নাইমুর রহমান, এডিটর ইন চীফ॥
নাটোরের সিংড়া ও গুরুদাসপুর উপজেলায় অতিবর্ষণে সৃষ্ট অকালবন্যা রোধে কৃষি বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর সুপারিশ নিয়ে এক বছর আগে নয় দফা প্রস্তাবনা তৈরী করেছিল নাটের জেলা প্রশাসন। সে সময় ওই দুই উপজেলায় সৃষ্ট অকালবন্যা পরিদর্শনে আসেন দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। তার নিকট পেশ করা হয় ওই প্রস্তাবনাসমূহ। মন্ত্রী সেগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে মন্ত্রনালয়ে পাঠানোর নির্দেশ দেন এবং সে অনুযায়ী তড়িত পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস দেন।
প্রস্তাবগুলো প্রেরণ তো দূরের কথা, এক বছর পর খোঁজ করা হলে তার একটিরও হদিস পাওয়া যায়নি। নয় দফার ব্যাপারে এখন তথ্যই নেই জেলা প্রশাসন ও কৃষি বিভাগের কাছে। অথচ ২০১৭ সালের ১লা মে মধ্যরাত পর্যন্ত মন্ত্রী ও জেলা প্রশাসনের বৈঠকে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে জেলার সকল উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তাদের সামনেই প্রস্তাবগুলো দেয়া হয়।
প্রস্তাবনাগুলো ছিলো- সিংড়া উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত আত্রাই নদীতে রেগুলেটর নির্মাণ করে পানি নিয়ন্ত্রণ ও অতিবৃষ্টি থেকে ফসল রক্ষায় খালগুলোর পানি নিষ্কাশন, চলনবিল এলাকার সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্প বাস্তবায়ন, সিংড়ার রাণীনগর, পাটকোল,সারদানগর, বিলদহর, আনন্দ নগর, বিলহরবাড়ি ও জোড়মল্লিকাঘাট, নলডাঙ্গার হালতিবিল এবং গুরুদাসপুরের যোগেন্দ্রনগর ও ভাসানী খালের উপর রেগুলেটর ও স্লুইচগেট নির্মাণ ও মেরামত, সিংড়ার ছাতারদীঘি ইউনিয়ন বাঁধের ভাঙ্গন রোধে তীর প্রতিরক্ষা প্রকল্পের বাস্তবায়ন, সিংড়া ও গুরুদাসপুরের খালগুলোর পরিকল্পনামাফিক ড্রেজিং, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ঋণের কিস্তি পরিশোধ, প্রয়োজনে মওকুফ, অতিবৃষ্টিতে নিমজ্জিত সিংড়া ও গুরুদাসপুরের কৃষকদের পরবর্তী মৌসুমে কৃষি প্রণোদনাদান, সিংড়া ও গুরুদাসপুরের সড়কগুলো ক্ষতির হাত থেকে রক্ষার জন্য প্রটেকশন ওয়াল নির্মাণ এবং গুরুদাসপুরের ভাসানী, ভদ্রা ও মির্জা সাইদ খাল পুনঃখনন।
মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার কাছেও অনুরুপ দাবী ছিল সিংড়া ও গুরুদাসপুর উপজেলার কৃষকদের। মন্ত্রী ত্রাণ দিতে গেলে তারা ত্রাণের পরিবর্তে দ্রুত রেগুলেটর, স্লুইচগেট নির্মাণ, খালখনন ও ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে পরবর্তী ক্ষতির হাত থেকে তাদের রক্ষার দাবী করেন। মন্ত্রী সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন।
দুই উপজেলার কৃষকদের অভিযোগ, মন্ত্রী ফিরে গেলে আর কেউ খোঁজ নিতে আসেনি। সাড়ে তিন মাস পর আবারো বন্যার কবলে পড়ে তাদের ফসল। বাঁধ ভেঙ্গে পানি ঢুকে নিমজ্জিত হয় হাজার হাজার একর জমির ধান। আর বছরঘুরে আবারো ফসলহানি। চলতি বছর ৩৮ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে সিংড়ায়। এর মধ্যে সরকারি হিসেবে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হয়েছে মাত্র ১০ হেক্টর ও আংশিক নিমজ্জিত হয়েছে ৫০ হেক্টর। তবে বাস্তবে পরিমাণ আরো বেশি।
উচ্চ পর্যায়ের প্রশাসনিক আশ্বাসের পরও দাবীগুলো পূরণ না হওয়ায় ক্ষুদ্ধ কৃষকরা। পরপর তিনবার ফসলহানির কবলে চলনবিলের কৃষক। সাম্প্রতিক সময়ের অতিবর্ষণ ও বন্যায় বেশিরভাগ কৃষকেরই ডুবেছে সম্পূর্ণ বোরো ধান। ন্যায্য দাম না পাবার শঙ্কা তো আছেই, তার উপর ফসলহানি। সবমিলিয়ে ধানের মতই হতাশায় ডুবছে কৃষকরা।
সিংড়ার দমদমা এলাকার আলতাব হোসেন ৬ বিঘা জমিতে রোপণ করেছিলেন বোরো ধান। পাকার ক’দিন আগেই অতিবর্ষণে ডুবেছে সবটুকু। সাতপুকুরিয়া এলাকার কৃষক সজলেরও ১৭ বিঘা জমির আধাপাকা ধান এখন পানির নীচে। চৌগ্রামের ইসমাইল হোসেন, সরদানগরের তাজুল ইসলাম, দক্ষিণ দমদমার সাইদুল ইসলামসহ কয়েকশ কৃষক নিমজ্জিত আধাপাকা ধান কেটে ঘরে নিয়েছেন।
চলনবিল এলাকার কৃষকদের কাছে অতিবর্ষণ এখন আতঙ্কের। বৃষ্টির পানি নামার জন্য খালগুলো খনন নেই দীর্ঘদিন। তার উপর চলনবিলের বিভিন্নস্থানে সোঁতিজাল ও বাঁধ দিয়ে পানি আটকে মাছ শিকার করছে প্রভাবশালীরা। অপরিকল্পিত পুকুরখনন তো রয়েছেই। জীর্ণ স্লুইটগেটগুলো কাজে আসছে না কৃষকদের। দুর্যোগকালীন সময় ব্যতিরেকে অন্য সময় আলোচর বাইরেই থাকছে চলনবিলের কৃষকের সমস্যা।
চলনবিল নিয়ে কাজ করা সংগঠন চলনবিল জীববৈচিত্র সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক আক্তারুজ্জামান বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে প্রাকৃতিক দূর্যোগে ফসলহানির ঘটনা ঘটছে চলনবিলে। এমনটি অব্যাহত থাকলে আশংকাজনক হারে ফসলের উৎপাদন হ্রাস পাবে। ফসলহানি রক্ষায় সময়োপযোগি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রাকৃতিক পরিবেশের বিপর্যয়ই মূলত অকালে ফসলহানির জন্য দায়ী। তবে মানবসৃষ্ট বাধাগুলো দূর করা গেলে ক্ষতি কিছুটা কমবে।
চলবিলের ফসল রক্ষায় সময়োপযোগি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার ব্যাপারে একমত পোষণ করে নাটোরের জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন বলেন, খাল খনন, স্লুইচগেট নির্মাণসহ কৃষকদের দাবীগুলো পূরণেরর মাধ্যমে ভবিষ্যতে ফসলের চাষাবাদ বিষয়ে একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা যেতে পারে। বিষয়টি ভেবে দেখা হবে।