নাটোর অফিস ॥
নাটোরের বাগাতিপাড়ায় নিম্মমানের উপকরণ দিয়ে বীর নিবাস তৈরি করার অভিযোগ করায় হুমকির মুখে পড়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা অজিত কুমার মন্ডল। বীর মুক্তিযোদ্ধা অজিত মন্ডলকে এলাকা ছাড়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধার অভিযোগ ঠিকাদারের প্রতিনিধি এলাকার নির্বাচিত ইউপি সদস্য ফরিদ হোসেন তাকে হুমকি দিয়েছেন নির্মানাধীন ঘর ভেঙ্গে ফেলা হলে অজিত মন্ডল এলাকায় থাকতে পারবেননা। তবে ইউপি সদস্য ফরিদ হোসেন এমন অভিযোগকে ভিত্তিহীন ও বানোয়াট বলে দাবি করেছেন। উপরুন্তু বীর মুক্তিযোদ্ধা তার কোন কথায় কষ্ট পেয়ে থাকলে সে জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
উপজেলা প্রকল্প অফিস ও সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা যায়, বাগাতিপাড়া উপজেলার ১১ অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাকে সরকারী বরাদ্দে ঘর(বীর নিবাস) নির্মান করে দেওয়া হচ্ছে। প্রতি বীর মুক্তিযোদ্ধার জন্য অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১৩ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। প্রতিটি বীর নিবাসে পাকা ছাদওয়ালা দুটি শোবার ঘর,১টি কিচেন,১টি ডাইনিং এবং ২টি বাথ রুম ও ছোট একটি বরান্দা তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে। ২ শতক জমিতে এই বীর নিবাস তৈরি করে দেওয়ার জন্য ইতিমধ্যে উপজেলার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ থেকে দরপত্র গ্রহণ ও কার্যাদেশ প্রদান করা হয়েছে। দরপত্রে অংশ নিয়ে সর্বনিম্ম দরদাতা হওয়ায় নাটোরের আশীক কমিউনিকেশন নামের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ওই সুত্র জানায়, নাটোরের আশীক কমিউনিকেশন নামের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কাজ পেলেও কাজটি নিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলাম বকুলের ছোট ভাই বাগাতিপাড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ওহিদুল ইসলাম গকুল। কাজটি ওই ঠিকাদারের কাছ থেকে কিনে নিয়েছেন বলে জানানো হয়। কিন্তু কত টাকার বিনিময়ে কাজটি কিনেছেন তা জানননি কেউ। উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ওহিদুল ইসলাম গকুল কাজটি কিনে নেওয়ার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তর অবগত আছেন।
এদিকে বীর নিবাস নির্মাণ কাজ শুরুর পর পরই নিম্মানের উপকরণ ব্যবহার করা হচ্ছে বলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবরে লিখিত অভিযোগ করেছেন উপজেলার মিশ্রিপাড়া গ্রামের অজিত কুমার মন্ডল,কাকফো গ্রামের বেলাল শেখ,নন্দিকুজা গ্রামের রফিকুল ইসলাম ও ঘোলনাজ গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা লোকমান আলী প্রামানিক। এসব লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পর নির্বাহী অফিসার উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার আজাদ হোসেনকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিনিধি হিসেবে অভিযুক্ত এলাকা পরিদর্শন করে সত্যতা যাচাই করতে বলেন। সাবেক ডেপুটি কমান্ডার আজাদ হোসেন ঘটনাস্থলগুলো পরিদর্শন করে অনিয়মের সত্যতা পান।
বৃহস্পতিবার এই প্রতিবেদক সরেজমিন সংশ্লিষ্ট এলাকায় গেলে অভিযোগকারী কাফকো গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা বেলাল হোসেন, ঘোলনাজ গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা লোকমান আলী প্রামানিক ও নন্দিকুজা গ্রামের রফিকুল ইসলাম বলেন,কাজে ভরাট বালি এবং সোলিং ছাড়াই ঢালাই এবং গাথুনিতে ৭ বস্তা বালির সাথে মাত্র এক বস্তা সিমেন্ট মেশানো হচ্ছে। সর্বোপুরি সিডিউল অনুযায়ী কাজ করা হচ্ছেনা। যেহেতু এমপির ছোট ভাই এবং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কাজটি করছেন তাই কেউ প্রতিবাদ করার সাহস করছেননা।
বীর মুক্তিযোদ্ধা বেলাল হোসেন বলেন, ইউএনওর কাছে লিখিত অভিযোগ করার পর যিনি তার ঘর তৈরির কাজে তদারকি করছেন অথাৎ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি রেজাউল করিম নিম্মমানের মালামাল সরিয়ে ফেলে এখন নতুন করে কাজ শুরু করছেন। আমি নিজেই এখন তার কাজ দেখি।
ঘোলনাজ গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা লোকমান আলী প্রামানিক ও তার ছেলে জাহাঙ্গীর হোসেন ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, শুরুতে নিম্মমানের উপকরণ দিয়ে কাজ শুরু করেন ঠিকাদারের প্রতিনিধি। প্রতিবাদ করায় কাজ বন্ধ রয়েছে। ঢালাই না করেই গাঁথুনি শুরু করা হয়। বালির পরিবর্তে ভরাট মাটি ব্যবহার করা হয়েছে। নির্মিত ওয়ালে পানি দিলে মসল্লা ফুটো হয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। এভাবে গাথুনি করে ঘর নির্মান কাজ সম্পন্ন হওয়ার আগেই ধসে পড়ার আশংকা রয়েছে। ইউএনওকে অভিযোগ দেওয়ার পর কাজ বন্ধ রয়েছে।
