নাটোর: নাটোরের গুরুদাসপুরের কৃষক আব্দুল জাবেদ ছিলেন গৃহস্থ। জমি বেশী না থাকলেও ফসল আবাদ করেই স্ত্রী ও দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে বেশ সুখেই কাটছিল তার সংসার। টেলিভিশনে বেশী ফসল উৎপন্নের খবর দেখে স্থানীয় ২০০ কৃষককে নিয়ে গড়েছিলেন পানাসীর সেচ প্রকল্প। সব ঠিকঠাক হলেও বিদ্যুৎ সংযোগ না পাওয়ায় সেই সুখের স্বপ্ন ভেস্তে যায়।
সেই প্রকল্পের গভীর নলকুপে পল্লী বিদ্যুতের সংযোগের অভাবে কৃষক জাবেদ এখন নিঃস্ব ! বিগত কয়েক বছর পানির অভাবে এই বিলের তিনশ বিঘা জমি অনাবাদী পড়ে থাকে। সরকারের পানাসী প্রকল্পের সহায়তায় সেখানে একটি গভীর নলকুপ স্থাপন করে সেচ দিয়ে ফসল ফলানোর সব উদ্যোগ নিয়েও ছয় বছর অপেক্ষা করেও চাহিদা মতো উৎকোচ দিতে না পারায় বিদ্যুতের সংযোগ পাওয়া যায়নি। প্রায় দুইশ’ চাষীকে নিয়ে যিনি সফলতার স্বপ্ন দেখতেন তিনি এখন দিন মুজুর হিসেবে অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। টাকার অভাবে এখন তার অনার্স পড়–য়া দুই ছেলে মেয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে না গিয়ে সারাদিন গার্মেন্টসে কাজ করে রাতে লেখাপড়া করে।
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, গুরুদাসপুর উপজেলার পাঁচপুরুলিয়া গ্রামের তোজাম্মেল খানের ছেলে কৃষক আব্দুল জাবেদ টেলিভিশনের খবর দেখে সরকারের পানাসী প্রকল্পের আওতায় ২০১২ সালে একটি গভীর নলকুপের আবেদন করে তা পেয়েও যান। বসানো হয় গভীর নলকূপ, তৈরী হয় পাকা ঘর, বিলের তিনশ বিঘা জমিতে মাটির তিন ফিট নিচ দিয়ে বসানো হয় পাইপ, পল্লী বিদুৎ থেকে সাতটি বড় পিলার (খাম্বা) কিনে বসানো হয় বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন। এসব করতে করতেই কৃষক আব্দুল জাবেদের সারাজীবনের অর্জন প্রায় সব টাকা শেষ হয়ে যায়। সব শেষে শুধু বিদ্যুৎ সংযোগ পেলেই যখন শুরু হবে কৃষি বিল্পব, সবুজে সবুজে ভরে যাবে মাঠ জাবেদ যখন এমন স্বপ্ন দেখা শুরু করেন তখন নাটোর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ (বনপাড়া) থেকে সংযোগের বিনিময়ে চাওয়া হয় ৫লাখ টাকা। এই টাকা আর তার পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। উল্টো গ্রামের প্রভাবশালী কৃষক আব্দুর রহিম দু’বছরের মাথায় মামলা করেন এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে।
মামলায় অভিযোগ করেন, প্রকল্পটি চালু হলে প্রকল্প এলাকায় চলা তার দুটি শ্যালো মেশিন বন্ধ হয়ে যাবে এবং সে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। কোর্ট তদন্তের মাধ্যমে সেই অভিযোগ অসত্য প্রমান হলেও এই গভীর নলকূপটিতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়নি। নিয়ম না থাকলেও সেচ প্রকল্পের জন্য করা এই বিদ্যুৎ লাইন থেকে ৭২টি বাড়িতে সংযোগ দেয়া হয়েছে, এরই মধ্যে আরো তিনটি অগভীর নলকূপেও সংযোগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু যার খরচে এই বৈদ্যুতিক লাইন তৈরী করা হয়েছে তার গভীর নলকূপটিতে আজো সংযোগ দেয়া হয়নি।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন নাটোরের গুরুদাসপুর জোনের সহকারী প্রকৌশলী (ক্ষুদ্রসেচ) দিল মোহাম্মদ সর্বশেষ গত ২৫ মে নাটোর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ (বনপাড়া) নিকট এই প্রকল্পে বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদানের জন্য যে অনুরোধপত্র পাঠান সেখানে উল্লেখ করেছেন, সংযোগটি না পাওয়ায় প্রকল্পের আওতাভুক্ত তিনশত বিঘা জমি পাঁচ বছর থেকে সেচ বঞ্চিত রয়েছে এবং প্রতি বছর দেড় হাজার মেট্রিকটন খাদ্য উৎপাদন ব্যবহত হয়েছে। সরকার যেখানে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ দেয়ার কথা বলছেন, সেখানে ছয় বছর থেকে একটি সংযোগ না দিয়ে অত বড় ক্ষতির পর বিষয়টি কেউ তাকিয়েও না দেখায় হতাশা প্রকাশ করছেন এলাকার সাধারন কৃষকরা।
ক্ষতিগ্রস্থ আব্দুল জাবেদ বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় বড় বড় জনপ্রতিধির কাছেও বার বার ছুটে গিয়েছেন কিন্তু প্রতিপক্ষ ক্ষমতাশালী হওয়ায় সাহস নিয়ে কেউ জাবেদের পাশে দাঁড়াননি।
জাবেদের ছেলে আলিফ জানান, টাকার অভাবে এখন তাদেরা দুই ভাইবোনের অনার্স পড়া বন্ধ হওয়ার পথে। লেখা পড়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য এখন তারা সারাদিন ঢাকা সাভারের দুটি গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করে রাতে লেখাপড়া করলেও কখনও ক্লাশ করার সুযোগ পাননা।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন নাটোরের গুরুদাসপুর জোনের সহকারী প্রকৌশলী (ক্ষুদ্রসেচ) দিল মোহাম্মদ এই প্রতিবেদককে বলেছেন, ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে কৃষক জাবেদ আলী অনেক টাকা খরচ করে সব কাজ সম্পন্ন করলেও শুধুমাত্র একটি সংযোগের অভাবে বেচারা নিঃস্ব হয়ে গেছেন, সেই সাথে এই বিলের তিনশ বিঘা জমিতেও পানির অভাবে চাষাবাদ করা যাচ্ছে না। সরকারের প্রকল্পটি সব কাজ সম্পন্ন করার পরও বিদ্যুৎ বিভাগের অনীহার কারনে চালু করা সম্ভব হয়নি।
এ ব্যাপারে কথা বলতে নাটোর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ (বনপাড়া) যোগাযোগ করলে জানা যায় সমিতির মহাব্যবস্থাপক শ্রী নিতাই রায় দুদকের মামলায় বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। পরে তার পদে চলতি দায়িত্বে থাকা লালপুরের ডিজিএম মোঃ মোমিনুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে বলেছেন, উৎকোচ দাবীর অভিযোগ তার জানা নেই। মাত্র তিন মাস থেকে তিনি দায়িত্বে আছেন। তারপরও বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহন করবেন।