নাইমুর রহমান, দুই চিনিকল ঘুরে
এক চিনিকলে কারিগরি ত্র“টি ও অপর চিনিকলে শ্রমিক অসন্তোষ। মৌসুমের শুরুতে উৎপাদনে গিয়েই ধাক্কা খেল নাটোরের দুই চিনিকল। ফলে নাটোর সদরে অবস্থিত নাটোর সুগার মিল ও লালপুরে অবস্থিত নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২৭ হাজার ২২৫ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন প্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
গত ১৭ই নভেম্বর ২০১৮-১৯ মৌসুমের প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে আখ মাড়াই কার্যক্রম শুরু হয় নাটোর চিনিকলে। তবে উৎপাদন শুরুর ১১ ঘন্টা পরই যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বন্ধ হয়ে যায় চিনিকলটি। পরে ৮ ঘন্টা পর উৎপাদন চালু হলেও গত ২৯শে নভেম্বর রাতে চিনিকলটির বয়েলিং সেকশনের চারটি তরল গুড়ের ট্যাংক ধ্বসে পড়লে সেই থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে চিনিকলটির উৎপাদন। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে চিনিকলটিতে নতুন যন্ত্রাংশ সংযোজন বা প্রতিস্থাপন না করায় বিভিন্ন সময়ে কারিগরি ত্র“টির কবলে পড়ে চিনিকলটি। চিনি উৎপাদনে অপরিহার্য সালফার সংরক্ষণাগার চিনিকলের ভেতরে স্থাপন করায় গ্যাসের প্রভাবে এবার ধকল সইতে পারেনি মরিচা ধরা ট্যাংক ও যন্ত্রাংশগুলো, দাবী মিল কর্তৃপক্ষের। দেশের ১৭টি চিনিকলের মধ্যে নাটোর চিনিকলেই সালফার সংরক্ষণাগার চিনিকলের ভেতরে অবস্থিত, যা নজিরবিহীন।
চলতি মৌসুমে ১২ হাজার ২২৫ টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে নাটোর চিনিকল। চিনি আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ। কিন্তু কবে নাগাদ মিলটি আবার চালু করা যাবে, তা নিয়ে কর্তৃপক্ষই সংশয়ে রয়েছে। ফলে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে চিনিকলটির উৎপাদন বন্ধ হওয়ায় সদর, নলডাঙ্গা ও পাশ্ববর্তী কয়েকটি উপজেলার কয়েক হাজার আখচাষী উৎপাদিত ও কর্তনকৃত আখ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। স¤প্রতি নাটোর সদর ও নলডাঙ্গা উপজেলার বিভিন্ন আখ ক্রয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, দুই তিনটি আখ বহনের লরিতে আখ ভরা আছে, আর শত শত মণ আখ মাঠে পড়ে আছে। আখচাষীরা আখ ক্রয় কেন্দ্রেভীড় করছে।
নলডাঙ্গা উপজেলার আখচাষী ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘গতবছর থেকে চিনিকল কৃর্তপক্ষ পাওয়ার ক্রাশারে আখ মাড়াই করে গুড় উৎপাদন বন্ধ করে দেয়ায় অনেক চাষী পাওয়ার ক্রাশারে বিক্রি করে দিয়েছে। এখন ক্রাশারে দিয়েও আখ মাড়াই সম্ভব না আবার মিলও বন্ধ। আমরা কোন উপায় দেখছি না।’
সদর উপজেলার আখচাষী আব্দুস সালাম বলেন, ‘বাজারে বর্তমানে গুড়ের যে দাম তাতে গুড় উৎপাদন করা মানেই লোকসান। তার উপর মিল বন্ধ হওয়ায় আমরা হতাশ।’
এ বিষয়ে নাটোর সুগার মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মাদ শহীদুলাহ বলেন, ‘ট্যাংক ধ্বসের পর পরই ঢাকা থেকে ৫ জন টেকনিশিয়ান এসে পুরো বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাদের ৩ জনের সার্বিক তত্বাবধানে দ্রুতগতিতে তরল গুড়ের ট্যাংক মেরামতের কাজ চলছে। কর্তনকৃত আখের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, এ মিলের অধীনে ইতোপূর্বে কর্তনকৃত আখ জেলার নর্থবেঙ্গল সুগার মিল ও পার্শ্ববর্তী রাজশাহী সুগার মিলে সরবরাহ করা হচ্ছে। শীগ্রই চিনিকলে উৎপাদন শুরু হবে এবং আখ নিয়ে কৃষকের দুশ্চিন্তা থাকবে না।’
