নাটোর অফিস॥
নাটোরের শস্যভান্ডার খ্যাত চলনবিলের সিংড়া উপজেলার ফসলি জমি গিলে খাচ্ছে মাটি খেকো প্রভাবশালী ভেকু ব্যবসায়ীরা। কৃষি জমিতে কোন ভাবেই পুকুর খনন বন্ধ হচ্ছে না। মোটা অংকের টাকা নিয়ে চুক্তির মাধ্যমে রাতারাতি কৃষি জমি গিলে খাচ্ছে এক শ্রেণির প্রভাবশালী ভেকু ব্যবসায়ী। পুকুর খননে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।তবে জনপ্রতিনিধিরা এই অভিযোগকে মিথ্যা ও বানোয়াট বলে দাবি করেছেন।
এদিকে পুকুর খননের এসব মাটি খোলা ড্রাম ট্রাক ও ট্রাক্টরে করে বহনের কারনে নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সরকারি পাকা রাস্তাসহ বিভিন্ন গ্রামীন সড়ক।অন্যদিকে অবাধে পুকুর খননের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্টের পাশাপাশি ক্রমাগত কৃষি জমি কমছে। দ্রুতই কার্যকরী পদক্ষেপ না নেয়া গেলে চলনবিল থেকে কৃষির বিপর্যয়ের শংকা প্রকাশ করেছেন কৃষিবিদসহ পরিবেশবিদরা।
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় একশ্রেণির এস্কেভেটর (ভেকু) ব্যবসায়ীরা চুক্তিভিত্তিক ভাবে রাতারাতি কৃষি জমি গিলে খাচ্ছে। আর কিছু অসাধু ব্যক্তি এখান থেকে তাদের পকেট ভরছে।
রোববার সিংড়া উপজেলার চামারী ইউনিয়নের চকলংকাপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায় দুটি এস্কেভেটর (ভেকু) দিয়ে কৃষি জমির ওপরের পলি মাটি ভরে ড্রাম ট্রাক ও ট্রাক্টরে করে বিভিন্ন গ্রামে বিক্রির উৎসব চলছে। এতে চকলংকাপুর, চক কালিকাপুর, সোনাপুর, মহিষমারীর এলাকার পাকা ও আধাপাকা গ্রামীণ রাস্তাগুলো মাটিতে নষ্ট হচ্ছে। চলাচলে ভোগান্তি পোহাচ্ছে এলাকার সাধারণ জনগণ ও ছোট-খাট যানবাহন।
চককালিকাপুর পাকা রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে কয়েকজন ব্যক্তির সাথে কথা হলে তারা জানান, স্যার আমাদের নাম লিখে বিপদে ফেলবেন না। এলাকার চেয়ারম্যান সাহেব চকলংকাপুর গ্রামে একটি বিলাশ আকৃতির পুকুর খনন করে মাটি বিক্রি করছেন। আর সেই মাটিতে এলাকার সকল রাস্তা-ঘাট নষ্ট হচ্ছে। আর যারা ড্রাম ট্রাক ও ট্রাক্টর দিয়ে মাটি বহন করছেন তারা খুব খারাপ প্রকৃতির লোক। তাদের ভয়ে কেহ কথা বলতে চায় না।
কিছুদূর এগিয়ে মাটি বহনকারী ড্রাম ট্রাক ও ট্রাক্টরের ছবি তুলতে গেলে রাস্তায় পার্শ্বে দাঁড়িয়ে থাকা কালিনগর গ্রামের সেন্টু মিয়া এই প্রতিবেদককে উদ্দেশ্য করে বলেন, ছবি তুলছেন কেন? কি সমস্যা আপনার। এই পুকুর খনন করছেন চামারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান স্বপন মোল্লা । আর সার্বিক দায়িত্বে রয়েছেন সাবেক ইউপি সদস্য আরিফুল ইসলাম। তাদের কথায় এখানে সব হয়। আপনার কোন খরচ লাগলে ইউপি সদস্য আরিফুলের সাথে দেখা করেন।
এরপর সামনে কিছুদুর এগিয়ে দেখা যায় বিলের ভেতর দিয়ে আধা কিলোমিটার কৃষি জমি নষ্ট করে বিশাল আকৃতির একটি পুকুর খনন চলছে। সেটি প্রায় ১৫ থেকে ২০ বিঘার কৃষি জমি। জমির মালিক আলহাজ্ব আব্বাস উদ্দিন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয়রা জানান,স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান স্বপন মোল্লা দায়িত্ব নিয়ে এই পুকুর খনন করে দিচ্ছেন। মাটি বিক্রির টাকা নিজের পকেট ভরছেন বলে সেখানে ট্যাক্টরে টোকেন দেওয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই ব্যক্তি।
কথা বলতেই অপরিচিত দুই ব্যক্তি সেখানে হাজির, তারা বলেন, এটা চেয়ারম্যানের পুকুর আর আমরা চেয়ারম্যান সাহেবের লোক। এখানে সাংবাদিক, প্রশাসন সবাইকে টাকা দেওয়া হয়েছে। এখানে তো আর কোন সাংবাদিক আসার কথা না। তারা বলেন, আখের আলী ও আলম হোসেন আমাদের নাম। বাড়ি মহিষমারী। প্রশাসন বলেন আর সাংবাদিক বলেন, সবাই আমাদের দু’জনকে এক নামে চেনে এবং দেখবেন প্রশাসনের খাতার উপরে আমাদের নাম রয়েছে। মাটি বহনের কারণে পাশের যে জমির ফসল নষ্ট এবং কারও কোন ক্ষতি হলে তাদের টাকা দেওয়া হচ্ছে বলে তারা জানান। এছাড়া যে রাস্তাগুলো নষ্ট হচ্ছে সেগুলোতো চেয়ারম্যানই মেরামত করে দেবেন। তাহলে লেখালেখি করে কি করবেন?
চামারী ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য আরিফুল ইসলাম বলেন, আমি শুধু মাটি বহনকারী ট্যাক্টর ভাড়া দিয়েছি। পকুর খনন ও রাস্তা-ঘাট নষ্ট সকল দায়িত্বে চেয়ারম্যান সাহেব স্বপন মোল্লার।
চামারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান স্বপন মোল্লা বলেন, তার ইউনিয়ন পরিষদের পেছনের এলাকায় একটি পুকুর খনন হচ্ছে তিনি শুনেছেন। তবে কে মাটি বিক্রয় করে রাস্তা নষ্ট করছে এমনটি তার নজরে আসেনি। আর তিনি পুকুর খনন বা মাটি বিক্রির সাথে কোন ভাবেই জড়িত নন। তবে যারা তার নাম বলেছেন তাদেরকে তিনি চিনেন। কিন্তু কেন তার নাম ব্যবহার করে পুকুর খনন করছে এটা তার জানা নেই। বিষয়টি তিনি আজই খোজ নিবেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ সেলিম রেজা বলেন, চলনবিলে কৃষি জমিতে পুকুর খনন মহামারি আকার ধারণ করেছে। আশঙ্কাজনক হারে কৃষি জমি কমছে। এটাকে রোধ করা না গেলে চলনবিলে কৃষির বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
রাজশাহী বিশ্ব বিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড.এফ.এম আলী হায়দার বলেন, অবাধে পুকুর খননে চলনবিলের জীবকূল অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে। পাশাপাশি কৃষির বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) আল ইমরান বলেন, প্রতিনিয়তই চলনবিলে কৃষি জমিতে পুকুর খনন বন্ধে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। গত এক মাস ধরে চলনবিলে প্রশাসনের সাড়াশি অভিযান চলেছে বলেও জানান তিনি।