নাইমুর রহমান,লালপুর থেকে॥ একটি দিন বেশি জ্বালানোর জন্য যে বাড়িতে প্রতিদিন কম খরচ করা হতো কেরোসিন, গ্রামের সে বাড়িটি একদিনের জন্য হয়েছিলো লাল, হলুদ ও সবুজ বাতির আলোয় আলোকিত। বৃহষ্পতিবার গ্রামের সবচেয়ে অসহায় পরিবারটির প্রতিবন্ধী কন্যা ফারহানা খাতুনের বিয়ে হয়েছে। ফারহানার স্বামী রুবেল হোসেন সদর উপজেলার ফতেঙ্গাপাড়ার হাবিবুর রহমানের ছেলে রুবেল হোসেন। পেশায় সে একজন রাজমিস্ত্রী।
পরিসর ছোট হলেও আয়োজনের কমতি ছিলো না বিয়েতে। এলাকার কয়েকশ’ মানুষ বৃহষ্পতিবার দুপুরে বিয়ের খাবার খেয়েছেন। এ বিয়েতে এসেছিলেন লালপুর থানার অফিসার ইনচার্জ নজরুল ইসলামসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। এর আগে রীতি মেনে গত বুধবার সন্ধ্যায় ফারহানার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান হয়েছে।
প্রতিবেশীরা জানান, ফারহানা জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধী। অসহায় এ পরিবারটির পাশে দাঁড়িয়েছেন পাশ্ববর্তী বড়াইগ্রাম উপজেলার ইলেকট্রিক্স পণ্য ব্যবসায়ী রুহুল আমিন রুবেল। তিনিই কন্যাদায়গ্রস্ত এ পরিবারের একজন হয়ে ফারহানার বিয়ের ব্যবস্থা করেন।
প্রতিবন্ধী ফারহানা খাতুনের বাড়ি নাটোরের লালপুর উপজেলার পূর্ব শাহপাড়া। তার বাবা ফজলুর রহমান পাঁচ বছর আগে মারা যান। সংসারে রয়েছে মা জরিনা বেওয়া আর ছোটভাই ফয়সাল হোসেন। ভাই ফয়সালও শারীরিক প্রতিবন্ধী। সে স্থানীয় ওয়ালিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র। আর ফারহানা এসএসসি পাশ করেছেন তিন বছর আগে। তাদের বাবার মৃত্যুর পর মা জরিনা বেওয়া অন্যের বাড়িতে কাজ করে দুই তাদের বড় করেছেন। তাদের পরিবারটি পুরো এলাকায় একটি অসহায় পরিবার হিসেবে পরিচিত।
দীর্ঘদিন ধরে তাদের দৈনন্দিন কষ্টের জীবনযাপনে সাধ্যমতো প্রতিবেশীরা এগিয়ে এলেও বিয়ের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানের ছিলো কল্পনারও বাইরে। বাড়িতে বিহাহযোগ্যা কন্যা আছে জেনে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান মাস্টার ফারহানার বিয়ের ব্যবস্থার চেষ্টা করেন। তিনি স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অসহায় পরিবারটির ব্যাপারে জানালে এগিয়ে আসেন স্থানীয় ওয়ালিয়া বাজারের ইলেকট্রনিক্স পণ্যের ব্যবসায়ী রুহুল আমিন রুবেল। তিনি পাত্র দেখা থেকে শুরু করে বিয়ে পর্যন্ত সমস্ত খরচ বহন করে সংসার গড়ে দিলেন প্রতিবন্ধী ফারহানাকে।
বৃহষ্পতিবার দুপুরে লালপুরের ওয়ালিয়ায় ফারহানার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার পাশে ফাঁকা জায়গায় ত্রিপল টানিয়ে আয়োজন করা হয়েছে মধ্যাহ্নভোজের। সেখানে খাবার খাচ্ছেন আমন্ত্রিত অতিথিরা। খাবারের মেনুতে ছিলো পোলাও, মুরগীর রোস্ট, গরু ও খাসির মাংস, ডাল, ডিম, দই ও মিষ্টি। একজন প্রতিবন্ধী মেয়ের বিয়ের এমন আয়োজনে খুশি এলাকার মানুষ। তারা জানান, কন্যাদায়গ্রস্ত একটি পরিবারটিকে কন্যাদায় থেকে মুক্ত করে বড় হৃদয়ের পরিচয় দিয়েছেন ব্যবসায়ী রুহুল আমিন রুবেল।
অশ্রুসজল চোখে প্রতিবন্ধী জরিনা বেওয়া বলেন, ‘মানুষের বাড়িতে কাজ করে কোনরকমে দিনটা চলে আমাদের। মেয়েটার বিয়ে দেয়ার কথা কোনদিন ভাবিনি। রুহুল আমিন রুবেল আজ আমার ছেলের দায়িত্ব পালন করেছেন। যতদিন বেঁচে থাকবো, দোয়া করে যাবো আমার আরেক সন্তান রুহুল আমিনের জন্য।
বর রুবেল হোসেন বলেন, ‘আমি ফারহানার ব্যাপারে জেনেই তাকে বিয়ে করছি। তাকে পছন্দও হয়েছে আমার। আজ থেকে আমার ছায়াও থাকবে এই অসহায় পরিবারটির উপর।’
ব্যবসায়ী রুহুল আমিন রুবেল বলেন, ‘মানুষকে খুশি দেখতে ভালো লাগে। ২০০৫ সালে ক্যান্সারে আমার মা মারা যাবার পর থেকে আমি বিপদগ্রস্ত ও অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াই। তাদের মুখে হাসি ফুটলেই আমি খুশি। যতদিন বেঁচে থাকবো অসহায় মানুষদের জন্য কাজ করবো। আমি চাই আমার দেখাদেখি বিত্তবানরা অসহায় মানুষদের পাশে এসে দাঁড়াক।’
স্থানীয় ইউনয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে বসবাসরত অসহায় এ পরিবারটির পাশে সাধ্যমতো দাঁড়ানোর চেষ্টা করি আমরা। এরই ধারাবহিকতায় প্রতিব›দ্ধী বিবাহযোগ্যা কন্যার বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে স্থানীয় ব্যবসায়ী রুহুল আমিন রুবেল পরিবারটির পাশে এসে দাঁড়ান এবং বিয়ের সমস্ত খরচ নিজে বহন করেন। ওয়ালিয়ায় এ বিয়ে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকলো। সামর্থ্যবানদের উচিত অসহায় মানুষদের পাশে এস দাঁড়ানো।’