গুরুদাসপুর॥ নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার চারদিকে ছিল দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ। এখন সেই ফসলের মাঠে চলছে পুকুর খননের মহোৎসব। স্থানীয় সংসদ সদস্যের মাইকিংয়েও বন্ধ হচ্ছেনা পুকুর খনন। যেমন কমছে কৃষিজমি তেমনি পুকুর দীঘি আর জলাশয়ের কারণে উর্বর ফসলের মাঠে সৃষ্টি হচ্ছে স্থায়ী জলাবদ্ধতা। ফলে পুকুরের আশপাশের কৃষকরাও আবাদ করতে পারছে না।
স্থানীয় ও ক্ষুদ্র সেচ বিএডিসি অফিস সুত্রে জানা যায়, উপজেলাজুড়ে পুকুর খনন বন্ধে মাসিক সমন্বয় সভায় বেশ কয়েকবার সিদ্ধান্ত হয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের কৃষকরা পুকুর খনন বন্ধে মানববন্ধন করেছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য মো. আব্দুল কুদ্দুসের পক্ষ থেকেও এর বিরুদ্ধে মাইকিং করা হয়েছে। তাছাড়া স্থানীয় ও জাতীয় বিভিন্ন দৈনিকে এ বিষয়ে ফলাওভাবে সংবাদ ছাপা হয়েছে। বারবার জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষন করা হয়েছে। বিভিন্নভাবে অনুরোধ, আদেশ, মাইকিং করেও বন্ধ হচ্ছেনা পুকুর খনন। এতে আবাদি জমির সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার মশিন্দা চরপাড়া গ্রামের হবি মন্ডলের ১০ বিঘা জমিতে বাচ্চু মিঞা টাকার বিনিময়ে পুকুর খনন করছেন। একই ইউনিয়নের রাণীগ্রামের বিলকাঠোর মৌজায় মোজাহার মেম্বার, করিম, শফি, বকুল, সাইফুলদের ২৮ বিঘা কৃষিজমিতে পুকুর খননযজ্ঞ চলছে।
জমির মালিক সাবেক ইউপি সদস্য মোজাহার আলী বলেন, ধারাবারিষা ইউনিয়নের সার্জেন্ট মোস্তাক মোহন, ধারাবারিষা ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মতিনের ভাতিজা আওয়ামীলীগ নেতা মিল্টন ও আমির হোসেনের কাছ থেকে তারা বিঘা প্রতি ২০ হাজার করে টাকা পাচ্ছেন এবং বিনিময়ে ফ্রি পুকুরও উপহার পাচ্ছেন। আর কৃষিজমির মাটিগুলো যাচ্ছে বিভিন্ন ইটভাটায়।
আরেক জমির মালিক বকুল এ প্রসঙ্গে বলেন, পুকুর খনন করলে কিছুই হয় না। কত সাংবাদিক লেখালেখি করল তাতে কি এসব বন্ধ আছে? তবে মশিন্দার কৃষক ইকবাল হোসেন বলেন, গুরুদাসপুর পৌর এলাকার অবৈধ ইটভাটা বন্ধ হলে এলাকায় পুকুর খনন এমনিতেই কমে যাবে। কারণ, এসব সড়কপথে মাটিবহনকারী ট্রাক্টর, ট্রলির কোনো রুট পারমিট নেই। উপর্যুপুরি মাটিবহনকারী গাড়ি চলাচলে উপজেলার অধিকাংশ পাকা সড়কগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। এতে জমিও কমছে, রাস্তাও ভাঙছে।
গুরুদাসপুর পৌর সদরের চাঁচকৈড় মধ্যমপাড়ার সুইট সরকার ৪ বিঘা ও নাড়িবাড়ি এলাকায় আওয়ামীলীগ নেতা দুলাল এবং তার আত্মীয় দেসের আলী প্রায় ১৮ বিঘা ফসলী জমিতে দীর্ঘদিন ধরে পুকুর খনন করে আসছেন। নাটোর জেলা প্রশাসকের হস্তক্ষেপে চাপিলা ইউনিয়নে পুকুর খনন বন্ধ হলেও উপজেলার অন্যান্য স্থানে বন্ধ হচ্ছেনা। বরং আরও পুরোদমে দিন এবং রাতেও চলছে পুকুর খননের অস্বাভাবিক অনুশীলন।
