নাটোর: এক যুগ রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির একচেটিয়া রাজনীতি ছিলো চলনবিল অধ্যুষিত নাটোরের সিংড়ায়। ২০০৬ সালে ক্ষমতা ছাড়ার পর থেকে সিংড়া থেকে নির্বাচিত হতে পারেননি তাদের কোন সাংসদ। তবে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ছিলো দল সমর্থিত পৌর মেয়র ও উপজেলা চেয়ারম্যান। দুই জনপ্রতিনিধির অকালমৃত্যু স্থানীয়ভাবে দলীয় নেতৃত্বকে কোণঠাসা করলেও বছরের শুরু থেকেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্ততি নিয়ে ধীরে ধীরে সংগঠিত হচ্ছিল সিংড়া বিএনপি। তবে নির্বাচনের আড়াই মাস আগেই শুরু হল বিএনপির গৃহদাহ।
সিংড়া বিএনপির তৃণমূল নেতাদের মতে, ‘নিয়ন্ত্রিত রাজনীতি’র সিংড়ায় যখন একটু একটু করে কর্মীরা দলীয় কর্মকান্ডে সক্রিয় হচ্ছিলেন, তখনই ‘গাড়ি চোর চক্র’ ও ‘আঁতাত’র রাজনীতি করা পৌর বিএনপির সভাপতি দাউদার মাহমুদকে দেয়া হয়েছে উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক পদের মতো শীর্ষ একটি পদের দায়িত্ব। দলীয় গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন ও তৃণমূল নেতাকর্মীদের মতামত উপেক্ষা করে এ টাকার বিনিময়ে এ পদটি বিক্রি করেছেন দলের কেন্দ্রিয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও নাটোর জেলা বিএনপি সভাপতি এডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু।
বিভিন্ন সময়ে দলীয় কর্মসূচীতে অংশ নেয়া ত্যাগী কর্মীদের মতামত উপেক্ষা করে সাধারণ সম্পাদক পদে দুলু তার পছন্দের আশীর্বাদপুষ্ট দাউদার মাহমুদকে বসিয়েছেন। অথচ দাউদারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সাথে লিয়াজোর মাধ্যমে রাজনীতি করার অভিযোগ রয়েছে তৃণমূলের।
দুলুর নিকট তৃণমূল কর্মীদের দাবী পৌছে দাউদার মাহমুদকে দলের সাধারণ সম্পাদক না করার অনুরোধও রাখা হয়নি বলে দাবী করেছেন স্থানীয় নেতৃবৃন্দ।
তাই এবার ক্ষুদ্ধ নেতা-কর্মীরাই সিংড়ায় দুলুকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন। সিংড়া উপজেলা, পৌর বিএনপি ও এর সকল অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা বুধবার বেলা ১২টার দিকে সিংড়া শহরের গোডাউনপাড়া এলাকায় পৌর বিএনপির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ ঘোষণা দেন। এছাড়া সিংড়ায় দলের নীতিনির্ধারণে বহিরাগত নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপ পরিহার করতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেন পৌর বিএনপির সভাপতি দাউদার মাহমুদকে বহিষ্কারের দাবী জানানো হয়েছে।
সিংড়া উপজেলা বিএনপি সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ৭ জানুয়ারী সিংড়া উপজেলা ও পৌর কমিটি গঠনের পর পরই উপজেলা বিএনপির সাধারন সম্পাদক সাবেক পৌর মেয়র শামীম আল রাজি আকস্মিক মৃত্যুবরণ করেন। সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কমিটির যুগ্ম সাধারন সম্পাদক ইব্রাহিম খলিল ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। কিন্তু হঠাৎ করে পৌর বিএনপির সভাপতি দাউদার মাহমুদকে সাধারন সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব দেন জেলা বিএনপির সভাপতি কেন্দ্রিয় সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু। ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায় উপজেলা, পৌর বিএনপি সহ সকল অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা কর্মীরা। এই অবস্থায় গত ১৮ সেপ্টেম্বর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশের অজুহাত দেখিয়ে দাউদার মাহমুদকে উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক করা হয়। সে সময় দুলু বিপুল অংকের টাকার বিনিময়ে দাউদার মাহমুদ এর কাছে পদ বিক্রি করে দেয়। এরপর থেকেই সিংড়া বিএনপির মূল ধারার নেতা-কর্মীরা দাউদার মাহমুদকে বহিষ্কারের দাবী জানিয়ে আসছে। এর মধ্যে বিক্ষোভ মিছিল, সংবাদ সম্মেলনে করেছে মূল ধারার বিএনপির নেতা-কর্মীরা। সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী চলতি মাসের ৫ তারিখে ঢাকায় গিয়ে রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর কাছে অনুরোধ জানান। তখন তিনি আশ্বস্তও করেন। কিন্তু ঢাকা থেকে ফিরে আসার মাত্র ১১ দিনের মাথায় তৃণমূল নেতাকর্মীদের মতামত উপেক্ষা করে দাউদার মাহমুদকে উপজেলা বিএনপির সাধারন সম্পাদক হিবে দায়িত্ব দেন তিনি।
