নাটোর অফিস ॥
নাটোরের দিঘাপতিয়া রাজবাড়ির সামনে রাজা-রানিকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ছেন পথচারিরা। শিশু সহ সব বয়সী মানুষ ভির করছেন তাদের এক নজর দেখার জন্য। একুশ শতকে এসে রজকীয় পোশাক পরিধান অবস্থায় জীবন্ত রাজা-রানিকে দেখে তারা নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছেননা। অনেকের ধারনা এরা দিঘাপতিয়া রাজার কোন বংশধর কিনা। পথে দাঁড়িয়েই রাজা-রানির কথা শুনছিলেন সবাই। রাজা-রানি শ্বশরীরে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে প্রজাদের উদ্দেশ্যে “সরকারের উন্নয়নমলুক মূলক কর্মকান্ড ,দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের চরিত্র তুলে ধরা সহ দেশের উচ্চ পর্যায়ে যারা রয়েছেন তাদের বুদ্ধি ও সহযোগীতার মাধ্যমে দেশকে আরও সমৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করার পরামর্শ দিচ্ছেন। রানি বলছেন নারীদের ক্ষমতায়নের কথা। ততক্ষনে উপস্থিত পথচারিদের অনেকেই জেনে গেছেন যারা কথা বলছেন তারা কেউ এই দিঘাপতিয়া রাজার বংশধর নন। তারা রাষ্ট্রের কোন উচ্চ পর্যায়ের কর্তাব্যক্তি নন। সাধারন মানুষ। এদের কেউ কৃষক,শ্রমিক, স্বল্প আয়ের মানুষ। সখের বসেই তারা রং মেখে রাজা-রানি ও পাইক পেয়াদা সেজে পথ যাত্রা পালায় অংশ নিয়েছেন। পাইক-পেয়াদাসহ রাজা-রানি
দিঘাপতিয়া রাজবাড়ির প্রবেশ পথের সামনে রাজপথে দরবার বসিয়ে যে রাজকর্ম পরিচালনা করছিলেন তা ছিল ‘নবাবের দরবারে কপিলা’ নামের একটি যাত্রা পালার অংশ। তাদের পড়নের পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে অনেকের স্মৃতি পটে পুস্তকে পাওয়া রাজা-মহারাজার ইতিহাস ও শাসনামলের কথা মনে করেন। ৬০ মিনিটের এই পথযাত্রা উপভোগ করতে দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি যা বর্তমনের উত্তরা গণভবনের সামনে জড়ো হয়েছিলেন হাজারো মানুষ। এই রাজা-রানি ও পথ যাত্রা শিশুদের আনন্দ যোগায়। যাত্রাপালা কাকে বলে উপস্থিত শিশুদের কাছে ছিল আজানা। তারা রাজা-রানিকে দেখে মহা খুশী হয়। হাসিব নামের এক স্কুল শিক্ষার্থী জানায়,সে তার মায়ের এন্ড্রয়েড ফোনে ওই যাত্রা পালা ভিডিও করেছে। স্কুলের বন্ধুদের দেখাবে সে। তারাও জানেনা যাত্রাপালা কি? মায়ের হাত ধরে প্রাইভেট পড়ে বাড়ি ফিরছিল পঞ্চম শ্রেণীতে পড়–য়া মাফিউর। রাজা-রানিকে দেখে সে তার মাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। যাত্রাপালা সম্পর্কে কিছুই জানতো না সে। কোনদিন দেখেও নি সে। রাজা-রানিদের কথা জেনেছে বই পুস্তকে। আজ নিজের চোখে দেখে ভাল লেগেছে। যাত্রাপালা দেখেও আনন্দ পেয়েছি।
মাফিউরের মা বললেন,পরিবেশের কারনে তিনিও কখনো সরাসরি যাত্রা দেখেনি। আর পথ যাত্রাপালার কথা কখনও শোনেননি। আজই প্রথম সরাসরি দেখলেন। বেশ ভাল লেগেছে। এমন পরিবেশে যাত্রা পালার আয়োজন করা হলে আমরা মেয়েরা দেখার সুযোগ পেতাম।
