নাটোর: দশ বছর পর নাটোরে ভোট। মানুষের তাই আশাও ব্যাপক। ভোটের প্রতি মানুষের আগ্রহ বোঝা গেল আজ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহনের দিন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। ভোট আওয়ামী লীগের কাছে ‘নিশ্চিত বিজয়ের’ প্রশাসনের কাছে ‘সুষ্ঠু’ হলেও বিএনপি ও জাপার কাছে ‘জোর ও কারচুপির’।
নাটোরের ৩ আসনে বিএনপি ও জাপার ৪ প্রার্থীর ভোট বর্জনঃ
প্রকাশ্যে ভোটদানে বাধ্যকরণ, ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা, প্রতিপক্ষের প্রার্থীর সমর্থকদের উপর হামলা ও আটকে রাখার ঘটনায় নাটোরের তিনটি আসনে বিএনপি ও একটি আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ভোট বর্জন করেছেন। রোববার সকালে ভোট শুরুর কয়েকঘন্টা পর নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) আসনের প্রতিটি কেন্দ্রে বিএনপির পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়া, নাটোর-২(সদর-নলডাঙ্গা) আসনের বিএনপি প্রার্থীর বাসভবনে হামলা ও নাটোর-৩ (সিংড়া) আসনে বিএনপি প্রার্থী দাউদার মাহমুদকে ভোটকেন্দ্রে অবরুদ্ধকরণের অভিযোগে ভোটবর্জন করেছেন বিএনপি প্রার্থীরা।
ভোট দিতেই পারেননি বিএনপির দুই প্রার্থীঃ
নাটোর-২ আসনে বিএনপির সাবিনা ইয়াসমিন ছবি ও নাটোর-৩ আসনে দাউদার মাহমুদ নিজেদের ভোটই দিতে পারেননি। ভোট কারচুপির ও দলীয় সমর্থকদের উপর হামলার অভিযোগ এনে ভোট বর্জন করেছেন নাটোর-২ আসনের জাতীয় পার্টির প্রাথী মজিবর রহমান সেন্টুও।
নাটোর-১(লালপুর-বাগাতিপাড়া) আসনে যা হলঃ
লালপুর উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে ভেটগ্রহণ শুরুর পরপরই প্রতিটি কেন্দ্র থেকে বিএনপির পোলিং এজেন্ট বের করে দেয়ার অভিযোগসহ কেন্দ্রদখল, ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ এনে রোববার বিকেল ৩টায় ভোট বর্জন করেছেন প্রার্থী কামরুন্নাহার শিরীন। তিনি অভিযোগ করেন, ভোটের আগের রাতে লালপুরের ৫টি ও বাগাতিপাড়ার ৫টি ইউনিয়নে ভোট নেয়া হয়ে গেছে। এছাড়াও বিএনপি সমর্থকদের ভোটকেন্দ্রে আসতে রাস্তায় বাধা দেয়া হয়েছে। আল আমিন নামে তার এক সমর্থককে নিজ কেন্দ্র গৌরিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। বিষয়টি সহকারি রিটার্নিং অফিসারকে জানালেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে জানান বিএনপি প্রার্থী।
এদিকে জেলার একমাত্র বিএনপি প্রার্থী হিসেবে নিজের ভোট দিতে পারা কামরুন্নাহার শিরীন রোববার দুপুরের পর গৌরিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভোট দিতে এসে সাংবাদিকদের জানান, এই কেন্দ্রে দুপুর ২টার মধ্যেই শতকরা ৭০ ভাগ ভোট পড়ে কাস্ট হওয়াই বোঝায় নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে। শুধু লালপুরেরই শোভ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বাঁশবাড়িয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুপুর ১২টার পর কোন ভোটার দেখা যায়নি। আওয়ামী লীগ ভোট কারচুপির অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।
যা বললেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী শহিদুল ইসলাম বকুলঃ
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ প্রার্থী শহিদুল ইসলাম বকুল বলেন, বিএনপি প্রার্থী বিভ্রাটের কারণে এমনিতেই লালপুরে পিছিয়ে আছে। তাই ভোটের মাঠে বিভক্ত বিএনপির কোন নেতৃত্ব নেই, ভোটার নেই। নিজেদের দূর্বলতা ঢাকতে আওয়ামী লীগের উপর দোষ চাপাচ্ছে তারা।
রিটার্নিং অফিসারের বক্তব্যঃ
এ আসনের সহকারী রিটার্নিং অফিসার উম্মুল বানীন জানান, অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটগ্রহন চলেছে সারাদিন। কোথাও কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তাছাড়া কোন প্রার্থী অভিযোগও করেনি।
নাটোর-২(সদর-নলডাঙ্গা) আসনে বিএনপি প্রার্থীর বাড়িতে হামলা, প্রকাশ্যে ভোটঃ
আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে নিজ বাড়িতে হামলার, ভোট দিতে বাধাদান ও প্রকাশ্যে ভোটের অভিযোগ এনে রোববার দুপুর আড়াইটায় বিএনপি প্রার্থী সাবিনা ইয়াসমিন ছবি নির্বাচন বর্জন করেছেন। একই সময়ে একই অভিযোগে ভোট বর্জন করেছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী মজিবর রহমান সেন্টু।
