নবীউর রহমান পিপলু ও নাইমুর রহমান, নলডাঙ্গা ঘুরে
নয়নাভিরাম ঐশ্বর্যের সবুজাভ দ্যুতিই যখন পরিচয়, তখন জীবন থেকে জীবনে নাগরিক হিসেবে পরিপূর্ণতা আনার তাগিদ ছিলো সর্বক্ষণ-সর্বত্র। সরকার এসেছে, সরকার পরিবর্তনও হয়েছে, তবে তখনও পূরণ হয়নি স্বতন্ত্র উপজেলার নাগরিক হবার দূনির্বার আকাঙ্ক্ষা।
যেভাবে উপজেলা ঘোষণা আজকের নলডাঙ্গাবাসীর প্রয়োজনটুকু অনুভব করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১১ সালে নাটোরের কানাইখালী মাঠে এক শোকসভায় তাঁর একটি ঘোষণা তাদের আকাঙ্ক্ষাকে পূর্ণতা দিয়েছিলো। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালের ২৭ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস ও বাস্তবায়ন কমিটির (নিকার) সভায় তৎকালীন নাটোর সদর উপজেলার অন্তর্গত ব্রহ্মপুর, মাধনগর, খাজুরা, পিপরুল, বিপ্রেবেলঘরিয়া নামের ৫টি ইউনিয়কে একীভূত করে ‘নলডাঙ্গা’ উপজেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেই থেকে উপজেলা হিসেবে যাত্রা শুরু করে নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলা।
প্রত্যাশা বনাম প্রাপ্তি যাত্রা শুরুর পর কেটে গেছে পাঁচ বছর। তবে নলডাঙ্গার মানুষ বলছে, পাঁচ বছর আগে তাদের প্রত্যাশা ও পাঁচ বছর পরে সেগুলোর আলোকে প্রাপ্তি কতটুকু, তা মেলাতে গিয়ে বিস্তর ফারাক দেখছেন তারা। এখানে প্রত্যাশা রয়েছে কিন্ত তা প্রাপ্তিতে পরিণত করার প্রচেষ্টা একদমই ক্ষীণ।
যা নেই আজও ২০১৮ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর তারিখেও নলডাঙ্গা উপজেলার নিজস্ব ভবন নেই, নেই একজন নির্বাহী কর্মকর্তা, থানায় নেই অফিসার ইনচার্জ, ভূমি অফিসে নেই সহকারী কমিশনার, পৌরসভায় নেই মেয়র, চিকিৎসায় নেই হাসপাতাল, ডাকঘরে নেই কার্যক্রম, অগ্নি নির্বাপনে নেই ফায়ার স্টেশন, নেই সাবরেজিস্ট্রি অফিস, নেই উপজেলার উন্নয়নে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কোন কার্যালয়। পাঁচ ইউনিয়নে কমিউনিটি ক্লিনিকে বসেন না চিকিৎসকরা। নেই হিসাবরক্ষণ অফিস, প্রাণি সম্পদ অফিস নলডাঙ্গায় যেন ‘নেই’র শেষ নেই! না পাওয়ার আক্ষেপ নলডাঙ্গার মানুষদের আর জনপ্রতিনিধিদের কন্ঠে হতাশা।
প্রথম চেয়ারম্যান যা বলছেন জানতে চাইলে এ উপজেলার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান এডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘যে গতিতে নলডাঙ্গাকে উপজেলা ঘোষণা করা হয়, সে অনুযায়ী নাগরিকসেবা নিশ্চিত করা যায়নি। উপজেলা হিসেবে যে প্রশাসনিক ও অবকাঠামোগত সুবিধা থাকার কথা, তা নেই। প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে এমন সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবেলায় বেগ পেতে হচ্ছে, তবুও সংশ্লিষ্টদের সাথে সমন্বয় করে কাজ করে যাচ্ছি। তবে আশার কথা হলো, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরীর কাজ অনুমোদনসাপেক্ষে শুরু হয়েছে, যা দৃশ্যমান হতে কয়েকবছর সময় লাগবে। নলডাঙ্গার মানুষ পিছিয়ে থাকতে চায়না।’
