নাটোর অফিস ॥
‘ধনধান্য পুষ্প ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা’- কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের এই শাশ্বত আহ্বান যেন ফুটে উঠেছে নাটোরের প্রতিমা শিল্পি বিশ্বজিৎ পালের তৈরি দুর্গা প্রতিমা। প্রতিমার গোটা অবয়ব জুড়ে শোভা পাচ্ছে শুধু ধান আর ধান। কাদা-মাটি দিয়ে সাধারণত প্রতিমা তৈরি করা হলেও নাটোরে এবার প্রথমবারের মত ব্যতিক্রমীভাবে ধান দিয়ে তৈরি করা হয়েছে দুর্গাদেবীর প্রতিমা। প্রতিমাটি তৈরি করেছেন নাটোর শহরের লালবাজার এলাকার স্বর্গীয় নিমাই চন্দ্র পালের ছেলে বিশ্বজিৎ পাল। স্ত্রী ও সন্তানের পাশাপাশি ও তার কাকা গোপাল চন্দ্র পালও তাকে সহায়তা করেছেন ধানে গড়া এই দুর্গা প্রতিমা তৈরিতে।
প্রতিমা শিল্পি বিশ্বজিৎ পাল জানান, নতুনত্বের ভাবনা থেকে তিনি এই ধানে গড়া দুর্গা প্রতিমা তৈরি করেছেন। প্রতিমা তৈরি করতে তার ধান লেগেছে প্রায় ৫০ কেজি। এই প্রতিমা তৈরি করতে সময় লেগেছে প্রায় এক মাস। এই প্রতিমা নাটোরের লালবাজার কদমতলার রবি সূতম সংঘের পূজা মন্ডপে শোভা পাবে। প্রতিমাটি ৯৫ হাজার টাকার অর্ডারে করেছেন তারা। তিনি বলেন, স্বর্গীয় বাবা গোপাল চন্দ্র পালের কাছে প্রতিমা বানানো শেখা তার।
সবাই তো নতুনত্ব চায়। তাই সেই চিন্তা থেকে এ বছর ধান দিয়ে ১১ ফুট উচ্চতার দুর্গাদেবীর প্রতিমা বানিয়েছি। সহযোগীতা পেলে আগামী বছর নতুনত্ব নিয়ে বড় করে আরও প্রতিমা তৈরির ইচ্ছা রয়েছে। আশা করছি, ধান দিয়ে দুর্গাদেবীর প্রতিমা সবার সবার প্রশংসা কুড়াবে। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ এই প্রতিমা তৈরি দেখতে এসে প্রশংসা করছেন।
রবি সুতম সংঘের সাধারণ সম্পাদক পার্থ রায় বলেন, “রবি সুতম সংঘ প্রতিবছরই নিত্য নতুন দুর্গাপ্রতিমা তৈরি করে। এরই ধারাবাহিকতায় এ বছরে আমরা ধান দিয়ে প্রতিমা তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করি। ধান দিয়ে প্রতিমা নির্মাণ করাটা খুব সহজ কাজ নয়। আমরা প্রতিমা শিল্পি বিশ্বজিৎ পালের সঙ্গে আলোচনা করলে তিনি এই প্রতিমা তৈরি করে দিতে সম্মতি দেন। প্রতিমাশিল্পী একটি করে ধান সুনিপুণভাবে থরে থরে সাজিয়ে প্রতিমাকে সুন্দর করে তুলেছেন। প্রতিমাকে ভিন্ন আদলে তুলে ধরার প্রয়াসে ধান ব্যবহার করা হয়েছে। যেন সোনালি আভা ফুটে ওঠে। এছাড়া ধান গ্রামবাংলার মানুষের কাছে সমৃদ্ধি ও ঐশ্বর্যের স্মারকও বটে। ধান দিয়ে জেলাতেই প্রথম এখানে প্রতিমা তৈরি হয়েছে।’
বিশ্বজিতের ছোট ভাই বিপ্লব কুমার পাল বলেন, প্রতিমা তৈরি তাদের পৈত্রিক পেশা। বাবা স্বর্গীয় নিমাই চন্দ্র পাল নাটোর শহরের লালবাজারে প্রতিমা তৈরির কারখানা গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর তৈরি প্রতিমা বেশ কদর ছিল। নিখুঁত হাতে চমৎকার ভাবে প্রতিটি প্রতিমাকে শিল্পকর্মের মাধ্যমে সাজিয়ে তুলতেন তিনি। ফলে নাটোর জেলার বাহিরেও তাঁর হাতের তৈরির বিভিন্ন দেবীর প্রতিমার বেশ চাহিদা ছিল।
বাবার মৃত্যুর পর সীমিতভাবে প্রতিমা নির্মাণের কাজ করেন আমার দাদা বিশ্বজিৎ পাল এবং কাকা গোপাল চন্দ্র পাল। কাকার বয়স হয়েছে তাই বেশিরভাগ কাজ দাদাকেই করতে হয়। দাদা নতুন কিছু করতে পছন্দ করেন। এর আগেও তিনি স্বরসতী প্রতিমা করেছিলেন কিছু নতুনত্ব নিয়ে। এবারের তার ভাবনায় ধান দিয়ে তৈরি দুর্গা প্রতিমা সবার নজর কাড়বে বলে আশা করছেন।
বগুড়া থেকে ধানের তৈরি প্রতিমা দেখতে এসে বিমোহিত হন অজিত কর্মকার নামে এক ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, নাটোরের প্রতিমা শিল্পি বিশ্বজিৎ পালের ধানে গড়া দুর্গা প্রতিমা দেখে মনে হচ্ছে -যেন সোনার আলোয় বানানো এক চিরায়ত বাংলার মুখ’। এবারের পুজোতে ধানে গড়া এই দুর্গা প্রতিমা সাড়া ফেলবে। আগামীতে ধান দিয়ে বানানো দুর্গা প্রতিমার সংখ্যাও বাড়বে।
নাটোর জেলা পূজা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খগেন্দ্রনাথ রায় বলেন, নিরাপত্তা নিয়ে শংকা থাকার কারণে এবছর পূজা কম হচ্ছে। তবে নাটোরে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এছাড়া প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক নিরাপত্তা দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।’
জেলা প্রশাসক (ভারপ্রাপ্ত) মো. মাছুদুর রহমান বলেন, “পূজা মণ্ডপের জন্য সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। নির্বিঘ্নে পূজা উদযাপনের জন্য বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে। পূজা মণ্ডবে নিরাপত্তার জন্য সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ এবং আনসার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবেন। এছাড়াও পূজা কমিটির স্বেচ্ছাসেবক সার্বিক নিরাপত্তার কাজের নিয়োজিত থাকবে।”
আগামী মঙ্গলবার দেবী দুর্গার বোধন ও ষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে শারদীয় দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। আর ১৩ অক্টোবর রোববার বিজয় দশমীর মধ্য দিয়ে শেষ হবে বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় এই ধর্মীয় উৎসব