সাবিনা ইয়াসমিন ছবি অভিযোগ করেছেন, ভোট শুরুর ঘন্টাখানেক পর নৌকা প্রতীকের সমর্থকরা তার আলাইপুরের বাসভবনে হামলা চালায়। এর আগে সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে ভোটকেন্দ্র আসতে বাধা দেয়ায় সদর উপজেলার হালসা ইউনিয়নে প্রতিটি কেন্দ্র ভোটারশূন্য হয়ে পড়ে। এদিকে, নলডাঙ্গা উপজেলার অর্জুনপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট শুরুর ১৫ মিনিটের মধ্যে ভোটারদের বের করে দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিএনপি প্রার্থী সাবিনা ইয়াসমিন ছবি অভিযোগ করেন, আগে থেকেই ওই কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ নেয় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর লোকজন। ওই কেন্দ্রে ভোট দিতে গেলে ভোটারদের প্রকাশ্যে নৌকা প্রতীকে সিল মারার জন্য বলা হলে আধাঘন্টার মধ্যে ভোটকেন্দ্র খালি হয়ে যায়। একই কারণে নলডাঙ্গার বামনপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্র খালি হয়ে যায়।
ভোট না দিয়ে ফিরে গেলেন বিএনপির ভোটাররাঃ
নাটোর সদর উপজেলা বিএনপির সভাপতি রহিম নেওয়াজ বলেন, সদর উপজেলার ছাতনী ইউনিয়নের শতাধিক নারীসহ বিএনপির কর্মী সমর্থকরা পন্ডিতগ্রাম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে গেলে রাস্তায় তাদের বাধা দেন আওয়ামী লীগ প্রার্থীর লোকজন। এসময় ভোটকেন্দ্রে গেলে লাঞ্ছিত করা হবে জানিয়ে কয়েকশ’ আওয়ামী লীগ কর্মী ধারালো অস্ত্র ও লাঠিসোটা নিয়ে পন্ডিতগ্রাম ইটভাটার সামনে অবস্থান নিলে ফিরে চলে যায় বিএনপির ভোটাররা।
বিএনপির বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের অভিযোগ শিমুলেরঃ
এ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী শফিকুল ইসলাম শিমুল বলেন, তার সমর্থকরা কোথাও কাউকে ভোটকেন্দ্রে আসতে বাধা দেননি। ভোটের দিনও বিএনপি মিথ্যাচারে লিপ্ত। পরাজয় নিশ্চিত জেনে বিএনপি ভোট থেকে সরে এসেছে।
নাটোর-৩(সিংড়া) আসনে সবার আগে বিএনপি প্রার্থীর ভোট বর্জনঃ
সিংড়া উপজেলার ১১৮টি কেন্দ্রে বিএনপির প্রার্থীর পোলিং এজন্টদের বের করে দেয়া, কারচুপি ও নিজেকে অবরুদ্ধ করার অভিযোগে ভোট বর্জন করেছেন বিএনপি প্রার্থী দাউদার মাহমুদ। রোববার ভোট শুরুর কয়েক ঘন্টা পর তিনি সংবাদ সম্মেলন করে ভোট বর্জণ করেন।
পরাজয়ের আশঙ্কায় বিএনপি প্রার্থীর ভোট বর্জন, বললেন পলকঃ
তবে এ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী জুনাইদ আহমেদ পলক বিএনপি প্রার্থীর অভিযোগকে ভিত্তিহীন দাবী করে বলেন, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সিংড়ার ভোটাররা নৌকায় ভোট দিয়েছেন উৎসবমুখর পরিবেশে। ভোটারদের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহনে ভীত হয়ে পরাজয়ের আশঙ্কা থেকেই ভোট বর্জন করেছেন বিএনপি প্রার্থী।
ব্যতিক্রমী ভোট গুরুদাসপুরেঃ
নাটোর-৪(বড়াইগ্রাম-গুরুদাসপুর)ঃ এ আসেনই একমাত্র ভোট বর্জনের ঘটনা ঘটেনি। সকাল থেকে উৎসবমুখর ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট দেন ভোটাররা। কোথাও কোন অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেনি। এখানে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আব্দুল কুদ্দুস ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী আলাউদ্দিন মৃধা। তারা কেইউ পরস্পরের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করেননি দিনব্যাপী।
জেলা রিটার্নিং অফিসারের বক্তব্যঃ
এ ব্যাপারে জেলা রিটার্নিং অফিসার ও জেলা প্রশাসহ মোহাম্মদ শাহরিয়াজ বলেন, বিভিন্ন অভিযোগ এনে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি প্রার্থীরা ভোটবর্জন করেছেন বলে শুনেছি। তবে তাদের অভিযোগগুলো সঠিক নয়। বিভিন্ন কেন্দ্র করে দেখেছেন প্রায় সবকয়টি কেন্দ্রে শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটগ্রহন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে এসব বিষয়ে তাদের কোন অভিযোগ হাতে পাইনি। সর্বোপরি ভোট অংশগ্রহনমূলক হয়েছে।