নাটোর অফিস॥
বিজয়ের ৪৯ বছর পর আবারো বিজয়ের মাসেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে একত্রিত হলেন চার বীর মুক্তিযোদ্ধা।বিষয়টি জানতে পেরে অন্যান্য মৃত মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যরাও তাদের একনজর দেখা ও যুদ্ধকালের গল্প শোনার জন্য ভীড় করেন। আর এতে একে অপরকে কাছে পেয়ে আনন্দে আত্নহারা হয়ে পড়েন তারা।যুদ্ধকালে সেসব স্মৃতি রোমন্থনে গিয়ে আপ্লুত হয়ে পড়েন তারা।
মুক্তিযোদ্ধাদের এ মিলনমেলাটি বসেছিল বৃহষ্পতিবার(৫ ডিসেম্বর) চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার চতুরপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা তৈমুর রহমান মাষ্টারের বাড়িতে।
রণাঙ্গনের চার মুক্তিযোদ্ধা হলেন, নাটোর শহরের আলাইপুর নিবাসী একুশে টেলিভিশন ও দৈনিক সমকালের নাটোর প্রতিনিধি মুক্তিযোদ্ধা নবীউর রহমান পিপলু, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ হাদিনগর গ্রামের নোমান আলী, জেলার গোমস্তাপুর উপজেলার আলীনগর গ্রামের মহসিন আলী বুলু এবং শিবগঞ্জ পৌর এলাকার চতুরপুর গ্রামের তৈমুর রহমান মাষ্টার।
জাতির বীর সন্তানদের খবর পেয়ে ওই বাড়িতে আসেন গোমস্তাপুরের মুক্তিযোদ্ধা মরহুম অহিদুল আলমের ছেলে শহিদুল আলম এবং শাহবাজপুর ইউনিয়নের মড়লটোলা গ্রামে যুদ্ধকালীন ক্যাম্পে শহীদ আমানুল্লাহ বিশ্বাসের ভাই মোঃ আকবর হোসেন।
স্মৃতিচারণকালে মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ৭ নং সেক্টরের অধীনে ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্বাবধানে গঠন করা হয় তুফানি ব্যাটেলিয়ন। দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন অঞ্চলের সহস্রাধিক মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গঠন করা হয় এই তুফানি ব্যটেলিয়ান। সঙ্গে থেকেছেন ভারতীয় সেনা সদস্যরা। ডিসেম্বরে ভারতীয় বাহিনী পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করলে তাদের সাথে আমরাও যুদ্ধে অংশ নিই এবং ১৩ ডিসেম্বর বগুড়াকে মুক্ত করে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের বাড়ি ফিরে আসি।এর পর দীর্ঘ ৪৯ বছর পর আমরা একত্রিত হতে পেরে খুবই আনন্দিত।
এ ব্যাপারে সাংবাদিক মুক্তিযোদ্ধা নবীউর রহমান পিপলু জানান, আমরা জানতে পেরেছি সহযোদ্ধা তৈমুর অসুস্থ।তাই তাকে দেখার জন্য বাকী তিনজন একত্রিত হয়েছি।
তিনি আরও বলেন, ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমরা অনেকেই দেশের অভ্যন্তরে গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেই। কিন্তু পরিস্থিতি অনুকুলে না থাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই প্রতিবেশী দেশ ভারতে যাই। সেখানে গিয়ে বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যোগ দিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। আমি পশ্চিম দিনাজপুর জেলার বালুরঘাটের কামারপাড়া কুড়মাইলে পাবনার বেড়া এলাকার তৎকালীন এমসিএ অধ্যাপক আবু সাঈদ পরিচালিত ইয়ুথ ক্যাম্পে আশ্রয় পাই। সেখানে অনেকের মধ্যে আমার সঙ্গে সঙ্গী হন বগুড়া নট্রামসের প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল মান্নান ও আমার মামাতো ভাই আক্তারুজ্জামান হিরু। এই ক্যাম্পে মাঝে মাঝে হাজির হয়ে প্রশিক্ষণরত মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা যোগাতেন বাংলাদেশ চলচিত্রের শক্তিমান অভিনেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হাসান ইমাম, আনোয়ার হোসেন, চিত্র নায়ক জাফর ইকবাল এবং চিত্র নায়িকা কবরী প্রমুখ। এখান থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য প্রথমে ভারতের রায়গঞ্জ সেনা ক্যাম্প এবং পরবর্তীতে দার্জিলিং জেলার শিলিগুলির পানিঘাটা (বাগডোকরা) ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। এসব ক্যাম্পে গেরিলা, এ্যাডভান্স ও জেএলসি (জুনিয়র লিডার কোর্স) প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। সেখানে পরিচয় হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর উপজেলার আলীনগর গ্রামের মহসীন আলী ভুলু,শিবগঞ্জ উপজেলা সদরের তৈমুর,বগুড়ার এটিএম জাকারিয়া তালুকদার, মাংগু, আব্দুস সামাদ, ইলিয়াস, সোনাতোলার মোফাজ্জলসহ অনেকের সাথে। প্রশিক্ষণ শেষে রায়গঞ্জের পতিরামপুর (গঙ্গারামপুর)এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয় আমাদের। বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের মন্ত্রী এএইচ এম কামরুজ্জামান এই ক্যাম্প পরিদর্শনে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহিত করেন। পরে আমাদের একাধিক রণাঙ্গনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেই। ৭১-এর ৬ ডিসেম্বর ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার পর এই ক্যাম্প থেকে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে প্রতিদিন বাংলাদেশের নওগাঁ, জয়পুরহাট, পাঁচবিবি ও হিলি এলাকায় গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিই। তুফানি ব্যাটেলিয়নের কোম্পানী কমান্ডার ভারতীয় সেনা সদস্য মেজর মতিলাল চৌধুরীর কমান্ডে মিত্র বাহিনীর সঙ্গে আমার সেকশন কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা বগুড়ার এরুলিয়া গ্রামের জাকারিয়া তালুকদারের নেতৃত্বে এবং মিত্র বাহিনীর সঙ্গে হিলি,পাঁচবিবি,জয়পুরহাট,রংপুরের গোবিন্দগঞ্জ হয়ে বগুড়া অঞ্চলের যুদ্ধে অংশ নেই। এসব অঞ্চল জয় লাভের পর ১৩ ডিসেম্বর বগুড়াকে মুক্ত করে নিজ নিজ গ্রামে ফিরে আসি।