পোষ্টার ও লিফলেট করে এলকায় বিভিন্ন স্থানে সাঁটিয়ে ছিলেন। এসময় অনেকেই নিশ্চুপ থেকেছেন। অথচ ওই তিন বন্ধুর ভুমিকা ছিল সরব। তাদের ওই সরব ভুমিকার কারনে প্রত্যেককের পরিবারকে মুর্য দিতে হয়েছে। কিন্তু কারাভোগকারী ওই তিন বন্ধুর খোঁজ নিতে বা তাদের পাশে দাঁড়াতে কেউ এগিয়ে আসেনি।
এবার প্রথম স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীদের মাধ্যমে তাদের তিন বন্ধুর বিরত্বগাঁথা কাহিনী জানতে পেরে উপজেলা নির্বাহী অফিসার তমাল হোসেন উদ্যোগ নিয়েছেন তাদের জন্য কিছু করার। ইতোধ্যে বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত ৪১তম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সপ্তাহ, বিজ্ঞান মেলা ও বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড-২০১৯ এর সমাপনী অনুষ্ঠানে সম্মান জানান এবং নতুন প্রজম্মের কাছে তাদের অবদান তুলে ধরেন। এসময় উপস্থিত উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেনও ওই তিন বন্ধুর সহায়তায় সর্বাত্বক সহযোগীতার আশ্বাস দেন।
প্রবীর কুমার বর্মন বলেন, তারা তিন বন্ধু সেসময়ের ছাত্রলীগ কর্মী ছিলেন। তৎকালীন গুরুদাসপুর থানার চাঁচকৈড় বাজারে তাদের তিনজনের বাড়ি হওয়াই সখ্যতা বেশী ছিল। রাজনৈতিক কর্মসুচী পালন ও খেলাধুলা করতেন এক সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি ছিল প্রগার ভালবাসা। তার আদর্শ ছিল তাদের বুকে। তাই ৭৫ এর ১৫ বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করা হলে আমরা সহ্য করতে পারিনি। তাই বঙ্গবন্ধর হত্যার প্রতিবাদ জানাতে এবং হত্যাকরীদের বিচার দাবী করলে তাদের পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৭ আগষ্ট তারা তিন বন্ধু একত্রে “রক্তের বদলে রক্ত চাই, মুজিব হত্যার বিচার চাই” শ্লোগানে পোস্টারিং ও লিফলেট বিতরণ করি। কিন্তু রাতে পুলিশ তাদের তিন বন্ধুকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায় গুরুদাসপুর থানার পুলিশ। থানার তৎকালীন ওসি আনোয়ার হোসেন বয়সে তরুন এই তিন বন্ধুকে দ্রুত নাটোর মুহাকুমা আদালতে সোপর্দ করলে আদালত তাদের প্রত্যেককে দুই বছরের ডিটেনশন দিয়ে উপকারাগারে প্রেরনের নির্দেশ দেন। জেলখানার তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়। জেল পুলিশদের অসহনীয় নির্যাতনের কথা মনে পড়লে এখনও শিউরে ওঠে শরীর। পরে বিচারে আদালত তাদের তিনজনকে ৬ মাস করে সশ্রম কারাদন্ড ও দুইশ টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে আরো দুইমাসের কারাদন্ডের আদেশ দেন। প্রবীর বর্মন জানান, কষ্ট সয়ে দুই মেয়ে কৃপা ও তৃষাকে এমএ পাশ করিয়েছি। তাদের চাকরি হয়নি। ছেলে প্রসেনজিৎ বিএ পড়ছে। স্ত্রী সন্ধ্যা বর্মন অসুস্থ। ছোট ভাইয়ের ইলেকট্রিক দোকানে থাকেন তিনি। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সংসারের খরচ জোগাতে তিনি হিমসিম খাচ্ছেন।
অশোক কুমার পাল বলেন, ওই সময় তাদের পক্ষে কথা বলারও কেউ ছিল না। মুজিব হত্যার ৪৩ বছর কেটে গেলেও তাদের খোঁজ নেয়নি কেউ। পোস্টারিং ও লিফলেট বিতরণ করার অপরাধে আটক করে নির্মমভাবে অত্যাচার করা হয়েছিল। তাদের কে গ্রেফতারের পর প্রথমে নাটোর উপকারাগারে এবং পরে রাজশাহী কেন্দ্রিয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। রাজশাহীতে নিয়ে যাওয়ার পর তাদের ওপর চালানো হয় নির্যাতন। জেল পুলিশ তাদের ওপর নির্যাতন করত। জেল থেকে বের হয়ে আসার পর নিরাপত্তার অভাবে তিনি ভারতে চলেযান। প্রায় ১০ বছর পর দেশে ফিরে আসি। কারাগারে থাকা