নাটোর অফিস॥
‘বাবাকে হারিয়েছি অনেকদিন আগে। মা থাকেন বাবার রেখে যাওয়া শেষ সম্বল খুপরি ঘরে। দীর্ঘদিন ধরে খালার বাসায় বাস করছি। কখনো ভাবিনি এত ধুমধামে আমার মতো এতিম মেয়ের বিয়ে হবে। আজ বুঝলাম, যার কেউ নেই-তার আল্লাহ আছেন। বৃহস্পতিবার নাটোরের লালপুর উপজেলার কদমচিলান ইউনিয়নের পালোহারা গ্রামে বিয়ের আসরে কথা গুলো বলছিলেন কনে এতিম মেয়ে রিমা খাতুন। জমকালো আয়োজনে দুইদিনব্যাপী রিমা খাতুনের বিবাহের মধ্য দিয়ে এ পর্যন্ত ৬৫জন গরীব অসহায় এতিম মেয়ের বিয়ে দিলেন ব্যবসায়ী রুহুল আমীন রুবেল।
জমকালো সাজসজ্জা, গেট, কনে ও বরের স্টেজ, কনে সাজানোর জন্য বিউটিশিয়ান, ভিডিও ধারণ-কোনো কিছুরই যেন কমতি ছিলো না লালপুর উপজেলার কদমচিলান ইউনিয়নের পালোহারা গ্রামের এতিম মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে। সাজসজ্জার পাশাপাশি বরযাত্রীসহ আমন্ত্রিত প্রায় ২০০শ অতিথির মধ্যে উন্নতমানের খাবারের পাশাপাশি চাইনিজ খাবারও পরিবেশন করা হয়। অনুষ্ঠান শেষে পূর্বের মত এতিম মেয়ে রিমাকে তুলে দেওয়া হয় স্বামীর হাতে।
স্থানীয়রা জানান, বাবা মারা যাওয়ার পর দীর্ঘদিন যাবৎ খালার বাড়িতে আশ্রয়ে ছিলো রিমা খাতুন (২০)। অর্থের অভাবে মেয়ের বিয়ে নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় ছিলো রিমা’র মা রেহেনা বেগম। মাঝে মাঝে বোনের বাসায় রেখে যাওয়া মেয়েকে দেখতে আসতেন তিনি। মেয়েকে দেখার পরপরই শুরু হতো কান্না। বেশকিছুদিন আগে স্থানীয়রা বড়াইগ্রাম উপজেলার চন্ডিপুর গ্রামের ব্যবসায়ী মানবিক ব্যক্তিত্ব মোঃ রুহুল আমীন রুবেলের সন্ধান দিলে তার সাথে যোগাযোগ করে রিমার মা। পরবর্তীতে রুহুল আমীন রুবেল ১৫ই মার্চ হলুদ সন্ধা ও ১৬ই মার্চ বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করতে বলেন তার মাকে। বিয়ের যাবতীয় খরচ তিনি দিবেন বলে জানিয়ে দেন। মা রেহেনা বেগম খুশি হয়ে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করেন।
বৃস্পতিবার দুপুরে বিয়ে বাড়িতে গিয়ে দেখাযায়, জমকালো আলোকসজ্জা গেট, রাস্তার পাশে মাইক্রো,হাইস ও মোটরসাইকেল সারি সারি। দেখে মনে হচ্ছিলো কোন বিত্ত¦শালী ব্যক্তির মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান। চলছিলো আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য রান্না’র আয়োজন। রান্না হচ্ছিলো বিভিন্ন প্রকারের উন্নত মানের খাবার। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে একটি রুমে দেখাযায় কনেকে সাজানোর কাজে ব্যস্ত একজন বিউটিশিয়ান। ইতিমধ্যেই বরের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে জমকালো স্টেজ। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিয়ে বাড়িতে একটি হাইচ গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করলো বরযাত্রীরা। বর পাশ^বর্তী পুকুর পাড়া গ্রামের রহমান আলীর ছেলে মোঃ পলাশ আলী। তিনি রুপপুর ইপিজেডে চাকুরী করেন। বরকে দামি ব্রান্ডের একটি ঘড়ি দিয়ে বরণ করলেন ব্যবসায়ী রুহুল আমীন রুবেলের চাচা। তারপর নিয়ে আসা হলো বরের আসনে। সেখানেও যেন আতিথিওতার কোন কমতি ছিলোনা। এরপরে বরযাত্রী ও আমন্ত্রিত অতিথিদের খাবার পরিবেশন করা হলো। বেশ ভালো ভাবেই উপস্থিত সকলে খাবার খেয়ে প্রশংসা করলেন। এরপর ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক বিয়ে পড়ানো হয়। বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পরে স্বামীর হাতে তুলে দেওয়া হয় কনেকে।
কনের মা রেহেনা বেগম আবেগ আপ্লুত হয়ে জানালেন, কখনও ভাবেননি তার মেয়ের এত বড় আয়োজনে বিয়ে হবে। ব্যবসায়ী রুহুল আমীনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি।
স্থানীয় ব্যক্তি মামুন হোসেন জানান, ‘ব্যবসায়ী রুহুল আমীন রুবেল ভাইয়ের এমন মানবিক কাজ সত্যিই প্রশংসনীয়। আমি নিজেই রুবেল ভাইয়ের উদ্যোগে বিয়ে দেওয়া প্রায় ২০টি মেয়ের বিয়েতে অংশগ্রহণ করেছি। তার এই মানবিক কার্যক্রম অব্যাহত থাকুক।’
বিয়ের অনুষ্ঠানের বাবুর্চি মোঃ আব্দুর রশিদ জানালেন,‘দয়রামপুর বাজারে ভোজন বিলাশ নামে একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্ট তিনি পরিচালনা করেন। রুহুল আমীন রুবেল ভাইয়ের এ পর্যন্ত ৬৫টি গরীব অসহায় মেয়ের বিবাহ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। প্রায় প্রতিটি বিয়েতে আমি রান্না করেছি এবং রান্নার জন্য কোন রকম পারিশ্রমিক নেইনি। কারণ রুবেল ভাইয়ের সাথে এমন মানবিক কাজে অংশিদার হতে পেরে আমি নিজেও খুব আনন্দিত।’
ব্যবসায়ী রুহুল আমীন রুবেল বলেন, ‘মহান আল্লাহ পাকের অশেষ কৃপায় আমি এ পর্যন্ত ৬৫টি মেয়ের বিবাহ সম্পন্ন করতে পেরেছি। ২০০৫ সাল থেকে আমার এই যাত্রা শুরু। গরীব, অসহায়, এতিম মেয়েদের বিবাহের পাশাপাশি সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার আমার নিজ এলাকার দুস্থ্য মানুষদের মাঝে খাবার বিতরণ করে আসছি বিগত ১৭ বছর যাবৎ। এছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঈদ, বিশেষ দিনসহ বিভিন্ন সময় মানুষদের পাশে দাড়িয়ে সহযোগিতা করি।’ কেন এই মানবিক বা সহযোগিতা কার্যক্রম করেন? বা এসকল কার্যক্রমে ব্যয়কৃত অর্থ কোথা থেকে আপনি উপার্জন করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘আমি আমার বাবার আদর্শ নিয়ে চলি। আমার বাবা মৃতঃ মোয়াজ্জেম হোসেন সরকার বেঁচে থাকা কালিন এসকল কার্যক্রম করেছেন। মানুষকে ভালোবেসেছেন তাই তার ছেলে হয়ে আমিও এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছি। বাবার রেখে যাওয়া জমি-জমা,ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে যা আয় করি সংসার পরিচালনার পাশাপাশি সেই অর্থ দিয়েই এই কার্যক্রম গুলো করে থাকি। যতদিন বেঁচে আছি ততদিন এই কার্যক্রম চলমান যেন রাখতে পারি তার জন্য সকলেই দোয়া করবেন।’ রাজনীতিতে আসার কোন পরিকল্পনা আছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন,‘মানুষের সেবা করার ইচ্ছা থাকলে যে কোন অবস্থা থেকেই করা যায়। আমি কখনও রাজনীতিতে আসতে চাইনা। নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আর গরীব অসহায়দের সেবা করেই বেঁচে থাকতে চাই। সমাজের সকল বিত্ত্ববানরা তাদের আশপাশের গরীব অসহায় দুস্থ্য মানুষদের পাশে দাড়ালে হাজারো মানুষ ভাল ভাবে খেয়ে বেঁচে থাকতে পারবে। তাই আসুন নিজ নিজ অবস্থান থেকে সকলেই তাদের পাশে দাড়াই।’