নবীউর রহমান পিপলু ও নাইমুর রহমান,গণভবন ঘুরে॥
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাঞ্চলীয় বাসভবন নাটোরের উত্তরা গণভবনের পর্যটন সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এর ভেতর ও বাহিরে নতুন প্রতিষ্ঠান স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে জেলা প্রশাসন। প্রাথমিকভাবে এ কাজের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৫ কোটি টাকা। এছাড়া উত্তরা গণভবনের ভেতরে ৫৪ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি থ্রি-ডি কর্ণার নির্মাণেরও তোরজোড় শুরু হয়েছে। জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটে নাটোর জেলাকে নিয়ে তিন বছর মেয়াদী একটি পরিকল্পনায় পর্যটন ব্যবস্থার আধুনিকায়নে এ পদক্ষেপের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এ নিয়ে নাটোরজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি পাস না হলেও রাজশাহীর একজন ব্যক্তিকে আংশিক কাজের জন্য প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত করা হয়েছে। পর্যটন সুবিধা বৃদ্ধির নামে বিখ্যাত রাজা দয়ারাম রায়ের শাসনামল, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক এ স্থাপনায় নতুন ভবন নির্মাণ হলে কয়েকশত বছরের ঐতিহ্যের বুকে কুঠারাঘাত করা হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ কাশ করেছে স্থানীয় সুধীমহল। তবে জেলা প্রশাসনের দাবী, প্রস্তাব আকারে পাঠানো এ সংক্রান্ত প্রকল্পটি পাস হলে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কোন বিকৃতি হবে না।
নাটোর জেলা প্রশাসনের নেজারত ডেপুটি কালেক্টর(এনডিসি) অনিন্দ্য মন্ডল জাগোনাটোর২৪ ডটকমকেজানান, ভেতরে ও বাইরে মিলিয়ে উত্তরা গণভবনের জায়গার পরিমাণ ৪৪.৩৯ একর। এর মধ্যে ভেতরে ৪১.৫০ একর ও বাইরে ২.৮৯ একর। গণভবনের সৌন্দর্য্যবর্ধন ও লাভজনকতা বিবেচনায় বেশ কিছু সংস্কারসহ একটি থ্রি-ডি কর্ণার স্থাপনের প্রস্তাব সম্বলিত একটি প্রকল্প তৈরী করে ৬৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে যেখানে ভেতরের প্রাক্কলিত ব্যয় প্রায় ৩৪ কোটি ও বাইরে ৩১ কোটি টাকা। ভেতরে ও বাইরে মিলিয়ে থ্রি-ডি কর্ণার সিনেপ্লেক্স, মোটেল, শপিং কমপ্লেক্স, সুইমিং পুল, কালভার্ট, ওয়াকওয়ে, বোটিং, পুকুর পাড় বাঁধাই করে আগত দর্শনার্থীদের বিনোদনের যাবতীয় ব্যবস্থার পরিকল্পনা রয়েছে প্রস্তাবিত প্রকল্পে।
জানা যায়, ২০১৭ সালে গণপূর্ত বিভাগ থেকে গণভবনের কর্তৃত্ব নেয়ার পর মন্ত্রীপরিষদ সচিবকে আমন্ত্রণ জানিয়ে অধিকতর সংস্কার ও স্থাপনা নির্মাণের প্রস্তাব দেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প বিবেচনার জন্য পর্যটন মন্ত্রণালয়ে পৌছে। এ যাবৎকালে নাটোর জেলার সর্ববৃহৎ এ প্রকল্পটি সম্পর্কে অনেকটা অন্ধকারেই ছিলো নাটোরবাসী। তবে সম্প্রতি উত্তরা গণভবন ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় এর ভেতরে ৫৪ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি থ্রি-ডি সিনেপ্লেক্স নির্মাণের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হওয়ার খবরে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে সচেতন মহলে। জানা গেছে, জেলা প্রশাসনের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার নেকনজরে থাকা রাজশাহীর একজন ব্যক্তির পরিচিত একটি প্রতিষ্ঠানকে থ্রি-ডি সিনেপ্লেক্স নির্মাণের জন্য দায়িত্ব দেয়ার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। সেদিন ওই প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় এক প্রতিনিধিও সভায় উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও গণভবনের ভেতরে কফিহাউজ ও উইন্ডোশপ স্থাপনে আগ্রহী প্রশাসনঘনিষ্ট স্থানীয় ও জেলার বাইরের বেশ কয়েকজন ব্যক্তি গণভবন পরিদর্শনও করেছেন।
সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের উধ্বতন কর্মকর্তারাও উত্তরা গণভবনে যাতায়াত বাড়িয়েছেন। গণভবনের ভেতরে-বাইরে নতুন স্থাপনার নির্মাণ সরকারী না বেসরকারীভাবে নাকি যৌথ অংশীদারিত্বে (পিপিপি) হবে, পর্যটন মন্ত্রণালয় কর্তৃক সে ব্যাপারে কোন নির্দেশনা এমনকি প্রকল্পটি এখন পর্যন্ত পাস না হলেও স্থাপনা নির্মাণে জেলা প্রশাসনের এমন তৎপরতায় বিস্মিত অনেকেই। একইসাথে উত্তরা গণভবন ব্যবস্থাপনা কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত নাটোরের স্থানীয় ব্যক্তিদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
বুধবার উত্তরা গণভবনে গিয়ে মূলক ফটক পেরতেই দেখা যায় গণভবনের প্রস্তাবিত সংস্কার ও স্থাপনা নির্মাণের একটা নকশা বিলবোর্ড আকারে টানানো রয়েছে। নকশা অনুযায়ী, গণভবনের চার দিকে সংস্কারের পরিকল্পনা করা হয়েছে। সে অনুযায়ী, প্রস্তাবিত নকশার দক্ষিণদিকে একটি ওয়াচটাওয়ার, ফুট ওভারব্রীজ, পাথওয়ে, পাথওয়ে ল্যান্ডস্কেপ, গার্ডেন, ফোয়ারা, ভাসমান প্লাটফর্ম, পশ্চিমে দুইটি করে বিশ্রামাগার, বসার জায়গা ও সংস্কার করা ঘাট, উত্তরে পাথওয়ে, ফুটওভারব্রীজ ও ওয়াচটাওয়ার এবং পূর্বে পাবলিক টয়লেট, ওয়াটারবুথ, পাথওয়ে, বিশ্রামাগার ও বসার জায়গা। প্রস্তাবনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, মূল নকশার পরিবর্তন ঘটিয়েই স্থাপনা নির্মাণ করতে যাচ্ছে জেলা প্রশাসন।
নাটোরের প্রবীণ লোকজনদের মতে, সর্বশেষ উত্তরা গণভবনের মূল নকশায় পরিবর্তন আসে ১৯৬৫ সালে। তৎকালীন পূর্ত বিভাগের মাধ্যমে পাকিস্তান সরকার উত্তরা গণভবনের মূল ভবনের ছাদে একটি গম্বুজ স্থাপন করে যা এখনো অবিকৃত রয়েছে। ১৯৯৭ সালে দিঘাপতিয়া রাজবংশের সর্বশেষ উত্তরাধিকারী ভারতে বসবাসকারী বিমলেন্দুনাথ পূর্বপুরুষের জমিদারী দেখতে দিঘাপতিয়া আসেন। সেসময় উত্তরা গণভবনে এসে মূল নকশার বাইরে স্থাপিত গম্বুজ দেখেন তা অপসারণের অনুরোধ করলেও প্রশাসন তা রাখেনি। গণভবনের মূল নকশার অবিকৃত রাখার ব্যাপারে রাজাপত্তি মানা না হলেও কতিপয় ব্যক্তিকে লাভবান করার স্বার্থে প্রশাসন শতাব্দীপ্রাচীন এ স্থাপনায় অবকাঠামো নির্মাণ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আর নাটোরে ভালো হোটেল, মোটেল না থাকার সংকটকে পুঁজি করে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর চাহিদায় প্রভাবিত হয়ে নাটোরের ঐতিহ্যকে পাল্লায় তোলা হচ্ছে বলে মন্তব্য অনেকের।
দিঘাপতিয়ার রাজার রাজা দয়ারাম রায়ের কর্মচারী নঈমুদ্দীনের চতুর্থ বংশধর শহিদউদ্দিন আক্ষেপ করে বলেন, ‘তিনপুরুষ ধরে তারা দিঘাপতিয়া রাজ ঐতিহ্যের স্বাক্ষী। গর্ব আর জৌলুসের সেই রাজবাড়ীর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে সম্প্রতি উত্তরা গণভবনকে উন্মুক্ত করে। আর এখন গণভবনকে টার্গেট করে ব্যবসা করলে তা ইতিহাসের ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে। ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা ভেবে এমন সিদ্ধান্ত পুনঃবিবেচনার দাবি জানাচ্ছি।’
বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী এম আসলাম লিটন বলেন, ‘আমারা সর্বদা ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণের পক্ষে। তবে সংস্কারের নামে ইতিহাস-ঐতিহ্যের নান্দনিকতা ও ঐতিহাসিক গুরুত্বকে বিকৃত করা বা পরিবর্তন করা হলে তা গ্রহণযোগ্য হবেনা। এসব বিবেচনায় রেখে সংস্কার করা হোক।
নাটোর প্রেসক্লাবেক সাবেক সভাপতি বিশিষ্ট কলামিস্ট রেজাউল করিম খান বলেন, ‘উত্তরা গণভবনের আলাদা গুরুত্ব আছে রাষ্ট্রের কাছে। তাই এখানে পর্যটন স্পট না করাই ভালো। নতুন কোন পর্যটন সুবিধা বৃদ্ধি না করে শহরের অন্য কোন স্থানে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা যেতে পারে। এতে নাটোরবাসীর সুষম বিনোদন নিশ্চিত হবে। সর্বপোরি উত্তরা গণভবনকে ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষণ করতে হবে।’
জেলা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সিনিয়র আইনজীবী এডভোকেট সুশান্ত কুমার ঘোষ বলেন, ‘রাজ-রাজণ্যের ইতিহাসবেষ্টিত উত্তরা গণভবন সংস্কার হতে পারে তবে তা অবশ্যই ঐতিহাসিক গুরুত্ব অক্ষুণœ রেখে। এর বাইরে ন্যুনতম পরিবর্তন সাধিত হওয়া মানে মূল চেতনা থেকে দূরে সরে আসা। একজন আইনজীবী হিসেবে এমন বিকৃতি ঠেকাতে প্রয়োজনে আইনজীবী নেতাদের প্রতিবাদের কর্মসূচী দিতে আমরা অনুরোধ করবো।
নাটোরের কৃতি সন্তান বাংলা একাডেমি পুরস্পারপ্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক ডাঃ জাকির তালুদার বলেন, ‘উত্তরা গণভবন ব্যবসা করার জায়গা না। এখানে মানুষ আসে ইতিহাসের সংস্পর্শ পেতে। গণভবনকে ব্যবসা কেন্দ্র বানিয়ে ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা করলে নাটোরের মানুষ এমনকি দেশবাসী চুপ থাকবে না।’
জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রসাদ কুমার তালুকদার বাচ্চা বলেন, ‘উত্তরা গণভবন নাটোরবাসীর ভাবনা ও গর্বের জায়গা। তাছাড়া দেশের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন কোন পর্যটনকেন্দ্র হতে পারে না। ইতিহাসের অংশ এই শতাব্দীপ্রাচীন অবকাঠামোকে এক ইঞ্চি পরিবর্তন করলেও ইতিহাসকেই বিকৃত করা হবে। আমরা এটি হতে দেবো না। প্রয়োজনে আইনী লড়াইয়ে যাবো আমরা।’
জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মোর্ত্তোজা আলী বাবলু বলেন, ‘উত্তরা গণভবনের বাইরে সংস্কার বা নতুন স্থাপনা নির্মাণের ব্যাপারে বিভিন্ন সময় শুনলেও ভেতরে কি করা হবে তা জানি না। তবে যাই করা হোক, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিঘাপতিয়া রাজবাড়ীকে উত্তরা গণভবন হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন, এটা ভুলে যাওয়া চলবে না। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে এখন পর্যন্ত সরকারের কাছে উত্তরা গণভবন গুরুত্বপূর্ণ। উত্তরা গণভবন যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন সেটি মাথায় রেখেই নাটোরবাসীর আবেগকে সম্মান জানাতে হবে ।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শাহরিয়াজ বলেন, ‘নতুন প্রজন্মের চাহিদা বিবেচনায় উত্তরা গণভবনে পর্যটন সুবিধা বৃদ্ধির প্রকল্পটি তৎকালীন জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন তৈরী করে প্রেরণ করেছিলেন। প্রকল্পটি বর্তমানে আলোচনার পর্যায়ে আছে। এটি বাস্তবায়ন হলে ইতিহাস বা ঐতিহ্য ক্ষুন্ন হবে না।’