পথের ধারে যাত্রা পালা দেখতে পেয়ে ভাল লেগেছে বলে জানালেন রিক্সা চালক আবু জাফর। প্রবীন এক স্কুল শিক্ষক বলেন, দীর্ঘদিন পরে এমন আয়োজন দেখে অনেক স্মৃতি মনে পড়ে গেল। পাকিস্তান আমলে গরুর গাড়িতে করে দুরের গ্রামে যাত্রা দেখতে গিয়েছি। এখন সব স্মৃতি। আধুনিক প্রযুক্তির আগ পর্যন্ত এবং অশ্লীলতা যতদিন পর্যন্ত যাত্রাপালাকে ঘিরে না ধরেছে ততদিন মানুষ আগ্রহের সাথে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে যাত্রা উপভোগ করত।
নাটোরের দিঘাপতিয়া রাজবাড়ির সামনে সঙ্গীতাঙ্গন নাটোর আয়োজিত এই পথযাত্রা “নবাবের দরবারে কপিলা” সকলকে বিমোহিত করে। যাত্রাপালাটির নির্দেশনায় ছিলেন কলেজ শিক্ষক পালাকার ফারুক হোসেন। রাজা-রানির ভুমিকায় অভিনয় করেন অপূর্ব রাহুল ও সোহানা রিতি। অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেন সুকুমার সরকার,সাদেক ঘরামি,অজয় কুন্ডু,কমসেত আলী , দুলাল হোসেন, ঘোষক: সাদেক ঘরামি,শামসুল আলম ,আব্দুর রহিম। শিশুশিল্পী: সাব্বির, ইয়াছিন, সোহাগ, প্রেমা। নাম ভূমিকায় কপিলা চরিত্রে: শাহনাজ বিথি। শিল্পনির্দেশনা: আব্দুল মালেক ও সুজিত ঠাকুর ।নৃত্য পরিচালনা: অপূর্ব রাহুল গীতিকার: সুজিৎ ঠাকুর ও ফারুক হোসেন। সুরকার: আওয়াল সরকার ও আব্দুল মালেক এবং সংগীতে ছিলেন : আব্দুল আওযাল, খোয়াজ উদ্দিন, জুমুল প্রামাণিক, রঞ্জিত সরকার ও রহিদুল ইসলাম।
দিঘাপতিয়া গ্রামের বাসিন্দা প্রবীণ খয়ের উদ্দিন জানান, যাত্রা পালাটি বেশ ভাল লেগেছে। ছোটবেলা থেকে বহু যাত্রা পালা দেখেছি। কালক্রমে যাত্রাপালা এখন হারিয়ে গেছে। প্রায় দুই যুগ পরে এমন আয়োজন দেখে মনে প্রফুল্লতা এলো। হৃদয়ের জানালায় অনেক স্মৃতি উঁকি দিয়েছে।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মাহাবুব খন্দকার বলেন, আবহমান গ্রাম বাংলার মাটি ও মানুষের অন্তরে গাথা, এই যাত্রাপালা। বিনোদনের জন্য এই যাত্রা পালা ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের সাক্ষী। অপসংস্কৃতি, অবহেলা, অনাদরে বিলীন হওয়ার পথে যাত্রাপালাকে ফিরিয়ে আনার এমন প্রচেষ্টার উদ্দোক্তাদের ধন্যবাদ জানালে খাটো করে দেখা হবে।
নাটোর সংগীতাঙ্গন এর সভাপতি আব্দুস সালাম বলেন, যাত্রাপালা আমাদের বাঙালি জাতির আদি সংস্কৃতি। বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী এই যাত্রাপালা হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। সুস্থ ধরার সংস্কৃতি মাধ্যমে, নাটোর সঙ্গীতাঙ্গন আবারও সেই যাত্রাপালা উজ্জীবিত করার প্রচেষ্টায় রয়েছে। গ্রামীণ এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে, সরকারিভাবে আরো সার্বিক সহযোগিতা প্রয়োজন বলে মনে করছেন, আয়োজকসহ নাটোরের সুশীল সমাজের নাগরিকরা। তা নাহলে এই যাত্রাপালা একেবারেই হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।
পালাকার ও নির্দেশক ফারুক হোসেন বলেন, “নবাবের দরবারে কপিলা’’ এই পথ যাত্রাপালা“চলন নাটুয়ার সপ্তম প্রযোজনা । পথযাত্রাপালায় যারা অভিনয় করেছেন তারা প্রত্যেকেই কৃষক, শ্রমিকসহ স্বল্প আয়ের মানুষ রয়েছে। সখের বসেই তারা এই পালার সাথে যুক্ত হয়েছেন। তিনি আর বলেন, চলন নাটুয়া সেই যাত্রাপালাকে সাধারণ মানুষের মধ্যে সমাজের অসঙ্গতি এবং শুভবার্তা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে ঐতিহ্যবাহী যাত্রাপালাকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এটি