মশিন্দা মাঝপাড়া বিশ^রোড সংলগ্ন ৬ বিঘা কৃষিজমিতে চাঁচকৈড় খোয়ারপাড়ার মৃত সাত্তার মোল্লার ছেলে সুরুজ (৩৬) মাটিকাটা যন্ত্র ভেকু দিয়ে পুকুর খনন করছেন। আবার বিয়াঘাট ইউনিয়নের জ্ঞানদানগর মৌজার ধলার বিলে খননযন্ত্র বসিয়ে পুকুর খনন করছেন বিয়াঘাট ইউপি সদস্য শীতল আলী। আর এসব কৃষিজমির চারদিকে চলছে ইরি-বোরো ধানের আবাদ।
এদিকে পুকুর খনন বন্ধে স্থানীয় আব্দুল খালেক, আহসানুল হক ও বদিউজ্জামান নামের তিন কৃষক পুকুর খনন বন্ধে জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। কৃষকরা বলেন, ক্ষেতের মাঝ বরাবর পুকুর খনন শেষ হলে ধানের আবাদ করতে পারবে না তারা। স্থানীয়ভাবে উপজেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ চেয়ে ব্যর্থ হয়ে জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করতে বাধ্য হয়েছেন তারা।
অধিকাংশ জমিতে প্রশাসনের বৈধ অনুমোদন না থাকলেও উপজেলা প্রশাসনের এক কর্মচারীর কাছ থেকে মৌখিক অনুমোদন নিয়েই এসব পুকুর খনন চলছে বলে পুকুর খনন সংশ্লিষ্টের অনেকেই জানিয়েছে। অপরদিকে মাটিবহনকারী গাড়িগুলো গুরুদাসপুর পৌরসভার আবাসিক এলাকা দিয়ে যাতায়াতের ফলে ধুলার কবলে পড়েছে মানুষ। ধুলার কবল থেকে মুক্ত পরিবেশে বসবাস করার জন্য পৌর কর্তৃপক্ষের প্রতি জোর দাবী জানিয়েছে ভুক্তভোগীরা। তাছাড়া পৌরসভার ময়লা বহনকারী গাড়ীগুলো এখন মাটি টানার কাজে নিয়োজিত আছে।
কৃষি জমিতে পুকুর খনন বন্ধে কার্যকরী আইন প্রনয়ণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন চলনবিল নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটির সভাপতি অধ্যাপক আত্হার হোসেন।
সিনিয়র গুরুদাসপুর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আলমগীর কবির জানান, মাছ চাষ বৃদ্ধির জন্য গুরুদাসপুর-নাটোর তথা বাংলাদেশেই নতুন কোনো পুকুর খননের প্রয়োজন নেই। নাটোর জেলা ভৌগলিকভাবেই নিচু এলাকা। ইটভাটার জন্য মাটির চাহিদা থাকায় বিনা খরচে পুকুর করে মাটি নিয়ে যাচ্ছে ভাটা মালিকরা। তারচেয়েও ভয়ংকর রুপ নিচ্ছে জলাবদ্ধতা।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল করিম জানান, পুকুর খননের কারণে আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। ফসলের উৎপাদনও কমছে। গুরুদাসপুরের বিভিন্ন জায়গায় অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খননের ফলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। রোধ করা না গেলে অদূর ভবিষ্যতে এ সমস্যা আরো প্রকট আকার ধারণ করবে।
জেলা প্রশাসক মো. শাহরিয়াজ মুঠোফোনে বলেন, আমি এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য গুরুদাসপুরের ইউএনওকে ব্যবস্থা নিতে বলেছি। বিষয়টি আবারও গুরুত্বসহকারে দেখা হচ্ছে।
স্থানীয় সংসদ সদস্য অধ্যাপক মো. আব্দুল কুদ্দুস দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, পুকুর খনন চক্রের সাথে প্রশাসনের কতিপয় কর্মকর্তা বিশেষ সুবিধা নিয়ে পুকুর খননের সুযোগ করে দিচ্ছেন। এর আগেও মাসিক সমন্বয় সভায় বিষয়টি তুলে ধরে কর্মকর্তাদের সতর্ক করা হয়েছিল। তাতেও কোনো কাজ না হওয়ায় এলাকায় মাইকিং করেছি। তিনি বলেন, আসলে শস্যের মধ্যেই ভুত রয়েছে।