অবস্থায় ইন্টারমিডিয়েড পরীক্ষার জন্য আমাকে অর্ন্তবর্তীকালীন জামিনে মুক্তি দেয়া হয়। পরীক্ষা শেষে আবার কারাগারে নেয়া হয়। পরে জেল থেকে বের হয়ে এসে অসহনীয় ও দুর্বিসহ জীবন কাটাতে হয়। সঙ্গীত চর্চা ও গান শিখিয়ে দুই মেয়েকে লেখা পড়া করিয়েছি। ভারতে চলে যাওয়ার পর প্রতিঙ্গা করেছিলাম বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত দেশে ফিরবনা। তিনি আরও বলেন, আমার সংসারের হাল শক্ত করে ধরতে পারিনি। গান শিখিয়ে যা মাইনে পাই তা বউয়ের হাতে দেই। দুই মেয়ে মুনমুন ও অন্তরা। অন্তরা এমএ পাশ করলেও চাকরি জোটেনি কপালে। গান গাই, গান শেখায় আর ঘুরে বেড়াই। না পাওয়ার বেদনায় অন্তরে কষ্ট থাকায় মনে শান্তি নেই।
নির্মল কর্মকার বলেন, সে সময় অন্যায়ভাবে আটক করে তাদের জীবনকে বিপন্ন করে তোলা হয়। জীবনের সোনালী সময়ে গড়তে দেয়া হয়নি তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত। জেল থেকে মুক্তির পরও তারা ভয়ে ভয়ে থাকতেন। কখন জানি তাদের আবারও গ্রেফতার করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারন করে এখনও প্রতিক্ষার প্রহর গুনে চলেছেন এই তিন বন্ধু প্রবীর কুমার বর্মন, নির্মল কর্মকার ও অশোক কুমার পাল। তারা তিন বন্ধু এখনও একে অপরের খোঁজ খবর রাখেন। সুবিধা বঞ্ছিত এই তিন বন্ধুর জীবন কাটছে নানা সমস্যায়। নাটোরের গুরুদাসপুর পৌর শহরের চাঁচকৈড় বাজারে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস ওই তিন বন্ধুর। তাদের জীবন চলছে সীমাহীন কষ্টের মধ্য দিয়ে। তবে এখনও বঙ্গবন্ধুর জন্য তাদের প্রান কাদে। তারা জানান, ১৫ আগস্ট এলে তারা উপোস থাকেন আর বঙ্গবন্ধুর আত্মার শান্তি কামনায় ভগবানের দরবারে প্রার্থনা করেন। তাদের স্বপ্ন ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বাস্তবায়ন হওয়া। বিচার হওয়ায় তারা খুব খুশী। মুজিব হত্যার ৪৩ বছর কেটে গেলেও কেউ তাদের খোঁজখবর নেয়নি। তাদের দুঃখ এখন আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় , তারপরও তাদের ভাগ্যোন্নয়ন হয়নি।
নির্মল কর্মকার আরও বলেন, মেয়ে তাপসিকে এমএ পাস করালেও অর্থাভাবে দুই ছেলে তনয় ও শুভকে আইএ পাশের পর আর পড়াতে পারিনি। একটি রঙের দোকান চালান তিনি। বয়স বাড়ার সাথে সাথে অভাব অনটন বাড়ছে। টানাপোড়েন জীবনে সন্তানদের জন্য কিছু করতে পারলাম না- এটাই আফসোস।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক এই তিন বন্ধুর বীরত্বগাঁথা কাহিনীর পর কেউ তাদের খোঁজ না নেয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, সম্প্রতি বিষয়টি জানতে পেরে সহায়তার জন্য প্রস্তুতি ইউএনওর সাথে আলাপ করেছি। উপজেলা প্রশাসন তাদের এ চিরস্মরণীয় অবদানকে যথাযথ মূল্যায়ণ করতে করবে।
গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ তমাল হোসেন বলেন, ওই তিন বন্ধু জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে ধারন করে জাতির জনকের হত্যার প্রতিবাদ করেছিলেন। কারা ভোগসহ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তারা তিনজন এখনও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারন করে চলেছেন। তাদের শ্রদ্ধা জানানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যথাসম্ভব সহায়তা করা হবে। এছাড়া সব ধরনের সহায়তা সহ তাদের বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষন করার উদ্যোগ নেয়া হবে। ্বঙ্গবন্ধুর এ অকুতোভয় সৈনিকদের পরবর্তী প্রজম্ম যেন ভুলে না যায় সেজন্যও আমাদের উদ্দোগ থাকবে।