এদিকে বীর নিবাস নির্মান কাজে অনিয়মের সত্যতা জানতে পেরে উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রিয়াংকা দেবী পাল ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে অভিযুক্ত অংশ ভেঙ্গে ফেলে নতুন কাজ করার নির্দেশ দেন। ওই নির্দেশের পর মিশ্রিপাড়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা অজিত কুমার মন্ডলকে হুমকি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ ওঠে ।
বীর মুক্তিযোদ্ধা অজিত কুমার মন্ডল বলেন,যেভাবে কাজ শুরু করা হয়েছে তাতে ঘর করার পর পরই ভেঙ্গে পড়ার সম্ভাবনা বেশী। সিডিউল মোতাবেক কাজ করার কথা বললে ক্ষেপে যান ঠিকাদারের প্রতিনিধি। এবিষয়ে ইউএনওর কাছে অভিযোগ করা হয়েছে। ওই অভিযোগ করার পর ঠিকাদার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ওহিদুল ইসলাম গকুলের প্রতিনিধি নবনির্বাচিত মেম্বার (ইউপি সদস্য) ফরিদ হোসেন ও তার দল হুমকি দিয়ে বলেন, যে টুকু গাঁথুনি করা হয়েছে,তা যদি ভাঙ্গা হয় তাহলে আমি ও আমার পরিবারকে এলাকা ছেড়ে থাকতে হবে। এলাকায় থাকতে পারবনা বলে হুমকি দেওয়া হয়। মেম্বার ফরিদ হোসেন তাকে এই হুমকি দিয়ে বলেছে,এমন কোন শক্তি নেই যে এই কাজ ভেঙ্গে নতুন করে করাবে। অজিত আরো বলেন, আমার ঘর দরকার নাই। পরিবার পরিজন নিয়ে কুড়ে ঘরেই থাকব ,তবুও ঘর ধসে মরতে চাইনা।
অভিযুক্ত ইউপি সদস্য ফরিদ হোসেন বীর মুক্তিযোদ্ধা অজিত মন্ডলের অভিযোগ সঠিক নয় বলে দাবী করে বলেন, তিনি আমার এলাকার মানুষ।কাকা বলে ডাকি। সকাল হলেই দুজনার সাথে দেখা হয়। এধরনের কোন হুমকি বা কথা আমি তাকে বলিনি। তিনি যদি আমার কোন কথায় কষ্ট পেয়ে থাকেন তাহলে আমি দুঃখ প্রকাশ করছি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা লোকমান আলীর ছেলে জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন,একজন জনপ্রতিনিধিকে কেন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দকৃত বীর নিবাস নির্মান কাজ কিনে নিতে হবে। উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ওহিদুল ইসলাম গকুল যে কাজটি করেছেন তা সমর্থন করা যায়না। তিনি নিজে এসব কাজ তদারকি করবেন,যাতে করে সুন্দরভাবে এবং ভাল উপকরণ দিয়ে ঘর নির্মান করা হয়। নিজে কাজ কিনে ব্যবসা করতে গিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়লেও তোয়াক্কা করছেননা।
উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা নুর নবী বলেন, কাজটির প্রকৃত ঠিকারী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে নাটোরের আশীক কমিউনিকেশন। জানতে পেরেছি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ওহিদুল ইসলাম গকুল কাজটি কিনে নিয়েছেন। তার নিয়োজিত প্রতিনিধিরা কাজের তদারকি করছেন। নির্মান কাজে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়ার পর ইউএনও স্যারকে অবগত করা হয়েছে। অভিযোগের কোনটি সত্য বা কোনটি মিথ্যা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
বীর নিবাস নিমার্ন কাজের বর্তমান ঠিকাদার বাগাতিপাড়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ওহিদুল ইসলাম গকুল বলেন,কাজে কোন ধরনের অনিয়ম বা নিম্মমানের উপকরণ ব্যবহার করা হয়নি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা আমার সুনাম ক্ষুন্ন করার উদ্দেশ্যে এমন মিথ্যা অভিযোগ তুলেছেন। প্রতিপক্ষরা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার চরিতার্থ করতে ষড়যন্ত্র করছেন। আমাকে সৎভাবে ব্যবসা করতে দিতে চায়না তারা। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন,যদি নিম্মমানের উপকরণের কিছু পাওয়া যায় তা সরিয়ে উন্নত উপকরণ ব্যবহার করা হবে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রিয়াংকা দেবী পাল বলেন, অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার ও প্রকৌশলীদের সমন্বয়ে একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। তারা প্রকল্প এলাকায় গিয়ে সরেজমিন দেখে প্রতিবেদন দাখিল করার পর পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অনিয়মের অভিযোগ পাওয়ার পর সব কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কোন ধরনের অনিয়ম গ্রাহ্য করা হবেনা বা এর সাথে যারাই জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বীর মুক্তিযোদ্ধা অজিত কুমার মন্ডলকে হুমকি দেওয়ার বিষয়টি তিনি অবগত নন এবং এবিষয়ে কেউ অভিযোগ করেননি। এরপরও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে হুমকি দেওয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।