নাটোর: ছিলেন সাবেক এক বন কর্মকর্তা। অবসরে গেছেন দেড় বছর। সেই সুবাদেই ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে নিজ এলাকার অসহায় মানুষদের ভূমিহীন করতে চালিয়েছেন নজিরবিহীন হয়রানি, করেছেন একাধিক মামলা। নিজ এলাকায় তিনি এক বিরাট দখল সাম্রাজ্যের অধিপতি। এলাকাবাসীর কাছে দস্যু হিসেবে পরিচিত তিনি। তার দস্যুপনা থেকে রেহায় পাননি নিজ বোনও। প্রশ্ন করলে সেই বনকর্তা উত্তর দেন, তার সবকিছুই হান্ড্রেড পার্সেন্ট ঠিক।
নাটোর সদর উপজেলার দিঘাপতিয়া ইউনিয়নের ভাতুরিয়া গ্রামের নুরুন্নবী মৃধার এমন দস্যুপনায় ক্ষোভে ফুসছে স্থানীয় লেকাজন। ভূমি দস্যু হিসেবে পরিচিত সাবেক এই বনকর্তা জুলুম-নির্যাতন, হয়রানির উদ্দেশ্যে সাত বছর ধরে দায়ের করা মিথ্যা মামলার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে বিক্ষুদ্ধ মানুষ। শনিবার সকালে সদর উপজেলার ভাতুরিয়া বাজারে সরকারি হর্টিকালচার সেন্টারের সামনে কয়েকশ নারী-পুরুষসহ সর্বস্তরের মানুষ তার বিরুদ্ধে মানববন্ধনে অংশ নেয়। এমন জুলুম নির্যাতনের প্রতিকার চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন তারা।
ভুক্তভোগী এসব মানুষের অভিযোগ, সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও বনকর্তা নূরুন্নবী মৃধা কৌশলে ভূমি দখল, জোরপূর্বক স্বল্প মূল্যে জমি ক্রয়, প্রাচীর দিয়ে এলাকার মানুষের চলাচলের পথ বন্ধ করে দেয়া সহ নানা ভাবে হয়রানি করে চলেছেন। কেউ এর প্রতিবাদ করলে মামলা দিয়ে তাকে হয়রানি করছেন। ৯ বছরের শিশু থেকে শুরু করে মৃত ব্যক্তিরাও তার মিথ্যা অভিযোগ থেকে রক্ষা পাননি।
সাবেক এই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনীত এমন গুরুতর অভিযোগে যাচাইয়ে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, অন্যের জমি দখল করে দেয়াল তৈরী ও পুকুর খননের করেছেন নুরুন্নবী মৃধা। দেয়াল তৈরী করে বন্ধ করে দিয়েছেন যুগ যুগ ধরে চলে আসা মানুষ চলাচলের রাস্তা। এখন সেখানে টানানো হয়েছে চলাচল নিষেধ সম্বলিত সাইনবোর্ড। এছাড়া জমির চারপাশে দেয়াল তুলে দেয়ায় জমিতে যাতায়াত করতে পারেন না স্থানীয়রা। এসব জমি জোরপূর্বক কিনে নিতেই ওই সাবেক কর্মকর্তার এমন কৌশল। এছাড়া সরকারী খাস জমি দখলেরও অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।
গ্রামের বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে নির্যাতন, মামলা আর হয়রানির কথা উঠে এসেছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন অভিযুক্ত সাবেক বন কর্মকর্তা।
কৃষি সম্প্রসরারণ অধিদপ্তরের কর্মরত পিওন ও একই গ্রামের আসির আলীর ছেলে আব্দুল হাকিম বলেন, আমার জমি কেনার জন্য তিনি উঠেপড়ে লেগেছেন নুরুন্নবী মৃধা। আমি জমি বিক্রি না করায় তিনি আমার অফিসে গিয়ে আমাকে বদলি করার জন্য বার বার অফিসে গিয়ে তদবির করেছেন। সব সময় তিনি আমাকে ফোন দিয়ে ভয়ভীতি দেখান করেন। জমি বিক্রি করলে তিনি আর কোন কিছু করবেন না বলে জানান।
গ্রামের মৃত আকালু সরকারের ছেলে শহিদুল ইসলাম বলেন, নুরুন্নবী মৃধা আমাদের বাড়ির পেছনের কৃষি জমি কিনে নিয়ে তাতে চারপাশে দেয়াল তুলে দিয়েছেন। আমরা বংশানুক্রমে সেই জমির আইল দিয়ে চলাফেরা করতাম কৃষি ফসল মাঠ থেকে তুলতাম এখন তা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। পানি চলাচল করতে না পেরে বাড়ির উঠানেও পানি উঠে জমে থাকে।
মৃত ইয়াদ আলীর ছেলে হানিফ পরিবহনের বাস চালক সাইদুর রহমান বলেন, ওই সাবেক সচিব গ্রামের বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে অতিরিক্ত দাম দিয়ে অংশীদারদের দু এক শতক জায়গা কিনে পরে নানা ভাবে হয়রানী করে পাশে শরীকদের পুরো জমি বিক্রি করতে বাধ্য করেন। জমি বিক্রি না করলে তিনি মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেন। তার জমির পেছনে জায়গা কিনে নিয়ে নুরুন্নবী মৃধা অতিরিক্ত জায়গা দখল করেছেন তার বাশ বাগানের বাঁশ কেটে নিয়েছে।
