নাটোর অফিসঃ হত্যা, ডাকাতি বা ছিনতাইয়ে পর লুট হওয়া স্বর্ণ বিক্রির ‘নিরাপদ বাজার’ হয়ে উঠেছে নাটোর শহরের পিলখানা রোডস্থ লালবাজার স্বর্ণপট্টি। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা এসব স্বর্ণ অর্ধেক দামে ক্রয়ের পর কখনও গলিয়ে ‘বার’ বানিয়ে আবার কখনও সরাসরি অন্য ব্যবসায়ীর নিকট বিক্রি করা হয়। কোন রসিদ ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরে লুট হওয়া স্বর্ণ ক্রয়-বিক্রয় করে আসছিলো একটি ব্যবসায়ী চক্র। সম্প্রতি একটি জোড়া খুনের মামলা তদন্ত করতে গিয়ে হত্যাকারীদের স্বীকারোক্তিতে গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হত্যার পরিকল্পনাসহ বেরিয়ে আসে স্বর্ণ কেনাবেচার চাঞ্চল্যকর তথ্য। এরই সূত্র ধরে স্বর্ণ ক্রয়ে জড়িত দুই জুয়েলার্স মালিককে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেফতারের পর নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছেন তারা। তবে পরোক্ষে ক্রেতা হওয়ায় জিজ্ঞাসাবাদ শেষে একজনকে ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ।
জানা যায়, চলতি মাসের ৮ই অক্টোবর দিবাগত রাতে নাটোরের লালপুর ও বাগাতিপাড়া উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত বড়ার নদীর দুই পাড়ের দুই গ্রাম চংধুপইল ও জয়ন্তীপুরে কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে আনসার সদস্য সাবিনা(২৮) ও বাগাতিপাড়ার জয়ন্তীপুর গ্রামের রেহানা বেগমকে(৬০) হত্যা করা হয়। একই রাতে পাশাপাশি গ্রাম দুটিতে জোড়া খুনের ঘটনায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলে তদন্তে নামে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৪ই অক্টোবর নওগাঁ জেলার আত্রাই, রাণীনগর ও নাটোরের সিংড়া থেকে ৩ জনকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। আটকের পর ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকান্ডে নিজেদের সরাসরি সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছে ওই তিনজন। তবে অধিকতর তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম প্রকাশ করছে না পুলিশ।
জেলা গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, গ্রেফতারকৃত তিনজন হত্যাকান্ডের বেশ কয়েকদিন আগে নিজ এলাকা থেকে এসে চংধূপইল ও জয়ন্তীপুর এলাকায় জেলের বেশে অবস্থান নেয়। তারা বড়াল নদে শিকার করা মাছ বিক্রির ছলে হত্যাকান্ডের আগের দিন তিন হত্যাকারী সাবিনা ও রেহানার বাড়িতে ঢুকে রেকি করে। ৮ই অক্টোবর দিবাগত রাতে প্রথমে চংধূপইল গ্রামে আনসার সদস্য সাবিনাকে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর নদী পেরিয়ে জয়ন্তীপুর গ্রামে ঢুকে বৃদ্ধা রেহানা বেগমকেও একই কায়দায় হত্যা করে তারা। হত্যার পর সাবিনার ১০ আনা স্বর্ণ ও রেহানার ১৫ হাজার টাকা নিয়ে পালিয়ে যায় হত্যাকারীরা। পরে নিজ এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদের জড়িতরা লুট করা স্বর্ণ বিক্রির কথা স্বীকার করেন। তারা জানান, এসব স্বর্ণ কম দামে কিনতেন লালবাজারের আয়েশা জুয়েলার্সের মালিক লিটন খাঁ। লিটনকে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদের পর ওই স্বর্ণ তিনি হত্যাকারীদের নিকট থেকে ১৬ হাজার টাকায় কিনে পিলখানা এলাকার দেবাশীষ বল ঘর এ্যান্ড জুয়েলারী স্টোরের মালিক বাবলু দে’র নিকট ২২ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন বলে স্বীকার করেন। এ স্বীকারোক্তির সূত্র ধরে বাবলু দে-কেও আটক করা হয়। পরে এ ঘটনায় মামলা দায়েরের পর লিটনকে গ্রেফতার দেখিয়ে বাবলুকে ছেড়ে দেয়া হয়।
জেলা গোয়েন্দা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ(ওসি) সৈকত হাসান জানান, প্রথমে আটক দুই স্বর্ণ ব্যবসায়ী একে অপরের থেকে লুট হওয়া স্বর্ণ কেনা-বেচার কথা স্বীকার করেন। তাদের মধ্যে বাবলু দে লিটনের নিকট থেকে নায্যদামের কাছাকাছি দামে স্বর্ণ কিনেছেন বলে তিনি পরোক্ষ ক্রেতা। ব্যবসায়ীক খাতিরে তিনি সরল মনে স্বর্ণ কিনেছেন। কিন্ত লিটন দীর্ঘদিন ধরে এসব স্বর্ণ কিনে গলিয়ে আসছিলেন। তাই জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বাবলু দে-কে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
ওসি আরও জানান, বছরপাঁচেক আগে একজন প্রতিমন্ত্রীর আত্নীয়ের বাড়ি থেকে লুট হওয়া স্বর্ণ, বড়াইগ্রামের আহমেদপুরের একটি বাড়িতে ডাকাতির পর লুট হওয়া স্বর্ণ, গাজীপুরের একটি হত্যার ঘটনায় লুট হওয়া স্বর্ণ, টাঙ্গাইলের সখীপুরসহ বেশ কয়েকটি জেলায় হত্যা ও ডাকাতির ঘটনা পরবর্তী লুটের সাথে গ্রেফতার ৩ আসামীর সম্পৃক্ততা রয়েছে এবং তারা সেসব স্বর্ণ নাটোর স্বর্ণকার পট্টিতেই গলাতেন। টাঙ্গাইল ও গাজীপুরের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তাদের (আইও)নাটোরে ডাকা হয়েছে। হত্যাকারী ও স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদে আরো তথ্য জানার চেষ্টা করা হচ্ছে।
এদিকে, ব্যবসায়ী লিটনকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১৫ ও ১৬ই অক্টোবর দুইদিন ধর্মঘট পালন করেছেন পিলখানা- লালবাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা। এসময় তারা পুলিশী হয়রানির অভিযোগ তুলেছেন।
এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) জেলা সম্পাদক ভক্ত প্রসাদ চক্রবর্তী বলেন, ‘লুট হওয়া স্বর্ণ বিক্রির ঢালাও অভিযোগ সত্য নয় কেননা এখানে রসিদ ছাড়া পুরাতন স্বর্ণ কেনা-বেচা হয় না। এর জন্য সকল ব্যবসায়ীকে দায়ী করা উচিত নয়। তবে কেউ যদি এই অপকর্মের সাথে সত্যিই জড়িত থাকে তবে তার পক্ষ নেবে না সমিতি।’
জেলা পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা বলেন, গ্রেফতার আসামীর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী কয়েকটি জুয়েলারী দোকানকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। স্পর্শকাতর এ বিষয়ে আরো গভীরে অনুসন্ধান করা হচ্ছে। স্বর্ণ কেনা-বেচায় সচেতন হতে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়কেই সচেতন হতে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।