সিংড়া বিএনপির অন্তত দশজন দায়িত্বশীল নেতা জানান, দাউদার মাহমুদকে সিংড়া পৌর বিএনপির সভাপতি করার পর থেকে তিনি আওয়ামী লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে চলছেন। দাউদার আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় রাজনীতি করে চলছেন বহাল তবিয়তে। এ কারণেই সিংড়ায় দাউদার মাহমুদ ছাড়া বিএনপির কোন নেতার ব্যানার ফেস্টুন থাকে না। এ সুযোগ নিয়েই দাউদার মাহমুদ দলে বিভক্তি সৃষ্টি করে আসছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, দাউদার মাহমুদ একজন আর্র্ন্তজাতিক গাড়ী চোর চক্রের সদস্য। তার নামে একাধিক গাড়ী চুরির মামলা রয়েছে। আগামী জানুয়ারী মাসে গাড়ী চুরির একটি মামলার রায় হবে। এ বিষয়ে দুলুর কাছে সকল প্রমাণ দেয়া আছে। কিন্তু তারপরও সে দাউদারকে সাধারণ সম্পাদক করেছে।
উপজেলা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক হারুনর রশীদ বলেন, ‘রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু কেন্দ্রিয় নেতা হয়েও সংগঠনের গঠনতন্ত্র বিরোধী কাজ করেছেন। সিংড়ার বিএনপি সংগঠিত শক্তিশালী । তৃণমুল নেতা কর্মীরা যখন ঐক্যবদ্ধ তখন রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু তার অগনতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে এই সিদ্ধান্ত নেতা কর্মীদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে আওয়ামীলীগের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে দাউদার মাহমুদকে দায়িত্ব দিয়েছেন। দাউদার দিনে বিএনপি রাতে আওয়ামীলীগের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে। এই দাউদার মাহমুদ স্থানীয় আওয়ামীলীগ এমপির দোসর। গাড়ি চুরি অপরাধে র্যাবের হাতে আটক এবং ট্রাক বোঝাই ডাল ছিনতাইয়ের অভিযোগ থেকে দাউদার মাহমুদ তার বন্ধু আওয়ামীলীগ এমপির মাধ্যমে ছাড়া পান। দুলুর এই সিদ্ধান্ত সিংড়ার ঐক্যবদ্ধ বিএনপিকে দুর্বল করবে।’
উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম খলিল ফটিক বলেন, ‘সিংড়া বিএনপির সার্বিক হালচাল তুলে ধরে গত ৫অক্টোবর ঢাকায় দুলুর সাথে সকল নেতা-কর্মী নিয়ে আমরা মিটিং করি। সেখানে দুলু ওযু অবস্থায় সিংড়া বিএনপিকে রক্ষার জন্য প্রতিশ্রুতি দেন। তবুও দুলু মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে দাউদার মাহমুদ এর কাছে উপজেলা বিএনপির পদ বিক্রি করে দিয়েছেন। দুলু বিএনপি রক্ষা করার পরিবর্তে নেতা-কর্মীদের ওপর স্টীম রোলার চালিয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদক ইব্রাহিম খলিল ফটিক, উপজেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি মহিদুল ইসলাম, থানা বিএনপি সহ-সভাপতি শাহাদৎ হোসেন, মহিলা দলের সভানেত্রী ডেইজি আহমেদ, পৌর বিএনপির সাবেক সাধারন সম্পাদক আনোয়ারুল ইসলাম আনু, অ্যাডভোকেট আলী আসগর, প্রফেসর হারুনর রশীদ, উপাধ্যক্ষ রেজাউল করিম পৌর বিএনপির সাধারন সম্পাদক সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর তাইজুল ইসলাম, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান শামীম আহমেদ, সহ বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের শতাধিক নেতা কর্মী উপস্থিত ছিলেন।
বিএনপির কেন্দ্রিয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা বিএনপির সভাপতি রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু এমন অভিযোগকে হাস্যকর বলে উল্লেখ করে বলেন, ‘শামিম আল রাজির মৃত্যুর কারণে তার শূন্য পদে হাই কমান্ডের নির্দেশে দাউদার মাহমুদকে সিংড়া থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে। পদের জন্য দাবীদার যারা ছিলেন তারা হয়ত ওই পদ না পেয়ে ক্ষুদ্ধ হয়ে এমন অভিযোগ তুলছেন। বড় দলে এমন ঘটনা ঘটা স্বাভাবিক।। সাময়িক অভিমান হয়েছে। কদিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে। আগামী নির্বাচনে ধানের শীষের পক্ষে সকলে একসাথে কাঁধে কাধ মিলিয়ে কাজ করবে। কোন বিভেদ থাকবেনা। এবার বিএনপিকে সবাই ক্ষমতায় দেখতে চায়।’