সারা বাংলাদেশে পরিবেশন করার সম্ভব হবে। ৫৬ মিনিটের এই পালাটি পথে-প্রান্তরে, হাটে, ঘাটে, মাঠে, বাড়ির আঙিনায় এমনকি ঘরের মধ্যেও এটি পরিবেশন করা সম্ভব। খেটে খাওয়া বা পা ফাটা মানুষের সংগঠন চলন নাটুয়া গত সাত বছর ধরে যাত্রাপালা পরিবেশন করে আসছে। চরিত্র হিসেবে মনোযোগ আকর্ষণের জন্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত চরিত্র কপিলাকে ব্যবহার করা হয়েছে। যা নারীর ক্ষমতায়নের প্রতীক। ট্রানজেন্ডাররাও অর্থাৎ তৃতীয় লিঙ্গের একজনও মন্ত্রিত্বের সমাজে অবদান রাখতে পারে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বর্তমান দেশের পরিস্থিতিকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। এক কথায় বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণের স্বপ্নকে এ পালার উপজীব্য করা হয়েছে।
শনিবার উত্তরা গণভবন তথা দিঘাপতিয়া রাজবাড়ির সামনে এই পথ যাত্রা পালা দেখতে হাজির ছিলেন সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক শরিফুল ইসলাম রমজান, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান খন্দকার শরীফুল ইসলাম বিদ্যুতসহ গণমাধ্যম ও এনজিও কর্মীসহ বিশিষ্টজন।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শরীফুল ইসলাম রমজান বলেন, বহুদিন পর এই পথ যাত্রাপালা দেখে বেশ ভাল লেগেছে। এদের উপস্থাপনায় মুন্সিয়ানার ছাপ লক্ষ্য করা গেছে। যাত্রাপালার মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন অসংগতি তুলে ধরে মানুষকে সচেতন করছে।এটি গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য, বাঙ্গালীদের কৃষ্টি ও কালচার। এটি প্রতিবাদের একটি মাধ্যম। বাঙ্গালেিদর আদি সংস্কৃতি এটি। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চক্রান্ত বা ষড়যন্ত্র না করে, রাষ্ট্রিয় সম্পদে অগ্নিসংযোগ না করে ,জীবন মানের ব্যঘাত না ঘটিয়ে সমাজের অসংগতি যাত্রাপালার মাধ্যমে এবং পরিবেশনার মাধ্যমে তারা তুলে ধরছে।এতে করে আমাদের সমাজ উপকৃত হবে এবং আমাদের সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হবে। তারা যেটি উত্তরাঞ্চলে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন সেই উত্তরা গণভবনের সামনে বসে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষনা যেমন এক ইঞ্চি জমি ফেলে রাখা যাবেনা এবং বৈশ্বি মহামারি ও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারনে দ্রব্যমুল্যের উর্ধগতি সহ বিভিন্ন বিষয় তারা তুলে ধরছে এই পথ যাত্রাপালার মাধ্যমে। শিশুরা যেমন রাজা-রানিকে দেখে খুশী হচ্ছেন, তেমনি এই পথযাত্রাপালার উপস্থানার বিষয় জেনে মানুষ উপকৃত হচ্ছে। আমরাও উপভোগ করছি। বেশ ভাল লাগছে তাদের যাত্রা পালা। এমনটিই হওয়া উচিত বলে তিনি মনে করছেন। আমি মনে করি আমাদের হঠকারি, সন্ত্রাস,নৈরাজ্য,অগ্নিসংযোগ ,দুর্বৃত্ত্যায়ন,এগুলো ছেড়ে দিয়ে এভাবে মানুষকে সচেতন করা এবং রাষ্ট্রকেও সতর্ক বার্তা দেয়া । এটাই হওয়া উচিত । কেননা আবহমান কাল থেকে হাজার বছরেরর বাঙ্গালীর যে সংস্কৃতি তা এমনই ছিল। প্রতিবাদের ধরনও এমন হওয়া উচিত।