উপজেলা নির্বাহী অফিসার নেই জানা গেছে, নলডাঙ্গার উপজেলা নির্বাহী অফিসার মু.রেজা হাসান উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনের উদ্দ্যেশ্য দেশের বাইরে রয়েছেন। ফলে মাসাধিকাল ধরে উপজেলায় অতিরিক্ত দায়িত্বে রয়েছেন সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার জেসমিন আক্তার বানু। তাকে একসাথে দুই উপজেলার দায়িত্ব পালন করতে তাকে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নেই উপজেলার ৫টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার প্রায় ১লাখ ৩০ হাজার মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে নেই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ফলে রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হলে বা দূর্ঘাটনায় প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য উপজেলা থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে জেলা সদরে আসা ছাড়া উপায় থাকে না। এরই সুযোগে একটি অসাধু চক্র গরীব-অসহায় মানুষের অসুখকে পুঁজি করে চিকিৎসার নামে প্রতারণা শুরু করেছে। তবে আজ ১৫ই সেপ্টেম্বর এখানে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন স্থানীয় সাংসদ শফিকুল ইসলাম শিমুল।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) নেই নিয়মানুযায়ী উপজেলায় একজন সহকারী কমিশনারের (ভূমি) পদায়ন থাকার বিধান থাকলেও নলডাঙ্গায় নেই ভূমি ব্যবস্থা তত্বাবধানে কোন সহকারী কমিশনার। চলতি দায়িত্বে কখনও রয়েছেন সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার জেসমিন আক্তার বানু বা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শামীম ভুঁইঞা। জেলা সদরের সাথে এ অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনে তারাও হিমসিম খাচ্ছেন।
থানায় ওসি নেই থানাতেই এখন নেই কোন অফিসার ইনচার্জ। সর্বশেষ এ থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) দায়িত্ব পালন করেছেন নূর হোসেন খন্দকার। সম্প্রতি বদলীজনিত কারনে হলে তার দায়িত্ব পালন করছেন ওসি (তদন্ত) উজ্জল হোসেন। দুই পদে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনিও হিমসিম খাচ্ছেন।
মেয়র নেই পৌরসভাতে নলডাঙ্গা পৌরসভার মেয়র শফির উদ্দিন মন্ডলও বসেন না পৌরসভাতে। বছরাধিকাল ধরে অসুস্থতার কারণে শয্যাশায়ী তিনি। তার দায়িত্ব পালন করছেন প্যানেল মেয়র সাহেব আলী।
নেই প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যালয় উপজেলা ঘোষণার পর যোগাযোগ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে অপরিহার্য প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যালয়ও নেয় নলডাঙ্গাই। ফলে দূর্ভোগ বেড়েছে জনপ্রতিনিধিদের। প্রতিনিয়তই তাদের ছুটতে হচ্ছে সদর উপজেলায়। উন্নয়ন কাজ চলার আগে ও পরে অধিকাংশ সময়ই ইউপি চেয়ারম্যানগণ অবস্থান করেন নাটোর সদর উপজেলায়। আর একজন প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার দুই উপজেলার কাজ করতে গিয়ে অন্যদের মতোই অবস্থা।
