নাটোরঃ নাটোর জেলায় রেজিস্টার্ড ফিজিওথেরাপিস্ট মাত্র ৪ জন। অথচ সারা জেলায় স্পর্শকাতর এ সেবা ভুয়া ফিজিওথেরাপিস্টদের দখলে। দিন দিন তাদের বেপরোয়া চিকিৎসা বাণিজ্যে ফতুর হচ্ছে রোগীরা। ভুয়া ফিজিওথেরাপিস্টদের খপ্পরে পড়ে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে অনেক রোগীকে। প্রতিদিন নাটোরের ৭টি উপজেলায় প্রায় এক হাজার রোগী বিভিন্ন ফিজিওথেরাপি সেবা নেন। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে শহরের বিভিন্ন এলাকায় সাইনবোর্ডের মাধ্যমে চলছে অপচিকিৎসা। এরপরও এ ব্যাপারে কার্যকর তৎপরতা নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের নীতিমালা অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন স্বীকৃত কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি ডিগ্রিধারীরাই ফিজিওথেরাপিস্ট হিসেবে গণ্য হবেন। এছাড়া স্ব্যাস্থ অধিদপ্তর স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানে ফিজিওথেরাপির উপর ৩ বছর মেয়াদি ডিপ্লোামা ইন হেলথ টেকনোলজি কোর্স চালু আছে। ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী এ হেলথ টেকনোলজিস্টরা ফিজিওথেরাপিস্টদের সহকারী হিসেবে কাজ করার কথা বলা থাকলেও নাটোরে বিপরীত চিত্র বিদ্যমান। এখানে ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী এসব হেলথ টেকনোলজিস্টরা ফিজিওথেরাপিস্ট পদবী লিখে ভুয়া সাইনবোর্ডে চালাচ্ছে রমরমা প্রতারণা বাণিজ্য।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, নাটোরে বর্তমানে রেজিস্টার্ড ৪ জন বিপিটি (ব্যাচেলর অব ফিজিওথেরাপি) ডিগ্রিধারী ফিজিওথেরাপিস্ট রয়েছেন। তারা হলেন- কেয়া ফিজিওথেরাপি সেন্টারের শিমুল হোসেন, প্রতিবন্ধী উন্নয়ন সংস্থার ভক্ত প্রসাদ সাহা এবং কমফোর্ট ফিজিওথেরাপি সেন্টারের মিজানুর রহমান ও মাহফুজুর রহমান। অথচ সারা জেলায় অর্ধ শতাধিক প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে শুধু টেকনিশিয়ান ও টেকনিশিয়ানদের সহকারী দিয়ে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাটোর ষ্ট্রোক সেন্টার, নাটোর ফিজিওথেরাপি এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার এবং রিলাক্স ফিজিওথেরাপি সেন্টার।
নাটোর ষ্ট্রোক সেন্টারে গত দুই যুগের বেশি সময় ধরে কোন প্রকার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকার পরও ফিজিওথেরাপিষ্ট হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিয়ে রমরমা প্রতারণা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে রবিউল আলম মুহিত। এখানে প্রথম সাক্ষাতে রোগীকে দিতে হয় তিনশ টাকা ও দ্বিতীয় সাক্ষাতে দিতে হয় রোগী প্রতি দুইশ।
কমিউনিটি ষ্ট্রোক ফাউন্ডেশন নামে ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানের রেজিস্টার্ড ফিজিওথেরাপিষ্ট হিসেবে পরিচয় দিলেও তিনি কোন কাগজ দেখাতে পারেননি। রবিউল ইসলাম মুহিত জানান, তাঁর মেয়ে এবং শ্যালিকা দুইজন ফিজিওথেরাপিতে বিপিএড করেছে। তারা ঢাকায় থাকেন ও মাঝে মাঝে নাটোর এসে এখানে বসে চিকিৎসা দেন।
