নবীউর রহমান পিপলু ও নাইমুর রহমান, চলনিবলের সিংড়া অংশ ঘুরে
গত মৌসুমে উপর্যপুরি দু’দফা বন্যায় চাষাবাদ বিপর্যয়ে এমনিতেই দিশেহারা চলনবিল অধ্যুষিত নাটোরের সিংড়ার কৃষকরা। টানা দুই বছর ফসলহানির রেশ না কাটতেই চলতি আমন মৌসুমে আবারো চাষাবাদ নিয়ে শঙ্কায় এ অঞ্চলের দশ হাজারেরও অধিক কৃষক। বন্যাজনিত নয়, এবার চলনবিলের জন্মেছে স্মরণকালের সর্বোচ্চ কচুরিপানা। বিলে পানির ¯্রােত না থাকায় প্রাকৃতিকভাবে সরছে না কচুরিপানা। ফলে প্রায় সাড়ে চার হাজার হেক্টর জমিতে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে আমন ধানের চাষাবাদ। কয়েকমাস এমন অচলাবস্থা বিরাজ করলেও নেই স্থানীয় কৃষি বিভাগের কোন পদক্ষেপ।
দূর্গম ডাহিয়া গ্রামের কৃষক মনজুর আলম কচুরিপানাকে ‘গলার কাঁটা’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, ‘দুই দিন ধরে ১২ জন শ্রমিক মিলে ১ বিঘাও কচুরিপানার সাফ করতে পারিনি। আশেপাশের ১০ গ্রামের একই অবস্থা। শ্রমিকদের অতিরিক্ত মজুরী দিলেও সৃষ্ট চুলকানির জন্য তারা বেশী সময় কাজ করতে পারছে না। দিন মজুররা পাঁচ ঘন্টা কাজ করে সাড়ে তিনশ টাকা মজুরী নিচ্ছে। তারা গত বিশ বছরেও এমন কচুরিপানা দেখেননি বলে বলেন।’
সিংড়া উপজেলার চৌগ্রাম,ইটালী,ডাহিয়া,কলম ও তাজপুর ইউনিয়ন ঘুরে কৃষকদের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। দেখা গেছে, কচুরিপানার ব্যাপক বিস্তারে দিশেহারা হয়ে পড়েছে কৃষকসহ বিলাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষ। এসব ইউনিয়নের প্রায় ১৫টি গ্রামের মানুষের চলাচল প্রায় বন্ধ এখন। বিল এলাকায় চলাচলের একমাত্র বাহন নৌকা হলেও কচুরিপানার বিল পরিপূর্ণ থাকায় বন্ধ হয়ে গেছে নৌকা চলাচল। সাপসহ বিষাক্ত পোকা-মাকড়ের সাথে বাস করতে হচ্ছে বিলের মানুষদের। কচুরিপানার কারনে পানি দূষিত হওয়ায় চর্মরোগসহ পানি বাহিত নানা রোগের উপদ্রব বেড়ে গেছে। প্রতি বছর এসব গ্রামে আমন সহ অন্য ফসল আবাদ করলেও এবার কচুরিপানার জন্য আমন আবাদ হয়নি। দ্রুত কচুরিপানা অপসারণ করা না গেলে চলতি বোরো মৌসুমে কয়েক হাজার একর জমি অনাবাদী থাকার আশংকা করছেন কৃষি সংশ্লিষ্টরা।
কৃষকদের অভিযোগ, এসব কচুরিপানা অপসারণ করতে গিয়ে তাদের রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। একবিঘা জমি থেকে কচুরিপানা অপসারণ করতে ৭ থেকে ১০ জন শ্রমিকের প্রয়োজন হচ্ছে। শ্রমিকপ্রতি মজুরী দিতে হচ্ছে সাড়ে তিনশ টাকা। গত কয়েক মৌসুমে ঋণের টাকায় উৎপাদিত ফসলহানির কারণে এমনিতেই ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক কচুরিপানা অপসারণে অতিরিক্ত ব্যয়ে বাধ্য হচ্ছেন। কচুরিপানা সরাতে সার, কীটনাশক ও লবন ব্যবহার করতে হচ্ছে। দূর্গম এলাকাগুলোতে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌকাগুলো পারাপার ব্যহত হওয়ায় বেকার হয়ে পড়েছেন মাঝিরা। ধানের আবাদে জীবিকা নির্ভর করা দিনমজুররাও বেকারত্বের দিকে ধাবিত হচ্ছেন দিনদিন। পানি দূষিত হওয়ায় জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়েছে। চর্মরোগ সহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধরা।
চৌগ্রামের কৃষক আব্দুল মতিন বলেন, ‘এক বিঘা জমির কচুরিপানা অপসারণে ঔষধ ও লবন বাবদ ১০ হাজার টাকা ব্যয় হচ্ছে। কয়েকবছর ধানের আবাদও ভালো হচ্ছে না। চিন্তায় আছি।’
বেড়াবাড়ী গ্রামের কৃষক টিপু সুলতান জানান, তার ২০ বিঘা জমিতে কচুরিপানা জমে আছে। কচুরিপানার অপসারণে শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। যারা কাজ করছে, তারাও অতিরিক্ত মজুরি দাবী করছে।’
সাতপুকুরিয়া গ্রামের কৃষক হেলাল উদ্দীনও ৩০ বিঘা জমির কচুরিপানা নিয়ে বিপাকে রয়েছেন। একই এলাকার কৃষক মকবুল হোসেন বলেন, ‘কচুরিপানার জন্য নৌকায় চরাফেরা কঠিন হয়ে পড়েছে। সাপ আর জলজ কীটতঙ্গের কারণে শঙ্কা নিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে।’
ডাহিয়া ইউনিয়নের বেড়াবাড়ি গ্রামের শিশু আয়েশা, মিম, জান্নাত, সজল ও সাতপকুরিয়া গ্রামের মোস্তফা জানায়, নৌকা না চলায় তারা সপ্তাহে দুইদিন স্কুলে যায়। বিলের পানি শরীরে লাগলেই চুলকানি শুরু হয় ও হাত-পা ফুলে যায়।
সাতপুকুরিয়ার দূর্গম পকড়পাড়া গ্রামের গৃহবধূ জুলিয়া ও রাশিদা জানান, নৌকে ঠেলেই জীবিকা অর্জন তাদের স্বামীদের। বিল পরিবেষ্টিত এলাকায় কচুরিপানার জন্য তারা নৌকা বেয়ে বাড়ি থেকে বেশি দূরে যেতে পারছেন না।
বিলের পানি দূষণের প্রভাব পড়েছে চলনবিলের বেশ কয়েকটি এলাকার নলকূপগুলোতেও। সাতপুকুরিয়া মাদ্রাসার ছাত্র রিফাত, আলিফ ও নূর মোহাম্মাদ জানায়, বিল পাশ্ববর্তী নলকূপের পানি গোসল ও পানে ব্যবহারের কারণে শরীরে ঘা,পাঁচড়া, চুলকানিসহ ছোটছোট গুটি সৃষ্টি হয়েছে।
নৌকার মাঝি বাবুল হোসেন বলেন, ‘দুই মাস হল বিলে নৌকা চালানো যাচ্ছে না আগের মতো। কচুরিপানার জন্য এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যেতেই দিন পার হয়ে যায়। মানুষও কম চলাচল করছে। ধানের আবাদ শুরু না হওয়ায় প্রায় বেকার হয়ে গেছি।’ বাবুলের মতোই কৈশর থেকে চলনবিলে নৌকা বাওয়া যুবক ফেরদৌসও এখন কর্মহীন।
কচুরিপানার ব্যাপক বিস্তারের সত্যতা নিশ্চিত করে চৌগ্রাম ইউপি চেয়ারম্যান জাহিদুর রহমান ভোলা জাগোনাটোর ২৪.কমকে বলেন, ‘চৌগ্রাম ইউনিয়নে কচুরিপানার কারণে সাড়ে ১১ হাজার হেক্টর জমির চাষাবাদ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।এর বিস্তার রোধ বা অপসারণ না করা গেলে চলতি মৌসুমে চলনবিলের অসংখ্য জমি অনাবাদি থাকবে। বছরের একমাত্র আবাদ না করতে পারলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
এই বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করেছেন ডাহিয়া, তাজপুর, ইটালী ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিরা।
চলনবিল জীববৈচিত্র রক্ষা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক আক্তারুজ্জামান জাগোনাটোর ২৪.কমকে বলেন, ‘বর্তমান অবস্থা অব্যাহত থাকলে চলনবিলে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। দেশে উৎপাদিত ধানের এক-তৃতীয়াংশ চলনবিল থেকে সরবরাহ করা হয় বিধায় এখানকার ঘাটতি জাতীয় উৎপাদনে প্রভাব ফেলবে। এছাড়া পরিবেশ দূষণসহ পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে।’
সিংড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন কচুরিপানার প্রাদূর্ভাবের কথা স্বীকার করলেও মাত্র দেড় হাজার হেক্টর জমিতে কচুরিপানা রয়েছে জানিয়ে জাগোনাটোর ২৪.কমকে বলেন, ‘চলতি বছর বন্যা কম হওয়ায় কচুরিপানা বেশি। বিলে পানি থাকলে এগুলো ভেসে যেত।’ উল্টো বিলে পানি থাকতেই কৃষকদের নিজ উদ্যোগে কচুরিপানা অপসারণ করার পরামর্শ দেন এই কর্মকর্তা।
সিংড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুশান্ত কুমার মাহাতোর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগোনাটোর ২৪.কমকে বলেন বিষয়টি জানার পর কৃষিসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছি।’