নবীউর রহমান পিপলু,নাটোর
নাটোরের দিঘাপতিয়া রাজবাড়ির ঘড়িটি প্রায় দু’শ বছর ধরে নির্ঘুম সময় দিয়ে যাচ্ছে। এই বিশাল রাজ প্রাসাদের একমাত্র প্রবেশ পথের ঢুকতেই চোখে পড়ে প্রকান্ড এক লোহার দরজা। প্রবেশ পথের দরজার ওপর শোভা পাচ্ছে প্রাচীন কালের বিশাল এক ঘড়ি। ঘড়িটি এখনও চলছে।
মহারাজা রামজীবন ও রানী ভবানীর দেওয়ান দয়ারাম রায় এই দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। দয়ারাম রায় ছিলেন তিলি সম্প্রদায়ের। মহিয়সী নারী রানী ভবানী তার সারাজীবনের কর্মকান্ডের বিশ্বস্ততার পুরস্কার হিসেবে তাকে দয়ারামপুর স্টেট ও দিঘাপতিয়া তালুক দান করেন।
নাটোর শহর থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার উত্তর পুর্ব কোণে ১ শ ২৫ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এই রাজ প্রাসাদ। প্রাসাদটি বেশ সাজানো। চারিদিকে সুইচ্চ প্রাচীর। ভিতরে রয়েছে রাজ প্রাসাদ। ভেতরে দেশী বিদেশী নানা প্রজাতির বৃক্ষ শোভা পাচ্ছে। প্রাচীর সংলগ্ন গোটা রাজপ্রাসাদের চারিদিকে রয়েছে পরিখা। সামনে রয়েছে ছোট-বড় কয়েকটি কামান। মুর্শিদকুলি খাঁর রাজত্বকালে যশোরের মুহম্মদপুরে রাজা সীতারাম বিদ্রোহ করলে দয়ারাম রায় নবাব সৈন্যের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেন এবং সীতারামকে পরাজিত করে বন্দিরে নাটোরে নিয়ে আসেন। এসময় লুন্ঠিত প্রচুর পরিমানের ধনরতœও সঙ্গে নিয়ে আসেন। নবাব তাকে তার সাহসিকতা ও সততার জন্য ‘এনাম ’ হিসেবে একটি তালুক দান করেন। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি এই দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। প্রাসাদের চারিদিকে বেশ কয়েকটি মুর্তি বসানো রয়েছে।আছে কৃত্রিম ঝরনা। ১৭৬০ সালে দয়ারাম রায়ের মৃত্যুর পর পুত্র জগন্নাথ রায় রাজা হন। পরবর্তীতে তার পুত্র প্রাণনাথ রায় রাজা হন। নি:সন্তান প্রাণনাথের মৃত্যুর পর দত্তক পুত্র প্রসন্ন নাথ রায় রাজ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার সময়ে দিঘাপতিয়া রাজবাড়ির উন্নতি হয় ও সম্প্রসারন ঘটে। ১৮৮৭ সালে ভুমিকম্পে এই রাজবাড়ি ধংস হলে রাজা প্রমদানাথ রায় দিঘাপতিয়া রাজবাড়িটি নতুনভাবে সুসজ্জিত করেন। এই বংশের ৭ পুরুষ রাজা হিসেবে পর্যায়ক্রমে এই রাজবাড়ির দায়িত্ব পালন করেন। দেশভাগের সময় এই রাজবংশ ভারতে চলে যান। এরপর ষাটের দশকে এটিকে গর্ভনর হাউস হিসেবে ঘোষনা করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারী জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এটিকে গণভবন হিসেবে ঘোষনা দেন। পুর্বের দিঘাপতিয়া রাজবাড়ির বর্তমান নাম উত্তরা গণভবন।
জনশ্রুতি রয়েছে,রাজা প্রমদানাথ রায়ের ঘড়ি ও বাড়ি প্রিতি ছিল। তিনি বিদেশ থেকে নানা ধরনের ঘড়ি তৈরী করে এনে প্রাসাদের বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করতেন। এমন একটি ঘড়ি ছিল যা ১৫ মিনিট পর পর জলতরঙ্গের সুর ছড়িয়ে বেজে উঠত। রাজবাড়ির প্রবেশদ্বারের ওপর প্রকান্ড ঘড়িটিও বিদেশ থেকে এনে স্থাপন করা হয়। ইতালির ফ্লোরেন্স থেকে ঘড়িটি আনা হয়। বেশ কয়েক বছর আগে ঘড়িটি নষ্ট হয়ে যায়। পরে বিশেষজ্ঞ আনিয়ে সারিয়ে নেওয়া হয়।