সমগ্র নলডাঙ্গা ঘুরে দেখা গেছে, বিদ্যমান সরকারী দপ্তরগুলোর অধিকাংশই বিভিন্ন বাসাবাড়ি ভাড়া নিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হওয়ায় নাগরিক সেবা মিলছে না কোন এক নির্দিষ্ট জায়গায়। একেকটি সেবা পেতে একেক জায়গায় ধরণা দিতে হচ্ছে নলডাঙ্গাবাসীকে।
বিদ্যমান সরকারী দপ্তরগুলোর বর্তমান ঠিকানা নলডাঙ্গা উপজেলা ডাকবাংলোর তিনটি কক্ষ নিয়েই চলছে উপজেলা পরিষদের কার্যক্রম। বারনই নদীর পাড়ে ভাড়া নেয়া আরেকটি ভবনে চলছে পৌরসভার কার্যক্রম। উপজেলা শিক্ষা, কৃষি ও নির্বাচন অফিসের কার্যক্রম চলছে নাটোর-নলডাঙ্গা সড়কের সোনালী ব্যাংক ভবনের ৩য় তলার কয়েকটি কক্ষে। এর নীচে রয়েছে মৎস্য অফিস। প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের কার্যক্রম চলছে নলডাঙ্গা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুইটি কক্ষে। বিপ্রবেলঘড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের ২য় তলার দুইটি কক্ষে চলছে উপজেলা এলজিইডি ও সমাজসেবা অফিসের কার্যক্রম। আর অফিসই নেই ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার। ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের জন্য জায়গাই নির্ধারিত হয়নি।
অচল এখনও ডাকঘর আইনগত জটিলতা ও জনবল সংকটে পাঁচ বছর আগে ভবন নির্মাণ হলেও উপজেলা ডাকঘরটি আজও চালু হয়নি। এতে ডাকবিভাগের নিরবিচ্ছিন্ন সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এলাকাবাসী। জেএসসি, জেডিসি, এসএসসি, দাখিল, ভোকেশনাল, এইচএসসি ও ডিগ্রিসহ পাবলিক সকল পরীক্ষার প্রায় তিন-চার হাজার পরীক্ষার্থীর খাতা, নৈর্ব্যক্তিক উত্তরপত্র বীমা পার্সেল করে শিক্ষা বোর্ডে পাঠাতে নলডাঙ্গা থেকে ১৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে নাটোরে গিয়ে পাঠাতে অনেক বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়।নলডাঙ্গা থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে মাধনগরে সাব-পোস্ট অফিস থাকলেও সেটি এখন জরাজীর্ণ। ঝুঁকি নিয়েই এ সাব-অফিসে মূল্যবান কাগজপত্র রাখা হচ্ছে। অচল ডাকঘরটি সচল করতে বারবার উপজেলার মাসিক সমন্বয় সভায় আলোচনা হলেও বিভিন্ন অজুহাতে ডাকঘরটি এখনও চালু হয়নি। প্রতিনিয়তই কষ্ট, ঝুঁকি আর বিড়ম্বনার জন্ম দেয়া অচল ডাকঘরটি সচল হবার আশায় দিন গুনছেন নলডাঙ্গাবাসী।
বন্ধ দুগ্ধ শীতলীকরণ কেন্দ্র পাস্তরাইজড ক্ষমতার চেয়ে পরিমাণ ও গুণে কম দুধ সরবরাহের অজুহাতে উপজেলার বাসুদেবপুরে অবস্থিত মিল্কভিটার দুগ্ধ শীতলীকরণ কেন্দ্রটি বন্ধ রয়েছে অনির্দিষ্টকালের জন্য। চলতি বছরের ১৫ই ফেব্রুয়ারী মিল্কভিটার উপ-মহাব্যবস্থাপক (সমিতি) রেহেনা রহমান স্বাক্ষরিত আদেশের পর থেকে কারখানা কর্তৃপক্ষ খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ বন্ধ করে দেয়। জানা যায়, শীতলীকরণ কেন্দ্রটির দুধ পাস্তরাইজ করার ক্ষমতা ৫ হাজার লিটার হলেও ২শ’লিটারের বেশি দুধ সরবরাহ করতে পারেননি খামারীরা। তাছাড়া দুধের গুণগত মান নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। কারখানাটি বন্ধ করে দেওয়ায় বিপাকে পড়েছেন প্রতিষ্ঠানের অন্তর্গত ১৩ সমিতির ২৬৩ জন খামারি। সমিতিভুক্ত সদস্যদের দাবী তারা মানসম্পন্ন দুধ সরবরাহ করতেন। মনগড়া অভিযোগ করে কারখানাটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
ক্ষমতাসীন আ’লীগ নেতাদের বক্তব্য নলডাঙ্গা উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশীদ তোতা বলেন, ‘অস্বীকার করার উপায় নেই যে নলডাঙ্গাবাসী পিছিয়ে আছে প্রশাসনিক সংকটের কারনে। পৌর ও ইউনিয়ন পর্যায়ে নাগরিক সেবা নিশ্চিতে অতিসত্বর এসব সংকট সমাধান করতে হবে। আশার কথা এই যে, নলডাঙ্গার উন্নয়নে স্থানীয় সাংসদ বেশ কিছু কাজে হাত দিয়েছেন, যার সুফল পেতে নলডাঙ্গাবাসীকে একটু ধৈর্য ধরতে হবে।’
জনপ্রতিনিধির বক্তব্য জেলা পরিষদ সদস্য রঈস উদ্দীন বলেন, ‘জেলার অনান্য উপজেলাগুলোর তুলনায় নলডাঙ্গার গুরুত্ব কোন অংশেই কম নয়। দেশে যখন দৃশ্যমান উন্নয়নযজ্ঞ চলছে, তখন নলডাঙ্গায় নাগরিকসেবা নিশ্চিতে অবকাঠামোগত ও প্রশাসনিক সংকট মেনে নেয়া যায় না। নলডাঙ্গাবাসী চায় শতভাগ নাগরিক সেবার অধিকার। কৃষি অধ্যুষিত এই জনপদ জেলায় অর্থনীতির অমিত সম্ভাবনাকে সূচিত করবে যদি প্রশাসনিক সংকট কাটিয়ে সার্বিক বৈষম্য দূর করা যায়।
জেলা সবোচ্চ নির্বাহী কর্মকর্তা যা বলছেন জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন বলেন, ‘আয়তনে ছোট ও নতুন উপজেলা হিসেবে দেশের অনান্য উপজেলার মতো নলডাঙ্গাতে উপজেলা নির্বাহী অফিসারই সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ইতোপূর্বে এবং আগামীতেও। এটি কোন প্রশাসনিক জটিলতা নয়।’
জাতীয় সংসদ সদস্যের বক্তব্য এ প্রসঙ্গে নাটোর-২(সদর ও নলডাঙ্গা) আসনের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল বলেন, ‘নলডাঙ্গার জনগণকে উপজেলা উপহার দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমি নির্বাচিত হবার পর উপজেলায় অবকাঠামোগত পরিবর্তনের কাজ শুরু করেছি প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা ও দিকনির্দেশনায়। ইতোমধ্যে, নাটোর-নওগাঁ আঞ্চলিক মহাসড়ক, অত্যাধুনিক উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, আধুনিক ফায়ার স্টেশন নির্মাণ, স্কুল-কলেজ জাতীয়করণসহ বিভিন্ন অবকাঠামোর নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে গেছে এবং বেশ কিছু নতুন প্রকল্পের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এসব উন্নয়নকাজের সুফল নলডাঙ্গাবাসী পাবে কিছুদিনের মধ্যে।’
প্রধানমন্ত্রীর উপহারের প্রতিদানে আগামী নির্বাচনে নাটোর-২ আসনে নৌকায় ভোট দিয়ে বর্তমান সরকারকে নির্বাচিত করার জন্য নলডাঙ্গাবাসীকে অনুরোধ করেন তিনি।
(জাগোনাটোর টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত সংবাদ সম্পাদকের বিনা অনুমতিতে হুবহু বা অংশবিশেষ অন্য কোন গণমাধ্যমে কপি করে প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করা হলো।)