নাটোর অফিস ॥
দিনের আলো নিভে সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে নাটোরে বিরাজ করে আতংক। সন্ধ্যার এই আতংকের নাম সাদা মাইক্রো ও হেলমেট বাহিনী। এরা গুপ্ত হামলা চালিয়ে বিভিন্ন জনকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হাত-পা ভেঙ্গে রাস্তায় ফেলে যাচ্ছে। এই গুপ্ত হামলাকারীদের মাসাধিকালেও পুলিশ ধরতে পারেনি। এছাড়া হামলাকারী কারা তাও জানাতে পারেনি পুলিশ। এমনকি ভুক্তভোগীরাও জানাতে পারেনি তাদের পরিচয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এমন কথা বলছিলেন নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষ। এইসব গ্রামের অনেকেই রাতের অন্ধকারে হেলমেট বাহিনী বা সাদা মাইক্রোতে করে আসা দুবৃর্ত্তের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
নাটোরের বিভিন্ন সড়কে সাদা মাইক্রো বাস ও হেলমেট পড়া মোটর সাইকেল দেখলেই আতংকিত হয়ে ওঠেন অনেকেই। বিশেষ করে রাজনৈতিক দল বিএনপি -জামায়াত নেতা কর্মীদের কাছে। গত একমাসে এই দু’টি রাজনৈতিক দলের অন্তত ১২ নেতা-কর্মী অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হয়েছেন। হামলার শিকার কয়েকজনকে বিভিন্ন সময়ে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে বেধড়ক মারপিট করে গুরুতর জখম করে রাস্তায় ফেলে যায় দুর্বৃত্তরা। কয়েকজন মুখোশধারী হেলমেট বহিনীর শিকার হন। এদের একজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। অন্যদের হাতুরি পেটাসহ লোহার রড ও চাইনিজ কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হাত-পা ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। এদের বেশ কয়েকজন এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। আতংক কাটছেনা এসব পরিবারের সদস্যদের। সাদা মাইক্রো বাস ও মুখে মুখোশ লাগানো হেলমেট পড়া বাইকার দেখেই আতংকিত হয়ে পড়েন অনেকেই। গোটা জেলায় এখন এই আতংক বিরাজ করছে। এসব ঘটনায় লিখিত অভিযোগ দিলেও তা রেকর্ডভুক্ত করা হয়নি সংশ্লিষ্ট থানায় বলে অভিযোগ হামলার শিকার হওয়া পরিবারের সদস্যদের। তবে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি অভিযোগ রেকর্ডভুক্ত করা হয়েছে বলে পুলিশ দাবী করেছে।
ঘটনার শুরু হয় চলতি বছরের অক্টোবরে। ১৬ অক্টোবর নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলায় ঘটে এমন হামলার প্রথম ঘটনা। সর্বশেষ ঘটনা ঘটেছে শুক্রবার (১৭ নভেম্বর) সন্ধ্যায় সদর উপজেলার মাঝদিঘা গ্রামে। এদিন স্থানীয় একটি মাদ্রাসার অধ্যক্ষকে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে পিটিয়ে জখম করে সড়কের ওপর ফেলে যায়। তার একটি হাত ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে।
১৬ অক্টোবর প্রথম ঘটনায় নলডাঙ্গা উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি ফজলুর রহমানের পথরোধ করে এলোপাতারি কুপিয়ে রক্তাক্ত জখম করে মোটর সাইকেলযোগে পালিয়ে যায় মুখোশধারী হেলমেট বাহিনী।তার হাত ও পায়ের রগ কেটে দেয়া হয়। এরপর ৩০ অক্টোবর রাতে নলডাঙ্গা উপজেলার খাজুরা ইউনিয়নের জামায়াতের আমীর মোশারফ হোসেনকে বাড়ি থেকে ডেকে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে চোখ-মুখ বেঁধে অজ্ঞাতস্থানে নিয়ে তার দুপা ও দুই হাত ভেঙ্গে দেয়া হয়। মারা গেছে ভেবে দুর্বৃত্তরা তাকে রাস্তায় ফেলে যায়। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে। এর আগে বাঁশিলা গ্রামের জামায়াত সমর্থক নুশরাতকে এবং ২৫ অক্টোবর মোটর সাইকেলে করে বাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে নশরতপুর গ্রামের জামায়াত সমর্থক আলাউদ্দিনকে হেলমেট বাহিনী পথের মধ্যে ধরে বেধড়ক পিটিয়ে আহত করে। ২৯ অক্টোর সকালে বিএনপির অবরোধ কর্মসুচীর সময় শহরের স্টেশন বড়গাছা এলাকার বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সাইফুল ইসলাম অফতাব গুলিবিদ্ধ হন। বিএনপির অভিযোগ ,যুবলীগ কর্মীদের মিছিল থেকে গুলি বর্ষন করা হয় ।
