॥সিনিয়র করেসপনডেন্ট, জাগোনাটোর২৪ডটকম॥
বারনই নদী তীরে গড়ে ওঠা নাটোরের নলডাঙ্গার হাট রেল স্টেশন এক সময় ছিল মাদকসেবীদের অভয়াশ্রম। স্টেশন প্লাটফরম সহ আশেপাশের এলাকা ছিল মাদক বিক্রেতা ও সেবীদের নিরাপদ চারণভূমি। স্টেশন ঘিরেই ছিল গাঁজারুদের। এছাড়া আড্ডা বসতো ফেনসিডিল,হেরোইন সহ অন্যান্য মাদকসেবী ও জুয়ারুদের। নদী ও রেল পথে আসত এসব মাদক। প্রকাশ্যে এসব মাদক বেচা কেনা সহ সেবনের আড্ডা বসতো। যাত্রিসহ পথচারীদের নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। বিশেষ করে স্কুল কলেজের ছাত্রীদের বিড়ম্বনা সহ বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে। রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙ্গিয়ে এসব মাদক সেবী ও ব্যবসায়ী দাপট দেখিয়ে চলতো । হুমকির কারনে মাদকসেবীদের দৌরত্মে নিশ্চুপ থাকতে হয়েছে স্থানীয়দের। স্টেশন সংলগ্ন বসতিরা আতংকে দিন কাটাতেন। মাদকসেবীদের অত্যাচারে অনেকেই অন্যত্র চলে গেছেন।
২০১৩ সালে নলডাঙ্গার হাট উপজেলায় রুপান্তরিত হওয়ার পর পাল্টাতে থাকে পরিবেশ। পুলিশসহ স্থানীয় প্রশাসনের অভিযানের পাশাপাশি এলাকাবাসী মাদকসেবীদের উচ্ছেদে মাঠে নামে।
মামুনর রশীদ নামে স্থানীয় এক গণমাধ্যম কর্মীর উদ্যোগে গড়ে তোলা হয় সামাজিক আন্দোলন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দসহ সমাজ কর্মীরা এগিয়ে আসেন। সম্প্রতি মাদক উচ্ছেদে সরকারের জিরো টলারেন্স কর্মসুচী বাস্তবায়নে পুলিশ সহ বিভিন্ন আইন শৃংখলা বাহিনী নলডাঙ্গাসহ জেলাব্যাপী সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে। নলডাঙ্গা থানা পুলিশ সহ উপজেলা প্রশাসন নলডাঙ্গাকে মাদকমুক্ত ঘোষণা করলে এলাকাবাসীও নলডাঙ্গা স্টেশনকে মাদকমুক্ত করতে মাঠে নামে। সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় নলডাঙ্গার হাট রেল স্টেশনকে মাদকমুক্ত করে। সেই সাথে স্টেশন এলাকাকে পরিচ্ছন্ন এলাকা হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ শুরু করেন। নিজেরাই রেলের জরাজীর্ণ ভবনসহ রেল স্টেশনকে নতুন করে রং তুলির আঁচর দিয়ে সাজিয়ে তোলেন। এছাড়া মাদক সেবীদের আড্ডাস্থলে বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছেন। ওই বিনোদন কেন্দ্রে এখন প্রতিদিন সব বয়সের মানুষ এসে অবসর সময় কাটাচ্ছেন। নির্মল আনন্দ নিয়ে সময় কাটাতে বিভিন্ শ্রেণী পেশার মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে এই বিনোদন কেন্দ্রে আসেন। অবসর সময় কাটানোর জন্য বসার আসন সহ শিশুদের বিনোদন ব্যবস্থা করা হয়েছে। রেলের পরিত্যাক্ত লাইন ও স্লাব দিয়ে এসব বসার আসন বানানো হয়েছে। শিশুদের জন্য বানানো হয়েছে দোলনা। স্টেশন সংলগ্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা এখন এই বিনোদন কেন্দ্রে এসে নির্ভয়ে সময় কাটায়। এক সময়ের মাদক সেবীদের এই অভয়াশ্রমটি বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলায় তরুন তরুনীরাও এখানে এসে ভীড় করছেন। এছাড়া স্থানীয়দের উদ্যোগেই রেল স্টেশন প্লাট ফরমে যাত্রিদের বসার জন্য বসানো হয়ে চেয়ার। রেল কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে স্থানীয় উদ্যোক্তারাই এসব খরচ বহন করেছেন। স্টেশনের চারিদিকে যেমন বসার আসন বসানো হয়েছে। তেমন নির্মল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য রোপণ করা হয়েছে নানা প্রজাতির বনজ ও ফুল গাছ। এগুলোর পরিচর্যা করছেন মাদক ছেড়ে সুস্থ জীবন যাপনে অঙ্গিকারবদ্ধ হওয়া দুই মাদক সেবী। তারা স্বোচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে ওই বিনোদন কেন্দ্রের নিরাপত্তা সহ পরিচর্যা করনে।
মাদক ছেড়ে সুস্থ জীবনে ফিরে আসা বেলাল উদ্দিন জানান, মাদকের ছোবলে তিনি সব কিছু হারিয়েছেন। মাদক সব নিঃস্ব করে দেয় বুঝতে পেরে তিনি মাদকের নেশা ত্যাগ করেছেন। এখন গাছ গাছালিকে বন্ধু বানিয়ে সুস্থ্য জীবন কাটাতে চাই।
স্থানীয় বাসিন্দা ফরিদ হোসেন ও কোরবান আলী জানান, ক’মাস আগেও মাদকসেবীদের দাপটে আতংকে থেকেছেন পরিবার নিয়ে। মাদকের গন্ধে বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল এখানকার বাতাস। এখন তাদের উচ্ছেদ করায় মুক্ত বাতাস গ্রহণ করতে পারছি।
স্কুল ছাত্রী বর্ষা খাতুন জানায়, ‘আগে এই পথে যেতে ভয় পেতাম। এখন এখানে স্বাচ্ছন্দে সময় কাটানো যায়। দোলনা খেতে এখানে প্রায় আসি।’
কলেজ ছাত্রী সানজিদা আক্তার বলেন, একসময় ভিতিকর পরিবেশ ছিল রেল স্টেশনটি। মাদক সেবীদের ভয়ে একা একা চলা যেতনা। এখন বেশ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। স্টেশনে যাত্রিদের জন্য চেয়ার বসানো হয়েছে। গাছগুলি রং করে সুন্দর পরিবেশ করা হয়েছে। স্টেশন সংলগ্ন মাদকের আড্ডাস্থলে বানানো হয়েছে বিনোদন কেন্দ্র। এখন এখানে নানা বয়সের মানুষ ভীড় করে।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মাগরেব আলী বলেন, নবগঠিত এই উপজেলায় বদলী হয়ে আসার পর অবসর সময় কাটানোর কোন জায়গা ছিলনা। রেল স্টেশন সংলগ্ন গড়ে তোলা বিনোদন কেন্দ্রটিতে এসে এখন বেশ সময় কাটে। শুনেছি এক সময় এই এলাকা মাদকের স্বর্গরাজ্য ছিল। এখন দেখে তা মনে হয়না। স্টেশনটি ছোট হলেও বেশ পরিচ্ছন্ন করে সাজানো হয়েছে। স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মী মামুনুর রশীদের উদ্যোগে এলাকার বিশিষ্টজন সহ সব শ্রেণীর মানুষ নলডাঙ্গার হাট স্টেশনকে জঞ্জালমুক্ত করেছেন।
উপজেলা নির্বাচন অফিসার আবুল কালাম আজাদ বলেন, এখন রাত বিরাতেও স্টেশন এলাকার পরিবেশ বেশ ভাল। বিনোদন কেন্দ্র হওয়ায় অবসর সময় কাটানোর সমস্যা নেই এখন।
ব্যবসায়ী আক্তারুজ্জামান, নাসির উদ্দিন ও আবেদ আলী জানান,সকলের প্রচেষ্টায় নলডাঙ্গারহাট রেলওয়ে স্টেশনকে মাদকমুক্ত এলাকা করা হয়েছে। স্টেশনকে নতুন করে সাজিয়ে তুলতে সকলেই সহায়তা করেছেন। কেউ গাছ গাছালি দিয়ে কেউ অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছেন। প্রত্যেকেই একবার হলেও স্টেশনে আসেন।
স্টেশন মাস্টার দেবব্রত বলেছেন, এক সময় স্টেশনটি অপরিচ্ছন্ন ছিল। এখন সকলের সহযোগীতায় বেশ সুন্দর হয়েছে। রেল কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েই স্থানীয়রা স্টেশনটিকে সুন্দর করে সাজিয়েছেন। যাত্রিদের বসার চেয়ারও সরবরাহ করেছেন এলাকাবাসী। পরিত্যাক্ত স্লাব দিয়েও তৈরি করা হয়েছে বসার আসন। এছাড়া প্রশাসনের সহযোগিতায় স্টেশনটি মাদক মুক্ত এলাকা করা হয়েছে।
সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, সকলের ইচ্ছায় নলডাঙ্গার হাট স্টেশনকে মাদকমুক্ত করার পাশাপাশি একটি বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। স্টেশন এলাকা এখন নির্মল পরিবেশ বিরাজ করছে।এখন গোটা উপজেলাকে মাদক মুক্ত করার অভিযান চলছে।
নলডাঙ্গা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নুর মোহম্মদ খন্দকার বলেন, তিনি সদ্য এই কর্মস্থলে যোগ দিয়েছেন। শুনেছেন নলডাঙ্গা থানার পুলিশ এই স্টেশনকে মাদকমুক্ত করা সহ গোটা উপজেলাকে মাদকমুক্ত করতে অভিযান চালাচ্ছে। স্থানীয়দের সহায়তায় নলডাঙ্গার হাট এখন মাদকমুক্ত। সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে বিনোদন কেন্দ্র।
এই বিনোদন কেন্দ্রের উদ্যোক্তা স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মী মামুনুর রশীদ বলেন, আগে নলডাঙ্গা এলাকায় সুস্থ বিনোদনের কোন পরিবেশ ছিলনা। এছাড়া বারনই নদী তীরে সুন্দর পরিবেশে গড়ে ওঠা নলডাঙ্গার হাট স্টেশনটি ছিল মাদকসেবীদের অভয়াশ্রম ও জঞ্জালে ভরা। সুস্থ থাকার পরিবেশ সৃষ্টি করতেই তিনি স্থানীয় ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক ব্যক্তি ,জনপ্রতিনিধি, পুলিশ,সরকারী কর্ম ও শিক্ষক সহ বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণীর মানুষকে নিয়ে কাজ করেছেন। সকলের সহযোগীতা নিয়ে নলডাঙ্গার হাট স্টেশনকে মাদকমুক্ত করে সুস্থ্য পরিবেশ ফিরিয়ে এনেছেন। এই সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখার জন্য মাদকসেবীদের আড্ডাস্থলে গড়ে তোলা হয়েছে একটি বিনোদন কেন্দ্র। এই কেন্দ্র তৈরি করা সহ রেল স্টেশনকে নতুন করে সাজাতে সকলেই সহায়তা করেছেন। রেলের পরিত্যাক্ত রেল ও স্লাব দিয়ে যাত্রিদের বসার জায়গা করে দেওয়া হয়েছ্ েএছাড়া প্লাট ফরমে যাত্রিদের বসার জন্য নতুন চেয়ার দেওয়া হয়েছে। জরাজীর্ণ ভবন ও স্টেশনের গাছগাছালি পরিস্কতার পরিচ্ছন্ন করে রং করা হয়েছে। এজন্য কেউ রং দিয়েছেন, কেউ বাঁশ,কাঠ,চেয়ার,গাছ -গাছালি বা কেউ অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছেন। এই কেন্দ্রে শিশুদের জন্য দোলনা লাগানো হয়েছে। যে যেভাবে পারছেন তা দিয়েই সাহায্য করছেন। নলডাঙ্গা উপজেলায় বিনোদনের কোন জায়গা না থাকায় এখন সাবাই পরিবার পরিজন নিয়ে মাদকমুক্ত এই বিনোদন কেন্দ্রে আসেন নির্মল আনন্দের জন্য। এখন স্থানীয়রাই স্টেশনের সুষ্ঠ পরিবেশ বজায় রাখার চেষ্টা করেন। নলডাঙ্গাকে মাদকমুক্ত সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখতে এলাকাবাসী এখন ঐক্যবদ্ধ।
নলডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মু. রেজা হাসান বলেন,স্থানীয়দের এই মহৎ উদ্যোগ প্রশংসার দাবী থাকে। উপজেলা প্রশাসন থেকেও উদ্যোক্তাদের সার্বিক সহযোগীতা করা হচ্ছে। অনেকেই এখন ওই বিনোদন কেন্দ্রে গিয়ে সময় কাটাতে পারেন। এছাড়া নলডাঙ্গাকে মাদকমুক্ত রাখতে প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে।