নাটোর: কঠোর গোপনীয়তার মধ্যদিয়ে কয়েকদিনের টানা পর্যবেক্ষণের পর ধরা হয়েছে নাটোরের উত্তরপত্র প্রতিস্থাপন চক্রের মূল হোতা মাহমুদুন্নবী মিলনকে। তিনি নাটোর শহরের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজির ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিভাগীয় প্রধান বলে জানিয়েছে পুলিশ। তবে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ মোস্তাফিজুর রহমান টুটুলের দাবী, আটকের তিন দিন আগে শিক্ষক মিলনকে বাদ দেয়া হয়েছে তার প্রতিষ্ঠান থেকে।
এদিকে অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয় হওয়ায় গোপনীয়তার স্বার্থে শুরু থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ গোয়েন্দারা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে। এত করে ওই শিক্ষকের গতিবিধির উপর কঠোর নজরদারী রাখতেন তারা। গত বুধবার (৯ জানুয়ারী) অভিযানে যোগ দেয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সাথে কথা বলে পুরো বিষয়টি জানা যায়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জানান যে, তাদের নিকট কয়েকদিন ধরে তথ্য আসে- ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজির ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিভাগীয় প্রধান মাহমুদুন্নবী মিলন মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে পরীক্ষার উত্তরপত্র প্রতিস্থাপন করেন। প্রায় দেড় বছর ধরে (তিন সেমিস্টার) কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের বিভিন্ন সাবজেক্টের উত্তরপত্র তিনি প্রতিস্থাপন করে আসছেন। নাটোর শহরের বলারীপাড়াস্থ আব্দুল হামিদের বাড়িতে ভাড়াটিয়া থেকে পুরো কাজটি তিনি করে থাকেন।
অভিযানের অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার (০৮ই জানুয়ারী) রাতে নিজে বাড়িতে শিক্ষক মাহমুদুন্নবীর অবস্থান নিশ্চিত করে একটি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। তারা ওই রাতে মাহমুদুন্নবীর বাড়ির আশেপাশে অবস্থান নেয়। বুধবার সকাল সাড়ে ৭টায় আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযান শুরু করে পুলিশ। অভিযানের আগে মাহমুদুন্নবীর বাড়ির প্রবেশমুখের দুইট রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিলে বিষয়টি আঁচ করতে পেরে বিকল্প রাস্তায় বাড়ি থেকে বের হয়ে যান মাহমুদুন্নবী। মূল রাস্তায় এলে তাকে ঘিরে ধরে হাতে থাকা একটি ব্যাগে তল্লাশী চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এসময় তার বাড়িতে পরীক্ষার উত্তরপত্র আছে-এমন চ্যালেঞ্জ করে বাড়িতে অভিযান চালায় তারা।
বাড়িতে ঢুকে বেডরুমের স্টীলের আলমারীর নীচের ড্রয়ার থেকে ওএমআর শীট পূরণকৃত ১৩টি ও পূরণ ব্যতীত ৩৫৮টিসহ মোট ৩৭১টি কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের খাতা, বিভিন্ন পরীক্ষার্থীদের ১৩টি প্রবেশপত্রের মূলকপি ও তাদের সাথে যোগাযোগে ব্যবহৃত একটি মোবাইল সেট উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। উত্তরপত্রগুলো কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের প্রোগ্রামিং ইন সি(৬৬৫৯)বিষয়ের।
অভিযানে অংশ নেয়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক সদস্য জানান, তাদের জিম্মায় নেয়ার পরপরই শিক্ষক মাহমুদুন্নবীর নিকট ফোন করতে থাকে পরীক্ষার্থীরা। অন্তত ১০ জন পরীক্ষার্থী ফোন করে বিষয়টির সত্যতা জানান দেয়। বাহিনীর এক সদস্য ওই ফোনগুলো রিসিভ করে জানতে পারেন, প্রতি বিষয়ের পরীক্ষার জন্য ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা করে নিতেন শিক্ষক মাহমুদুন্নবী।
এদিকে, বুধবার রাতেই উত্তরপত্র প্রতিস্থাপন চক্রের মূল হোতা মাহমুদুন্নবী মিলনের বিরুদ্ধে নাটোর সদর থানায় পাবলিক পরীক্ষাসমূহ (অপরাধ) আইন ১৯৮০ এর ৮ ধারায় মামলা দায়ের করেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কার্যালয়ের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ মর্তুজা খান। এর আগে তিনি ওই অভিযানে অংশ নেন। আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জালিয়াতির সাথে নিজের সম্পৃক্ততার বিষয়টি স্বীকার করেছেন তিনি।
এদিকে আটকের পর শিক্ষক মাহমুদুন্নবী মিলনের স্বীকারোক্তি থেকে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
জানা যায়, বিগত তিন সেমিস্টার ধরে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে বিভিন্ন বিষয়ের উত্তরপত্র প্রতিস্থাপন করতেন শিক্ষক মাহমুদুন্নবী মিলন। এ কাজের জন্য পরীক্ষার্থী প্রতি ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা করে নিতেন তিনি। আগ্রহী পরীক্ষার্থীরা এ টাকার বিনিময়ে পাশের নিশ্চয়তা পেত। টাকা প্রাপ্তির পর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মচারীর নিকট থেকে পাঁচ হাজার টাকায় ১০০টি করে ফাঁকা উত্তরপত্র কিনতেন শিক্ষক মাহমুদুন্নবী মিলন । পরীক্ষার আগের দিন ফাঁকা উত্তরপত্রের তথ্যবহুল প্রথম পৃষ্ঠার শিক্ষার্থীর অংশটুকু ছিড়ে পরীক্ষার্থীদের দিতেন তিনি। পরীক্ষার নির্দিষ্ট সময় শেষের কিছু পূর্বে মূল উত্তরপত্রের প্রথম পৃষ্ঠার শিক্ষার্থীর অংশটুকু ছিড়ে নিয়ে আগের দিন সরবরাহকৃত অংশটুকু কৌশলে উত্তরপত্রের ভেতরে রেখে দিতো পরীক্ষার্থীরা। ওই রাতেই শিক্ষক মাহমুদুন্নবী আসল উত্তরপত্র সরিয়ে দিতেন এবং পরীক্ষার্থীর আনা ‘শিক্ষার্থীর অংশটুকু’ নিজের কাছে রেখে ফাঁকা উত্তরপত্র শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। পরদিন উত্তরপত্র লেখা হলে আসল উত্তরপত্রের পরিবর্তে সেগুলোই শিক্ষা বোর্ডে পাঠাতেন এবং একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সেই খাতাগুলো আবার নাটোরেই ফিরে আসত।
অভিযানে অংশ নেয়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওই সদস্য আরও জানান, প্রতিস্থাপিত খাতাগুলো উত্তরপত্রে পরিবর্তনজনিত কারণে শিক্ষাবোর্ডে প্রত্যাখ্যাত হলেও আগে কেনা ফাঁকা উত্তরপত্রের প্রথম পৃষ্ঠার ‘শিক্ষার্থী অংশের’ কারনে কারিগরি বোর্ডের নীতিমালা অনুযায়ী পরীক্ষার্থীরা ন্যুনতম নম্বর পেয়ে পাস করতেন। ফলে জালিয়াতির বিষয়টি সামনে আসত না।
নাটোর সদর থানার পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) মোঃ আবু সিদ্দিক মামলাটির তদন্ত করছেন। তিনি বলেন, শিক্ষক মাহমুদুন্নবী প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে উত্তরপত্র জালিয়াতির কথা স্বীকার করেছেন। অত্যন্ত স্পর্শকাতর এ মামলাটি অধিক গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত চলমান রয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ০৯ জানুয়ারী নাটোর শহরের বলারীপাড়া এলাকা থেকে ৩৭১টি উত্তরপত্রসহ স্থানীয় ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজির শিক্ষক মাহমুদুন্নবীকে আটক করে পুলিশ।