অপরদিকে, উৎপাদন বন্ধজনিত কোন সমস্যা না থাকলেও এবার শ্রমিক অসন্তোষের কারণে চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে লালপুরের নর্থ বেঙ্গল চিনিকলে। চিনিকলটির অধীনস্থ আটটি কৃষি খামারের প্রায় সাড়ে ৫ হাজার শ্রমিক মজুরী বৃদ্ধিসহ ৭ দফা দাবী করে আসছিলেন দীর্ঘদিন ধরে। গত ২২ নভেম্বর দাবীর মুখে দুইটি গ্রেডে চলতি মজুরী ৫০ টাকা করে বৃদ্ধি করে মজুরি নির্ধারণ করা হলেও নতুনভাবে তাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের মজুরীর তুলনায় বর্ধিত মজুরি অনেক কম- এমন দাবী করে পুনরায় মজুরি বৃদ্ধিসহ পুননির্ধারণের দাবিতে আবারো আন্দোলনে নেমেছেন শ্রমিকেরা। স¤প্রতি ওই ৮টি কৃষি খামারের দৈনিক শ্রমিক ঐক্য কমিটির পক্ষ থেকে চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর ১৫ দিনের আলটিমেটামও দিয়েছে তারা।
জানা যায়, চিনিকলের অধীনস্থ লোকমাপুর কৃষ্ণা, নন্দা, বড়াল, ভবানীপুর, মুলাডুলি, নরেন্দ্রপুর, গোবিন্দপুর ও বীজ বর্ধন কৃষি খামারের শ্রমিকদের দাবীর প্রেক্ষিতে সদ্যবিদায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মিজানুর রহমান মজুরি বৃদ্ধির একটি সুপারিশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনে পাঠান। এর প্রেক্ষিতে চলতি বছরের ২২ নভেম্বর বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের খামার শ্রমিকদের মজুরি পুননির্ধারণ সংক্রান্ত বোর্ড দৈনিক হাজিরা পুননির্ধারণ করে। এতে সাধারণ (হালকা) কাজের জন্য প্রতিদিন ২০০ টাকার পরিবর্তে ২৫০ টাকা এবং ওবারহেড (ভারী) কাজের জন্য ২১০ টাকার পরিবর্তে ২৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। নির্ধারিত পরিমাণ মজুরি বৃদ্ধিতেও শ্রমিকরা সন্তুষ্ট হয়নি।
চিনিকলের শ্রমিক ঐক্য কমিটির সাধারণ সম্পাদক শামসুল আলম বিপ্লব বলেন, ‘আমরা ওভারহেড সেকশনের ভারী কাজের জন্য ৫০০ টাকা ও সাধারণ সেকশনের হালকা কাজের জন্য ৪৫০ টাকা মজুরীর দাবী করেছি। অথচ কায়িক শ্রমের এ দুইটি সেকশনের জন্য মজুরী বাড়ানো হয়েছে মাত্র ৫০ টাকা যা রীতিমত উপহাস সাড়ে ৫ হাজার শ্রমিকের সাথে। দাবী মানা না হলে ৮ টি খামারের শ্রমিকরা লাগাতার কর্মবিরতিতে যাবে।’
এ ব্যাপারে নর্থ বেঙ্গল চিনিকলের জিএম (খামার) ইমতিয়াজ হোসেন বলেন, ‘আর্থিক সঙ্কটে থাকা কর্পোরেশন শ্রমিকদের দাবী বিবেচনায় নিলে একবার মজুরি বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্ত শ্রমিকরা সেটি মানছেন না। তারা আল্টিমেটাম দিয়ে কাজ বন্ধ করলে ফার্মগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, চিনিকল না।। বছরখানেক পরে আবারো তাদের মজুরি বৃদ্ধির আশ্বাস দেয়া হয়েছে চিনিকলের পক্ষ থেকে।’
চলতি মৌসুমে নর্থ বেঙ্গল চিনিকলে ২ লাখ ৪৮ হাজার মেট্রিক টন আখ থেকে ১৫ হাজার মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
শ্রমিক অসন্তোষ ও কারিগরি ত্র“টি দূর করে দ্রুত উৎপাদনে যাবে চিনিকলদুটি এমন প্রত্যাশা শ্রমিক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।