সাইফুল ইসলাম, সিংড়া॥
দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে বোরো ধান ঘরে তুলতে পারছেনা চলনবিলের কৃষকরা। টানা বৃষ্টির কারণে চলনবিলের অনেক জমিতে এবং বাড়ির আঙ্গিনায় ধানের চারা বের হচ্ছে। এদিকে, মরার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে অতিবৃষ্টি এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি। চলনবিলের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে পানি প্রবেশ করার কারণে তলিয়ে গেছে নিচু এলাকার ধান ও ভূট্টা ক্ষেত। পানির নিচে ধান কাটতে হচ্ছে কৃষকদের। অনেকে জমিতে ও বাড়ির আঙ্গিনায় পাকা ধানে নতুন করে চারা উঠেছে। পাশাপাশি তীব্র শ্রমিক সংকটের কারণে ধান কাটতে ব্যাহত হচ্ছে কৃষকেরা। গত তিন মৌসুম ধরে বন্যার পানিতে ধান তলিয়ে যাওয়ার কারণে বিপদ পিছু ছাড়ছেনা চলনবিলের কৃষকদের। সবমিলে ক্ষতির শিকার হতে হতে এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছে চলনবিলের প্রায় লক্ষাধিক কৃষক।
শুক্রবার (১১ মে) চলনবিলের সাতপুকুরিয়া, বিল তাজপুর, ডাহিয়া ও বিয়াসসহ বিভিন্ন এলাকা সরোজমিনে ঘুরে দেখা যায়, টানা বর্ষণ ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে অনেক জমিতে ও বাড়ির আঙ্গিনায় এবং সিংড়া-টু-তাড়াশ বারুহাস রাস্তার বিভিন্ন পয়েন্টে শত শত কৃষকের খামাল দেয়া ধানের গাছ বের হচ্ছে। কৃষকরা জানান, গত বছরে বন্যায় চলনবিল জুড়ে অবৈধ সুঁতিজাল ও বানার বাঁধের কারণে ধান ও ভূট্টা দেরীতে রোপণ করা হয়েছে। আর তাই পাকতেও দেরী হওয়ায় এখনও শত শত কৃষকের ধান-ভূট্টা পানির নিচে ডুবছে। এখন পুরোদমে বোরো ধান কাটা শুরু হলেও অতিবৃষ্টির কারণে ধান ঘরে তুলতে পারছেনা কৃষকরা। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ধান কাটা শ্রমিকরা টানা বৃষ্টি দেখে বাড়ি ফিরে গেছে। এতে করে ধান কাটা শ্রমিকের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। ধান পেকে গেলেও বাড়িতে নিয়ে আসতে পারছেনা কৃষকরা। টানা বর্ষণের ধানের গাছ বেরিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া অতিবৃষ্টির কারণে ধান মাড়াই এবং শুকানোর জায়গা ডুবে যাওয়ার কারণে আরো বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।
চলনবিলের সাতপুকুরিয়া গ্রামের কৃষক মজিবুর রহমান ও ফারুক হাসান বলেন, গত বছর চলনবিল জুড়ে একটি প্রভাবশালী বাহিনী অবৈধ সুঁতিজাল ও বানার বাঁধ দিয়ে পানি আটকে রাখায় পৌষ মাসের পরিবর্তে মাঘ মাসে ধান ও ভূট্রা রোপণ করতে পেরেছে কৃষকেরা। আর দেরীতে রোপণ করার কারণে ফসল পাকতেও দেরী হয়েছে। এখন টানা বর্ষণ ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে ধান ও ভূট্টা মাঠেই পচে নষ্ট হচ্ছে। যার কারণে ঠিকমত কেউ ধান ঘরে তুলতে পারছেনা। শ্রমিকও পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক মাঠে বৃষ্টির পানিতে ধান তলিয়ে গেছে। আর যতটুকু ধান কাটা হয়েছে তা বিক্রয়ও করতে পারছে না কৃষকেরা।
চলনবিলের ডাহিয়া গ্রামের আবু হানিফ, ইমান আলী বলেন, ডাহিয়ার এলাকায় পানাসি প্রকল্পের খাল দখল করে পুকুর নির্মাণ ও কাটা গাংয়ে পানি প্রবাহে বাঁধা সৃষ্টি করায় তাদের কাঁচা ভূট্টা ক্ষেত এখন পানির নিচে ডুবছে। পর পর দু’বছর চলনবিলের কৃষকের স্বপ্ন পানির নিচে ডুবে যাওয়ায় এই অঞ্চলের লক্ষাধিক কৃষক এখন হতাশায় ভূগছে।
২০১৭সালের এই সময়ে চলনবিলে হঠাৎ বন্যার কারণে বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়। বন্যার পানিতে ডুবে যায় অন্তত দুই হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান। ধানের পাশাপাশি বাদাম,ভুট্টার জমির ব্যাপক ক্ষতি হয়। সে সময়ও ব্যাপক শ্রমিক সংকটের কারণে ধান ঘরে তুলতে বেগ পেতে হয় কৃষকদের। একই বছরে বোরো ধানের ক্ষতির কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আবার রোপা- আমন ধানের ওপর বিপর্যয় নেমে আসে। চলনবিলের অন্তত ৪০হাজার কৃষকের ১০হাজার হেক্টর জমির ধান পানির নিচে তলিয়ে যায়। এতে আরো চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয় চলনবিলের কৃষকদের। সে সময় সরকার থেকে আর্থিক সহযোগিতার পাশাপাশি অন্তত ৮হাজার কৃষককে কৃষি সহায়তা প্রনোদনা দেয়া হয়। কিন্তু ২০১৭-১৮ মৌসুমে আবারো বোরো ধান তলিয়ে যাওয়ার কারণে ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে কৃষকদের। গত তিন মৌসুমে একটানা ক্ষতির কারণে অনেকটা দিশেহারা এই অঞ্চলের কৃষকরা।
সিংড়া উপজেলা কৃষি অফিসার সাজ্জাদ হোসেন বলেন, যারা ধান কেটে জমিতে রেখে দিয়েছিল, অতি বর্ষণের কারণে তাদের ধানে গাছ উঠে গেছে। আর অত্র উপজেলার ঢলের পানি ও অতি বর্ষণে ১০ হেক্টর জমির ধান সম্পূর্ণ ও ৫০ হেক্টর জমির ধান আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং ৫০ হেক্টর কাচা ভূট্রা এখনও পানির নিচে রয়েছে।