শহরের মাদ্রাসা মোড়ে রিলাক্স ফিজিওথেরাপির সেন্টারে গিয়ে দেখা যায় , একই ঘরের ঘিঞ্জি পরিবেশে রোগীদের ফিজিওথেরাপি দিচ্ছেন নাছির উদ্দীন নামের এক যুবক। নাছির জানান, তিনি কোনো ডিগ্রিধারী ফিজিওথেরাপিস্ট না। তিনি একজন ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী এ হেলথ টেকনোলজিস্ট বা টেকনেশিয়ান। রোগী প্রতি তিনি দুশ টাকা নিয়ে থাকেন। আর সেই দুশ টাকা থেকে একশ টাকা দিতে হয় অর্থপেডিক্সের ডাক্তারদের।
একই অবস্থা শহরের স্টেশন বাজার এলাকার নাটোর ফিজিওথেরাপি এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারের। প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা ও ফিজিওথেরাপি দিচ্ছেন আব্বাস আলী। তিনি ফিজিওথেরাপি টেকনিশিয়ান হলেও বিশাল সাইনবোর্ডে নিজেকে ফিজিওথেরাপিষ্ট আব্বাস আলী বলে পরিচয় দিয়েছেন। এখানে রোগী প্রতি আদায় করা হচ্ছে দুইশ টাকা করে। তবে এখানে গিয়ে আব্বাস আলী কে পাওয়া যায়নি। আকাশের সাথে কথা হলে তিনি জানান, তিনি কোনো ডিগ্রিধারী ফিজিওথেরাপিস্ট না। আব্বাস আলী বাহিরে থাকায় অবর্তমানে তিনি এই প্রতিষ্ঠানে ফিজিওথেরাপি করাচ্ছেন। তিনি কলেজ ছাত্র ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ পেশার সাবেক একজন জানান, এসব প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নিতে আসে সাধারণত গ্রামের রোগীরা। চিকিৎসা নিতে এসে অপচিকিৎসার শিকার হয়েও মুখ বন্ধ বরে চলে যায় এসব প্রতিষ্ঠানের পেটোয়া ক্যাডার বাহিনীর ভয়ে। স্থানীয় বখাটে ও চাঁদাবাজদের সাথে তাদের মাসিক চুক্তি থাকে। কোন রোগী অপচিকিৎসার অভিযোগ করতে চাইলে তাকে দমিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করে তারা। তাছাড়া নিকট অতীতে এসব প্রতিষ্ঠানে প্রশাসনের কোন অভিযান চালানো হয়নি। তাই প্রকাশ্যেই এসব অপচিকিৎসা কার্যক্রম চালাচ্ছে নামধারী এসব ফিজিওথেরাপিস্টরা। পাশাপাশি দালালের মাধ্যমে স্বল্প সময় ও অল্প টাকায় রোগীদের ভালো করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এ প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে। এতে রোগী তো সুস্থ হচ্ছেই না, উল্টো অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
কমফোর্ট ফিজিওথেরাপি সেন্টারের থেরাপিস্ট মিজানুর রহমান বলেন, ব্যাঙ্গের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ফিজিওথেরাপি সেন্টারগুলো প্রতারণা ছাড়া রোগীদের আর কিছুই দিতে পারছে না। সেবাটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর তাই এক্ষেত্র প্রশাসনের নজরদারী বাড়ানো উচিত।
কেয়া ফিজিওথেরাপি সেন্টারের থেরাপিস্ট শিমুল হোসেন বলেন, বিপিটি ডিগ্রিধারী থেরাপিস্টরাই নাটোরে কোণঠাঁসা। ভূয়া ফিজিওথেরাপিস্টদের সংখ্য এখানে এতো বেড়ে গেছে যে মানুষ প্রকৃত সেবা নিতে আসতেই পারে না।
এ ব্যাপারে নাটোরের সিভিল সার্জন ডা: আজিজুল ইসলামের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি এসব ফিজিওথেরাপি সেন্টার সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন।