নাটোর অফিস ॥
নাটোরে কলেজ ছাত্রকে বিয়ে করে ভাইরাল হওয়া গুরুদাসপুর উপজেলার খুবজিপুর ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক শিক্ষিকা খাযরুন নাহারের মৃত্যু নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। কলেজ শিক্ষক খাইরুন নাহারের ভাড়া বাসার কেয়ার টেকার নিজামুদ্দিন জানান, মামুন শনিবার রাত ১১টার দিকে বাসায় ঢোকে। পড়ে পাশের বাড়িতে অবস্থান করার সময় রাত আনুমানিক আড়াইটার দিকে বাসার গেটে ধাক্কাধাক্কির শব্দ শুনতে পেয়ে এগিয়ে যায়। এসময় মামুন সাহেব আমাকে বলে সে ঔষধ আনতে যাবে। তিনি গেইটা খুলে দেওয়ার জন্য বলনে। আমি ভাবি কেউ হয়ত অসুস্থ তাই সে বাহিরে ঔষধ আনতে যাবে। গেইট খুলে দেওয়ার পর মামুন বাহিরে যান। পড়ে ভোর ৬ টার দিকে তিনি ভিতরে ঢুকে ৪ তলায় তাদের ঘরে যান। এর ৫মিনিট পর আমাকে ওপরে যাওয়ার জন্য ডাকতে থাকেন মামুন। বলেন একটু উপরে যেতে বললে আমি জানতে চাই কি হয়েছে। তিনি আমাকে উপরে যেতে বলেন। উপরে গিয়ে তার স্ত্রীকে নিচে পড়ে থাকতে দেখি। এবং খাটের ওপর একটা চেয়ার এবং সিলিং ফ্যানের সাথে ওড়নার একটা অংশ ঝুলতে দেখি। ঘটনা সন্দেহজনক হওয়ায় আমির বাহির থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বাড়ির মালিককে জানায়।
এদিকে পুলিশ হেফাজতে থাকা শিক্ষিকার স্বামী মামুন জানান, তিনি নামাজ পড়ার জন্য রাতে বাহিরে গিয়েছিলেন। সকালে তার স্ত্রীকে তার কর্মস্থলে পৌঁছানোর কথা ছিল। নামাজ পড়তে যাওয়ার পর স্ত্রীর সাথে মোবাইল ফোনে কথা বলার জন্য রিং করলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। পরে ফিরে এসে দেখেন তার স্ত্রী ঘরের মধ্যে সিলিং ফ্যানের সাথে ফাঁস দিয়ে ঝুলে রয়েছে। তিনি দ্রুত হাসুয়া বা বটি খুজে না পেয়ে ওড়নায় গ্যাস লাইটের আগুন দিয়ে পুড়িয়ে তাকে ঝুলন্ত অবস্থায় নিচে নামিয়ে রাখি। এসময় তার হাতে আগুনে ফোসকা পড়েছে। তার স্ত্রীর আত্মহত্যার কারন জানতে চাইলে মামুন বলেন, তারা ৮ মাস আগে বিয়ে করেন। বিয়ের পর থেকে তার মন ভাল দেখি নাই। আত্মীয় স্বজন ,বন্ধ -বান্ধব ও সহকর্মীদের কাছে থেকে প্রায় সে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ব্যবহার পাওয়ার কারনে মন ভার কে থেকেছ্।ে তারা সবাই প্রায় ফোন করে তাকে বলে তুই কেন হাঁটু বয়সি বা ছেলের বয়সি ছেলেকে বিয়ে করেছিস। যত কুরুচিপুর্ন কথা তাকে শুনতে হয়েছে। তাকে সব সময় তার নিকটজনরা মানসিকভাবে নির্যাতন করছিল।
এদিকে বাড়ির কেয়ার টেকারের দেওয়া ভাষ্যের সাথে অমিল থাকায় এবং মামুনের অসংলগ্ন কাথাবার্তায় এঘটনার জন্য তার দিকেই আঙ্গল তুলেছেন কেউ কেউ। তারা মামুনকে মাদকাসক্ত বলেও দাবি করেন।
শিক্ষিকার চাচাতো ভাই সাবের হোসেন বলেন, সকালে একটা ফোন আসে, আমার বোন নাকি আত্মহত্যা করেছেন। খবর শুনেই গুরুদাসপুর থেকে ছুটে আসি। এসে দেখি, বোনের মরদেহ মেঝেতে পড়ে আছে। মরদেহের গলায় বেশ কিছু দাগ রয়েছে। এতে মনে হচ্ছে ঘটনাটি আতœহত্যা নয়, পরিকল্পিত খুন। আমরা এ ঘটনার বিচার দাবি করছি। মামুনের পরিবারের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা কাহিনী ।
শালিকা খাইরুন নাহারে মৃত্যুর খবর পেয়ে আহমেদপুর থেকে নাটোরে ছুটে আসেন দুলাভাই জয়নাল। হাসপাতালের মর্গের কাছে কথা হয় এই প্রতিবেদকের সাথে। তিনি বলেন, তার শালীকার মনে শান্তি ছিলনা। এই বিয়েটা করার পর থেকে সবাই তাকে ছিছি করত। মুখে হাসি মাখা থাকলেও শান্তি ছিলনা মনে। আর যাকে বিয়ে করেছে সেই মামুন ছেলেটাও ভালনা। বখাটে প্রকৃতির। তার পরিবারেরও রয়েছে নানা কাহিনী। জয়নালের সাথে আসা কয়েকজন প্রতিবেশী নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, মামুনের মায়ের দ্বিতীয় স্বামীর ঔরসজাত ছেলে মামুন। মামুনের বাবার নাম মোহম্মদ আলী। তাই মামুনও ছোটবেলা থেকে বেপরোয়া। দুই বছর আগে মামুনের মোটর সাইকেলের চাপায় এক ব্যক্তির মৃত্যু হলে মামুন এলাকা ছেড়ে পালিয়ে ছিল। পরে স্থানীয়ভাবে বিষয়টি মিমাংশা হয়ে যায়।
শিক্ষিকা খাইরুনের ভাতিজা নাহিদ হোসেন জানান, মামুন মাদকাসক্ত। বিয়ের পর থেকে ফুফুর কাছে থেকে মামুন এ পর্যন্ত পাঁচ লাখ টাকা এবং একটি মোটরসাইকেল নিয়েছেন। সম্প্রতি আরও দামি মোটরসাইকেল চেয়েছেন মামুন। এ নিয়ে তার ফুফু খায়রুন নাহার মানসিক চাপে ছিলেন। তার ফুফু মানসিক ও পারিবারিক বিভিন্ন চাপে অশান্তিতে ছিলেন।
খুবজীপুর এম হক ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো: আবু সাঈদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন,খাইরুন নাহার তার কলেজের একজন শিক্ষক ছিলেন। তিনি প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত আসতেন। নিয়মিত হাজিরাও আছে। কলেজ থেকে তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কোন ধরনের প্রশ্ন করা হয়নি। অধ্যক্ষ হিসেবে তার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কোন কথা হয়নি। বিয়ে করার পর তার সাথে আমার দু’দিন দেখা হয়েছে প্রতিষ্ঠানে। তাকে নানাভাবে কুটুক্তি করে উক্তত্য করা হলো এম প্রশ্ন করা হলে অধ্যক্ষ বলেন,এই অভিযোগ সম্পুন্ন মিথ্যা ও বানোয়াট। তার সহকর্মীরা বলেছে কিনা সে বিষয়ে খাইরুনও আমাকে বলেননি। এব্যাপারে খাইরুন সহ কেউ কোন অভিযোগও করেননি।
এব্যাপারে জানতে কলেজের সমাজ কর্ম বিষয়ক শিক্ষক ওয়াহেদুজ্জামান জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, খাইরুন নাহার নিয়মিত কলেজে আসতেন এবং ক্লাস নিতেন। সবার সাথে হাসি মুখে কথা বলতেন। হঠাৎ এমন করার কারনটা ঠিক বুঝতে পারছিনা আমরা।
এবিষয়ে জানতে জেলার ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা অফিসার আক্তার হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন,শিক্ষিকা তার সহকর্মীদের ব্যাপারে কোন অভিযোগ করেননি। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হলে এ নিয়ে পরে কথা বলবেন বলে জানান।
খাইরুনের গ্রামের বাড়ির এলাকার মানুষ ও গণমাধ্যম কর্মী আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, মামুন ও খায়রুন নাহারের দাম্পত্ত জীবন নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর ভাইরাল হওয়ার বিষয়টি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন খায়রুন এবং সামজিকভাবেও তৈরি হওয়া চাপ তিনি সহ্য করতে পারেননি। একারনে হয়ত তিনি আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন।
এদিকে রোববার জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত মাসিক আইন শৃংখলা মিটিংয়ে শিক্ষিকা খাইরুন নাহারের মৃত্যুর বিষয়টি আলোচিত হয়।
অপরদিকে রোববার সকালে ছাত্রকে বিয়ে করে ভাইরাল হওয়া গুরুদাসপুর উপজেলার খুবজিপুর ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক শিক্ষিকা খাযরুন নাহার (৪০) আত্মহত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর মানুষ তাদের সেই ভাড়া বাড়িতে গিয়ে ভির করে।লোকজন তার বাসায় গিয়ে খায়রুন নাহারের লাশ মেঝেতে শোয়া অবস্থায় দেখতে পায়। রোববার ভোররাতে নাটোর শহরের বলারীপাড়ার ভাড়া বাসার চারতলায় তিনি আত্মহত্যা করেন। মামুন-খাইরুন নাহার দম্পতি নাটোর শহরের বলারীপাড়ার হাজী নান্নু মোল্লা ম্যানশনের চারতলায় ভাড়া থাকতেন।
বাড়ির মালিক তানভির আহমেদ সিদ্দীকি বলেন, কেয়ার টেকার নিজামুদ্দিন আমাকে বলার পর তাদের ঘরে গিয়ে মৃতদেহের পাশে মামুনকে দেখতে পাই। এর আমি ঘর থেকে বের হয়ে বাহির থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে পুলিশে খবর দিই। কমাস আগে তারা আমার বাড়ির ৪র্থ তলার একটি ইউনিট ভাড়া নেয়। তাদের মধ্যে কোন বিরোধ হয়েছে বলে শুনিনি। তবে তাদের কাহিনী ভাইরাল হওয়ার পর বেশ কিছুদিন তারা এখানে ছিলেননা।
পুলিশ লাশ উদ্ধারের পর ময়না তদন্তের জন্য নাটোর সদর হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করে। জেলার স্বাস্থ্য বিভাগ খাইরুনের মৃতদেহ ময়না তদন্তের জন্য তিন সদস্যের মেডিকেল টিম গঠন করে। নাটোর সদর হাসপাতালের সহকারি পরিচালক ডাঃ পরিতোষ রায় জানান, ওই তিন সদস্যের মেডিকেল টিম ময়না তদন্তের পর ভিসেরা রির্পোর্টের জন্য আলামত ঢাকায় প্রেরন করবেন।
নাটোর সদর থানার ওসি নাছিম আহমেদ জানান, এঘটনায় সদর থানায় একটি ইউডি মামলা রুজু করা হয়েছে। সন্ধ্যায় ময়না তদন্ত শেষে সজনদের কাছে খাইরুন নাহারের মৃতদেহ হস্তান্তর করা হয়।
এদিকে রাতেই গুরুদাসপুরের গ্রামের বাড়িতে শিক্ষিকা খায়রুন নাহারের জানাজা নাজ শেষে দাফন করা হয়েছে।
নাটোরের পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা জানান,এই মৃত্যুর ঘটনায় গোয়েন্দা পুলিশ ,পিবিআই ও জেলা পুলিশ তদন্তে মাঠে নেমেছে। এই দম্পতির খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা হওয়ার কারণেই খাইরুন নাহার আতœহত্যা করেছেন কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।