মুঞ্জুরুল আলম মাসুম,বাগাতিপাড়া নাটোর
একজন বয়স তখন ১৯ আরেকজন ১৭ বছর। বাবার হাত ধরে প্রথম ঢুকেছিলেন কামারশালায়। এরপর কেটে গেছে ৬৫ বছর। গরম লোহাকে ছাঁচে ফেলে নতুন আকৃতি দেয়া দুই সহোদর ভবেশ চন্দ্র কর্মকার ও অশ্বিনী চন্দ্র কর্মকার বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। তবুও জীবন সায়াহ্নেও শুধুমাত্র জীবীকার তাগিদে চালিয়ে যাচ্ছেন জীবনযুদ্ধ। কামারশালাতেই আটকে আছে তাদের তাদের নিয়তি।
নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার পাঁকা ইউনিয়নের কর্মকারপাড়া। গাঁয়ের পথ ধরে সামনে এগিয়ে গেলে পথের ধারেই চোখে পড়ে একটি ছোট্ট ঘর। দূর থেকে ভেসে আসে ঘরের ভেতরের লোহা পেটানোর শব্দ। সকাল-সন্ধ্যা এই ঘরেই কাজ করেন বৃদ্ধ দুই ভাই ভবেশ চন্দ্র কর্মকার ও অশ্বিনী চন্দ্র কর্মকার।
সম্প্রতি পাঁকা ইউনিয়নের কর্মকার পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির পাশে রাস্তার ধারে ছোট্ট একটি খুপরি ঘরে দুই ভাই কামারের কাজটি করছেন। বড় ভাই ভবেশ চন্দ্র কর্মকার দা, হাসুয়া, বটি ও ছুরি পোড়ানোর পরে র্যাত(ধার করা যন্ত্র) দিয়ে সেগুলোতে ধার উঠাচ্ছেন। আর ছোট ভাই অশ্বিনী চন্দ্র কর্মকার হাসুয়া পোড়াচ্ছেন। ক্লান্ত এই দুই বৃদ্ধ সহোদর অসুস্থ্য শরীরে ভালো মতো কথাও বলতে পারছিলেন না।
বড় ভাই ভবেশ চন্দ্র কর্মকারের বয়স ৮৪ বছর। তিনি পাঁচ ছেলের বাবা। ভবেশ-অশ্বিনী তাদের পূর্ব পুরুষের পেশা ধরে রাখলেও ছেলেরা দেশের বিভিন্ন স্থানে স্বর্ণকারের কাজ করেন। কিন্ত বৃদ্ধ বাবা-মায়ের খোঁজ রাখেন না। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া ভবেশ চন্দ্র কর্মকার এখন ভারী হাতুড়ি ঠিকমতো উপরে ওঠাতে পারেন না। তবুও দু’মুঠো ভাতের জন্য এই বয়সেও করছেন কামারের কাজ। নিদারুণ কষ্টে গরম লোহা পিটিয়ে গড়ছেন দা-বটি-ছুরি-কাস্তেসহ লোহার সামগ্রী। যা রোজগার করেন, দিন শেষে তাই দিয়েই চাল-ডাল কেনেন ভবেশ চন্দ্র কর্মকার। এই বয়সে আর্থিকভাবে সক্ষম অনেকেই বয়স্ক ভাতা পেলেও তার ভাগ্যে জোটেনি কোন ভাতা।
অপরদিকে, ভবেশ চন্দ্র কর্মকারের ছোট ভাই আশ্বিনী চন্দ্র কর্মকারের বয়স ৮২ বছর। ভবেশের পাশেই তার বসবাস। তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে। তারা সকলেই বিবাহিত। ছোট ছেলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তপুরে থেকে স্বর্ণকারের কাজ করেন। বড় ছেলে বাড়িতে থাকলেও তিন সন্তান নিয়ে তিনি নিজেই অভাবগ্রস্থ। ফলে বৃদ্ধ বাবা-মাকে দেখার কেউ নেই। অশ্বিনী চন্দ্র কর্মকারের বাড়ির ভিটা ছাড়া আর কোন জায়গা জমি নেই। নিজে অসুস্থ হলেও অভাবের তাড়নায় নিরুপায় তিনি। তাই অসুস্থ শরীরে বাপ-দাদার পেশা কামারের কাজ করেই স্ত্রীকে নিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। হাতুড়ি-কাস্তে বিক্রির সামান্য টাকায় খাবার আর ঔষধ কিনে কোনমতে জীবন পার করছেন তিনি।
বড় ভাই ভবেশ চন্দ্র কর্মকার জানান, সন্তানরা তাকে দেখেন না। এ বয়সে তাই তিনি নিজেই কাজ করছেন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজ করে খেতে চান তিনি। তবে বয়স বেড়ে শরীর দুর্বল হয়ে রোগ-ব্যধি বাসা বাঁধলে তখন কিভাবে কাজ করবেন এ নিয়ে দুশ্চিন্তা তার।
তবে ছোট ভাই অশ্বিনী কর্মকার শারীরিকভাবে দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তিনি বলেন, ‘দিন যতই বাড়ছে এই ভারি কাজ করা আর সম্ভব হচ্ছে না। মাসে বয়স্ক ভাতা পাই ৫০০ টাকা। এই টাকায় তো আর সংসার চলে না বড়জোর যৎসামান্য ঔষধ কেনা যায়। তাই কামারের কাজ করে ঔষধ আর খাবারের ব্যবস্থা করতে হয়।’
দুই ভাইয়ের জীবন সংগ্রামের কাহিনী শুনে পাঁকা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন বলেছেন, চলতি বছর আবেদনের সময় শেষ হয়ে গেছে। সামনে বয়স্ক ভাতা, ভিজিডি কার্ডের আবেদনের সময় আসলে ওই দুই ভাইয়ের কার্ডের ব্যবস্থা তিনি করবেন।
বাগাতিপাড়া উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা রেজাউল করিম জানান, তিনি লোকমুখে বৃদ্ধ দুই সহোদরের কথা শুনেছেন। এই বয়সে তাদের কষ্ট একটু হলেও লাঘবের জন্য আগামীতে বয়স্ক ভাতার তালিকায় ভবেশ চন্দ্র কর্মকারকে অন্তুর্ভূক্তের মাধ্যমে তাদের সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দেন।