স্থানীয় শরিফুল ইসলামের স্ত্রী শাহিদা বেগম জানান, নুরুন্নবী মৃধা তার বাড়ির পাশে ঘর তুলে চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। প্রতিবাদ করায় তার বিরুদ্ধে তিনটি মিথ্যা মামলা করা হয়েছে। গরীব মানুষ প্রতিনিয়ত আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে এখন তাদের জীবন নির্বাহ করা দূর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এছাড়া বাড়ির পাশে নূরুন্নবীর জমিতে মুরগি তাড়াতে গেলে তার শিশু মেয়ে শরিফাকে হাসুয়া নিয়ে তাড়ায় নুরুন্নবী মৃধার লেবাররা। এছাড়া ওই শিশু কন্যার বিরুদ্ধেও থানায় জিডি করা হয়েছে।
মৃত কাজিম উদ্দিনের মেয়ে চম্পা খাতুন বলেন, এক সময় তারা জ্বালানি হিসাবে বাগানের পাতা খড়ি কুড়িয়ে রান্না বান্না করতেন কিন্তু এখন নুরুন্নবী মৃধা জায়গা কেনার পর তিনি কাউকে বাগানে প্রবেশ করতে দেন না। বাগান থেকে পাতা কুড়ানোর কারণে চম্পাকে পুলিশ দিয়ে ধরে নিয়ে জেল খাটানো হয়েছে বলে জানান তিনি।
গ্রামের বাসিন্দা আবুল কালাম আজাদের ছেলে মাসুদ রানা বলেন, বিভিন্ন স্থানে দেয়াল তুলে দেয়ায় পুরো এলাকা জলমগ্ন হয়ে থাকে। স্বাচ্ছন্দে চলাচলের কোন সুযোগ নেই। এছাড়া তার কথামত না চললে দেয়া হয় মামলা।
সমাজ সেবা কার্যালয়ে কর্মরত কামাল জানান, সে অফিসের কাজে কর্মস্থলে থাকার পরও তার বিরুদ্ধে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করেছে ওই সাবেক অতিরিক্ত সচিব। তার পৈত্রিক সম্পতিতে ঘর করার সময় তাতে বাধা দেয় নূরুন্নবী মৃধা।
গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল খালেকের ছেলে জাহাঙ্গীর হোসেন তার জমিতে দাড়িয়ে ছিলেন। এসময় তিনি বলেন, তার জমি বিক্রি না করায় তার বিরুদ্ধে তিনটা মামলা করা হয়েছে। এর কারণ জানতে চাইলে সচিব তার কাছে জমি কিক্রি করলে মিথ্যা মামলা তুলে নেয়া হবে জানিয়েছে বলে জানায় জাহাঙ্গীর হোসেন।
সরকারী খাস জমিতে বাস করা মঞ্জুর স্ত্রী হাসনা জানান, তাদেরকে খাস জায়গা থেকে উচ্ছেদ করতে নানা ধরনের চক্রান্ত করছেন ওই সাবেক সচিব। তিনি হাসনার মৃত মা সহ তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন বলে জানান তিনি। ওই মামলায় তাকে নিয়মিত হাজিরা দিতে হয় আদালতে।
আব্দুল আজিজের ছেলে সজল আহমেদ বলেন, ওই বন কর্মকর্তার কাজ মানুষের জমিতে বাউন্ডারি দিয়ে তাকে জমি বিক্রি করতে বাধ্য করা। সে জানায় , নুরুন্নবী মুধা তারা মামা নূরুল ইসলামের বিশ বছর আগে কেনা মেহগনি বাগানের চারপাশে বেড়া ও দেয়াল তুলে দিয়ে যাতায়াত বন্ধ করে দিয়েছে। এছাড়া জমির পাশে গর্ত করে ড্রেন করে চলাচল বন্ধ করা হয়েছে।
মৃত বাছের মন্ডলের ছেলে দেছের আলী বলেন, ওই বন কর্মকর্তার ভাতিজা নাদিম মৃধা কৃষি জমিতে পুকুর কেটে মানুষের জমি ও বাড়িতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করেছে। প্রতিবাদ করলে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে।
নুরুন্নবী মৃধার নিজের ভাগিনা সামাদ পিন্টু জানান, তার মামা মুখে ভাল ভাল কথা বললেও আসলে সে দূর্নীতিবাজ। তিনি তার মায়ের জমি ভোগ দখল করছে। এছাড়া নানা উপকারের অজুহাতে পিন্টুর পরিবার থেকে ৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি।
এদিকে তার বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ অস্বিকার করেছেন নুরুন্নবী মৃধা। তিনি বলেন, তিনি অবসরে যাওয়ার পর এলাকার মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য এলাকায় একটা বোটানিক্যাল গার্ডেন করার জন্য কাজ করছেন। তিনি কাউকে হয়রানি বা নির্যাতন করেননি। গ্রামের মানুষই তার কাজে বাধা প্রদান করছে, হয়রানি করছে। আমার সবকিছুই হান্ড্রেড পার্সেন্ট ঠিক। তবে গ্রামের কোন মানুষ তার সাথে না থেকে কেনই বা বিপক্ষে অবস্থান নিলেন এমন প্রশ্নের কোন সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।