এদিন রাত সাড়ে ৮টার দিকে সদর উপজেলা মৎস্যজীবী দলের সভাপতি আবু রায়হানকে অস্ত্রের মুখে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এসময় তিনি উপজেলার মির্জাপুর বাজারে বসে চা খাচ্ছিলেন। স্থানীয় লোকজন বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে দুর্বৃত্তরা ফাঁকা গুলি ছুড়ে আতংকের সৃষ্টি করে। তারা মৎস্যঝীবি নেতা আবু রায়হানকে অপহরণ করে নিয়ে যায় এবং তাকে কুপিয়ে জখম করে রাজশাহীর পুঠিয়ে এলাকায় রাস্তায় ফেলে পালিয়ে যায দুবৃর্ত্তরা। পরে তাকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
৩ নভেম্বর রাতে লালপুরে ইউনিয়ন যুবদলের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক মাসুদ রানাকে বিলমাড়িয়া এলাকায় দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফেরার সময় ডিবি পুলিশের পরিচয় দিয়ে সাদা মাইক্রেবাসে উঠিয়ে প্রায় ১০ কিলোমিটার দুরে মহিলা কলেজের কাছে নেয়া হয়। সেখানে তাকে কুপিয়ে হাতপায়ের রগ কেটে মৃতভেবে ফেলে যায় দুর্বৃত্তরা। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
১০ নভেম্বর সিংড়া উপজেলার কালিগঞ্জ এলাকা থেকে অস্ত্র দেখিয়ে ছাতারদিঘী ইউনিয়ন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারী ও করচমারিয়া গ্রামের বাসিন্দা হাফেজ আব্দুর রাজ্জাককে মাইক্রোবাসে তুলে নেয়া হয়। আব্দুর রাজ্জাক জুম্মার নামাজ শেষে বাড়ি ফিরছিলেন। তাকে চোখ বোধে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে মারপিট করার পর রক্তাক্ত অবস্থায় পার্শ্ববর্তী নন্দীগ্রাম উপজেলার একটি সড়কে ফেলে যায় দুর্বৃত্তরা। গত ১২ নভেম্বর রাত ৮ টার দিকে নলডাঙ্গা উপজেলার বিপ্রবেলঘড়িয়া ইউনিয়নের ১নং ওর্য়াড যুবদলের সভাপতি সজিব হোসেনকে তার রামশার কাজীপুর গ্রামে বাড়ি থেকে সাদা মাইক্রোতে তুলে নেয় মুখোশধারী দুবৃতর্ত্তরা। তাকে হাত পা ভেঙ্গে দেয় দুর্বৃত্তরা। সে বর্তমানে রামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। মুখোশ পড়ে থাকায় কাউকেই চিনতে পারেননি সজিব। সজিবের পিতা ওয়াজেদ আলী বলেন ছেলে কাউকে চিনতে পারেনি তাই থানায় মামলাও করা হয়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, মাইক্রো গাড়ি ও হেলমেট বাহিনীর ভয়ে তারা এখন সন্ধ্যার আগেই বাড়িতে ঢুকে পড়েন। হেলমেট বাহিনী সবাই মথায় হেলমেট ও মুখে মুখোশ পড়ে থাকে। এরা কারা তারা চেনেননা।
৩ নভেম্বর শুক্রবার রাতে সর্বশেষ ঘটনায় রক্তাক্ত জখম হয়েছেন সদর উপজেলার মাঝদিঘা গ্রামের মাঝদিঘা নুরানী হফেজি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সাইদুল ইসলাম। এদিন সন্ধ্যার পর ৫/৭ জন মুখোশধারী দুর্বৃত্ত সদর উপজেলার মাঝদিঘা নুরানী হফেজি মাদ্রাসায় ঢুকে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সাইদুল ইসলামকে তুলে নিয়ে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে পিটিয়ে জখম করে সড়কের ওপর ফেলে যায়। তার একটি হাত ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। সাদা মাইক্রোতে করে তাকে মাদ্রাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে প্রায় তিন কিলোমিটার দুরে সড়কের ওপর রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে যায় দুবৃর্ত্তরা। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সাইদুল ইসলাম বলেন,তাকে কে বা কারা মেরেছে তিনি কাউকে চিনতে পারেননি। তারা সকলেই নলডাঙ্গা এলাকার ভাষায় কথা বলছিলেন। ৫/৭ জন জুতা পড়েই মাদ্রাসার মধ্যে ঢুকে আমার নাম সাইদুল কিনা জিজ্ঞাসা করেই তারা পাঁজাকোল করে টেনে েেহঁচরে আমাকে মাইক্রেতে তুলে পিছনের সিটে বসিয়ে চোখ বেধে ফেলে। এসময় মাদ্রাসার ছাত্ররা ঘরের মধ্যে ছিল। আমিও মাগরিব নামাজ শেষে কোরান তেলোয়াত করছিলাম। তারা আমাকে মাইক্রের মধ্যে লোহার রড দিয়ে হাত ও পাসহ মাজার নিচের দিকে বেদম মারপিট করে। চেয়ারম্যানের সাথে ইউপি মেম্বার মামুনের বিরোধ চলছিল। ওই বিরোধের আক্রোশ আমার ওপরও ছিল। আমাকে মারার জন্য তার হাত রয়েছে কিনা জানিনা।
এলাকাবাসী সুত্রে জানাযায়,মাদ্রাসার কমিটি নিয়ে এবং গত সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত ইসলামী জালসার পোষ্টারে স্থানীয় ইউপি সদস্য মামুন পাঠানের নাম না দেয়া নিয়ে বিরোধের জেরে এই ঘটনা ঘটে থাকতে পারে বলে তারা ধারনা করছেন।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেন সরকার বলেন, মামুন পাঠানের সাথে বিরোধ রয়েছে মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সাইদুল ইসলামের। তবে এই বিরোধ নিয়ে শুক্রবারের ঘটনা ঘটেছে কিনা তা তিনি বলতে পারবেননা। অধ্যক্ষ সাইদুলই বলতে পারবেন তাকে কারা মেরেছে এবং কি কারনে মেরেছে তিনিই বলতে পারবেন। স্থানীয়দের সহায়তায় তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হয়।
ইউপি সদস্য মামুন পাঠান বলেন, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সাইদুল ইসলামের সাথে আমার কোন বিরোধ নেই। তাকে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
সদর থানার ওসি নাছিম আহমেদ বলেন, এঘটনায় থানায় কোন অভিযোগ হয়নি। অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বিএনপি ও জামায়াতের অভিযোগ,নির্দলীয় সরকােরর অধীেন নির্বাচনের দাবীতে চলমান আন্দোলন দমােত এই গুপ্ত হামলা’ চালানো হচ্ছে। হেলমেট পড়া ও মুখোশধারীদের পেছনে শক্তিশালী কেউ রয়েছে। তাদের পেছনে কারা তা নিশ্চিত করা যাচ্ছেনা। তবে স্থানীয়দের ভাষ্যমতে এসব ঘটনায় নাটোরের নলডাঙ্গা ও রাজশাহীর বাঘমারা কেিন্দ্রক সর্বহারাদের সংম্পৃক্ততা রয়েছে।২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে এভাবেই আর্বীভাব ঘটেছিল হাতুরি বাহিনীর।
জেলা বিএনপির সদস্য সচিব রহিম নেওয়াজ বলেন,সরকারের ইন্ধনে বিএনপি কর্মীদের ওপর এসব চোরাগুপ্তা হামলা করা হচ্ছে। দলের নেতাকর্মীরা এখন বাড়িতে থাকতে পারছেননা। পরিবারের লোকজন বাজারেও যেতে পারছেননা। একাধিক ঘটনা ঘটার পরও পুলিশ কাউকে ধরছেনা। সন্ধ্যা হলেই মানুষের মাঝে আতংক বিরাজ করে। মামলা করছেন না কেন জানতে চাইলে রহিম নেওয়াজ বলেন, কার কাছে মামলা করবো। মামলা করতে যাওয়ারও নিরাপত্তা নেই। পুলিশের কাছে গেলে মামলা নিতে গরিমসি করা হয়। আদালতে গেলেও অপরাগতা প্রকাশ করা হয়। ইতিপুর্বে দলীয় কর্মসুচীতে যাওয়ার সময় যুবলীগ সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে আমার একটি হাত ও পা ভেঙ্গে দেয়। এখন আমি চিকিৎসাধীন রয়েছি। আমার স্ত্রী থানায় মামলা করতে গেলে মামলা নেয়া হয়না। আদালতে মামলা করতে গেলে অপরাগতা প্রকাশ করা হয়। মনে হয় আমরা এখন ভিনদেশী নাগরিক।
নাটোরের পুলিশ সুপার মোঃ তারিকুল ইসলাম জানান, ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট থানা সমুহে ৭টি মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। পুলিশ তদন্ত সহ ঘটনার সাথে জড়িতদের সনাক্ত করার চেষ্টা করছে।