উত্তরা গণভবণের হিসাব সহায়ক নুর মোহম্মদ জানান, গণপুর্ত বিভাগের প্রকৌশলীদের সহায়তায় নষ্ট ঘড়ির বেশ কিছু যন্ত্রাংশ দেশেই তৈরি করা হয়। যা সংযোজনের পর ঘড়িটি আবার সময় দিয়ে যাচ্ছে।
নাটোর গণপুর্ত বিভাগের কর্মচারী উত্তরা গণভবনের সাবেক তত্বাধায়ক সবুর খান জানান,বহু প্রাচীন এই ঘড়িটির যন্ত্রাংশ পাওয়া যায়না। ঘড়িটি নষ্ট হয়নি। ঘন্টা ও মিনিটের কাাঁটা চলতে গিয়ে আংশিক ক্ষয় হয়ে যায়। পরে তা সারিয়ে নেওয়া হয়। এখন ঘড়িটি ঠিক সময় দিয়ে যাচ্ছে।
উত্তরা গণভবনের সহকারি ব্যবস্থাপক খায়রুল বাশার জানান, করোনা মহামারির আগে ঘড়িটির মেকানিক্যাল সমস্যা দেখা দেয়। পরবর্তীতে জেলা প্রশাসন ও গণপুর্ত বিভাগ যৌথভাবে একটি কমিটি করে সমস্যা নির্নয় করে ঘড়িটি মেরামতের উদ্দোগ নেয়া হয়। যেহেতু ্এই ঘড়ির কোন যন্ত্রাংশ এখন বাজারে পাওয়া যায়না। সেকারনে গণর্পুতর্ বিভাগের প্রকৌশলীদের সহায়তায় দেশেই এই ঘড়ির নষ্ট হওয়া যন্ত্রাংশ তৈরি করা হয়। বর্তমানে ঘড়িটি আগের মত সময় দিয়ে যাচ্ছে। প্রতি সপ্তাহে একবার করে ঘড়িতে চাবি দিতে হয়। গণপুর্ত বিভাগ এই কাজটি করে থাকে। সোমবার করে এক ঘড়িম্যান এসে ঘড়িতে চাবি দিয়ে যায়। চাবি দেওয়ার পর ঘড়ি এক সপ্তাহ সচল থাকে। ঘড়িটি এখন নিয়মিত ঘন্টাধনি সহ সময় দিয়ে যাচ্ছে।
উত্তরা গণভবন সংলগ্ন বাসিন্দা প্রবীন ব্যক্তি সাদেক আলী জানান, গণভবনে ঢোকার গেটে রাজার সময়কার ওই ঘড়িটির এক পাশের ক্ষয়ে যাওয়া ঘন্টার কাটা সামান্য দেরীতে চলছে।
স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুস সালাম জানান, আগে বহুদুর থেকে ঘড়িটির ঘন্টাধ্বনি শোনা যেত। কিন্তু এখন দুর থেকে ঘন্টাধ্বনি শোনা না গেলেও ঘড়িটি প্রায় দু’শ বছর ধরে দিনরাত ঠিক সময় দিয়ে যাচ্ছে।
উত্তরা গণভবনের উত্তর পাশে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দুরের গ্রাম সিংড়া উপজেলার ভাগনগরকান্দি গ্রামের বাসিন্দা সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আদেশ আলী বলেন, দেশ স্বাধীনের পরও আমাদের বাড়ি থেকে রাজবাড়ির এই ঘড়ির ঘন্টাধনি শোনা যেতো। তারা শিশুকালে এই ঘড়ির ঘন্টা ধনি শুনে স্কুলে গিয়েছেন। বাড়ির প্রবীনরা পবিত্র রমজান মাসে ভোর রাতে এই ঘড়ির ঘন্টাধনি শুনে সেহেরি খেয়েছেন। উত্তরা গণভবনের প্রবেশ গেটে এখনও সেই ঘড়ি শোভা পাচ্ছে। প্রায় দু’শ বছর ধরে নির্ঘুম সময় দিয়ে যাচ্ছে। তবে দুর থেকে সেই ঘন্টা ধনি এখন আর শোনা যায়না।
জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, ইতিহাস ঐতিহ্যের জেলা নাটোরে প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থী আসেন। তারা উত্তরা গণভবন সহ দর্শনীয় স্থানগুলো দেখে বিমোহিত হন। উত্তরা গণভবন সহ গণভবনের প্রবেশ গেটের প্রায় দুশ বছরের ঘড়িটি দেখতেও অনেকেই ছুটে আসেন এই উত্তরা গণভবনে। এই ঘড়ির সময়ের সাথে অনেকেই তাদের ঘড়ির মিল খুজে দেখেন। সময়ের প্রায় মিল থাকায় অনেকেই খুশী হন। অনেকে ঘড়ির ঘন্টাধনি ভিডিও করে নিয়ে যান। ঘড়িটি যে ঝুঁকিমুক্ত থাকে এজন্য ঘড়ি ঘর সার্বক্ষনিক তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। ঘড়ির নিরাপত্তায় নিয়োজিত রক্ষিরাও সর্বদা সর্তক থাকেন ।