নবীউর রহমান পিপলৃু ও নাইমুর রহমান, লালপুর ঘুরে
ভাঙ্গন আতঙ্ক যেন পদ্মাবিধৌত নাটোরের লালপুর উপজেলার ৮টি গ্রামের মানুষের নিত্যনিয়তি। তীর সংলগ্ন উপজেলার পালিদেহা, গৌরীপুর, নুরুল্লাপুর, লক্ষীপুর, তিলকপুর, লালপুর, মোমিনপুর, বিলমাড়িয়া প্রভৃতি গ্রাম নদীগর্ভে বিলীন হতে চলেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে নুরুল্লাহপুর গ্রাম। নদী থেকে স্থানীয় প্রভাবশালীদের বেপরোয়া বালু উত্তোলন আর চলতি মৌসুমে পানির চাপে প্রতিদিন ভাঙছে পদ্মা তীর রক্ষায় নির্মিত সিসি ব্লক। তীর ভাঙ্গার সাথে সাথে নদী গর্ভে বিলীন হতে হচ্ছে আবাদী জমি। এই ভাঙ্গনের মুখে এলাকার অন্তত ৩৩ পরিবারের বাড়িঘর বর্তমানে হুমকির মুখে পড়েছে। যে কোন সময় এসব পরিবারের আশ্রয়স্থল পানিগর্ভে তলিয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। এমন অবস্থায়, পরিদর্শনের মধ্যেই ভাঙ্গন রোধের তৎপরাতা সীমবিদ্ধ রেখেছে স্থানীয় প্রশাসন। তবে স্থানীয় প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের দাবী, ভাঙ্গন রোধে তারা ইতোমধ্যেই তৎপরতা শুরু করেছেন।
ভাঙ্গনের হুমকীর নিয়ে দিন কাটছে লালপুরের পদ্মা তীরবর্তী নুরুল্লাপুর গ্রামের কয়েকশ মানুষের। নিজেদের ভিটেমাটি রক্ষার প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে ধ্বস ঠেকানো সিসি ব্লক রক্ষায়। ধ্বস ঠেকাতে গ্রামবাসীরা নিজেরাই বাঁশ, কাশফুল, কচুরিপানা ও গাছ-পালা ব্যবহার করছেন। কখনও আবার নদী ভাঙ্গন রক্ষায় বিশেষ দোয়া প্রার্থনা ও মিলাদ মাহাফিল করেছেন। তারা পানি উন্নায়ন বোর্ডসহ সরকারের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পদ্মার লালপুর অংশে অবস্থিত ৮টি গ্রাম রক্ষার্থে উপজেলার তিলকপুর থেকে গৌরীপুর পর্যন্ত ২২৬.০৪ কোটি টাকা ব্যয়ে সি.সি. ব্লক দিয়ে ৮.৫৮৫ কি: মি: দৈর্ঘ্য বাঁধ নির্মাণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
নুরুল্লাপুর গ্রামবাসী জানান, নির্মিত সিসি ব্লকে ফাটলের সৃষ্টি হয় গত বর্ষা মৌসুমে। তখন বালির বস্তা ফেলে গ্রামটিকে সাময়িখ ঝুঁকিমুক্ত করা হয়। চলতি বর্ষা মৌসুমে নদীতে পানি বৃদ্ধির পেলে বালির বস্তা পানিতে তলিয়ে যায়। তখন ঢেউ আছড়ে পড়লে তীর রক্ষার সিসি ব্লক ধ্বস দেখা দেয় এবং সেগুলো ধীরে ধীরে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। বর্তমানে নদীর তীর রক্ষা বাঁধের কয়েকশ গজ এলাকা ধ্বসে বিলীন হয়েছে পদ্মায়।
আতংকিত গ্রামবাসী বিষয়টি জেলা ও উপজেলা প্রশাসনসহ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানিয়ে তড়িৎ হস্তক্ষেপের আবেদন করেছে। তাদের অভিযোগ, কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ আধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে নদী থেকে বালি ও ভরাট উত্তোলন করছে। এতে নদীর তলদেশ ফাঁকা হয়ে যাওয়ায় নদীর পাড়ে ভাঙ্গন সৃষ্টি হচ্ছে।
সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, ভাঙ্গনরোধে প্রশাসনের তৎপরতা শুরুর অপেক্ষায় বসে নেই ভুক্তভোগী গ্রামবাসী। বসতভিটা রক্ষায় শিশু-যুবক-বৃদ্ধ সকলেই পানিতে নেমে পাড়জুড়ে পুঁতে রাখছে বাঁশের ফালি, গাছেল ডাল প্রভৃতি। দূরে দাঁড়ানো নারীদের চোখে যেন ভিটেমাটিটুকু বাঁচানোর আকুতি।
নুরুল্লাপুর গ্রামের প্রধান আবুল হোসেন, আবুল কালাম, রাকিব, রেজাউল, জিয়াউল সরদার প্রমূখ বলেন, ‘ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালি আর ভরাট তোলার কারণেই নদীর পাড় ভাঙ্গছে। এছাড়া তাদের গ্রাম সোজা এখন পদ্মা নদীতে নিমজ্জিত চরজাজিরা, চরমহাদিয়াড় ও কুলচরা লক্ষীপুর চরগুলোর মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে।’
একই গ্রামের আমজাদ হোসেন, সামির উদ্দিন, রেজাউল ও আবু বক্কার জানান, গত কয়েক বছর আগে নির্মিত এই ব্লক পানি বাড়ার সাথে সাথে ধ্বসে গেছে। দুদিন আগে ধ্বসের পরিমান প্রায় ১০০ গজ ছিল কিন্তু এখন তা প্রায় ৩০০ গজ ছাড়িয়ে গেছে।
চরে কৃষিকাজ করে জীবকা নির্বাহ করা পরিবারগুলোর দাবী, শুকনো মৌসুমে অন্তত ২ হাজার একর জমিতে আমরা আখ, ধান, গম, মশুর, কালাই ও সবজির আবাদ করে তারা জীবিকা নির্বাহ করে। বালি ও ভরাট তোলার কারণে শুধু বাঁধই নয়, চরে আমাদের আবাদী জমিও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। বালি ও ভরাট তোলা বন্ধ হলে ভাঙ্গনের ঝুঁকি কমে আসবে।
ষাটোর্ধ বয়সী তনেজা বেগম বলেন, তারা খুবই গরীব। তাদের জীবন চলে দিন মজুরী করে। নদী ভাঙ্গনের জন্য তাদের এখন ঘুম হারাম হয়ে গেছে। সব সময় আতংকে থাকতে হয় এক চিলতে জমি নিয়ে। কখন নদী গর্ভে তা হারিয়ে যায়। এই প্রতিবেদকদের সরকারের লোক ভেবে হাত জোর করে আকুতি জানাতে জানিয়ে নদী ভঙ্গন বন্ধ করার জন্য বলেন। প্রতিবেদকদের হাত চেপে ধরে তার কথা রাখার নিবেদন করতে থাকেন। বলেন বাড়ি ঘর সহ এই জমি নদীতে চলে গেলে জমি কোথায় পাবে, কোথায় বাড়ি পাবে তারা।
স্থানীয় ইউপি সদস্য হাফিজুর রহমান বলেন, নুরুল্লাপুরের এই ভাঙ্গনের হুমকির মুখে রয়েছে অন্তত অর্ধশত বাড়ি। ভাঙ্গন রোধে বালির বস্তা ফেলার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড ও উপজেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন জানানো হয়। এখনও কোন উদ্যোগ না দেখে গ্রামবাসী নিজেরাই বাঁশ,গাছ,কাশ ফুল ও কচুরী পানা ফেলে ভাঙ্গন রোধের চেষ্টা করে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী প্রকৌশলী আশেক আলী মিঞা বলেন, ‘সিসি ব্লক ধ্বসের ঘটনায় নুরুল্লাহপুরসহ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা পরিদর্শন করা হয়েছে। আগামী দু-একদিনের মধ্যে বিশেজ্ঞদের দ্বারা টেকন্যিকালি ধ্বসের পরিমাপ ও সম্ভাব্যতা বিশ্লেষণ করা হবে। প্রয়োজনে বিষয়টি বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলীকে অবহিত করা হবে। আমরা সার্বিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছি।’
লালপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার উম্মুল বানীন দ্যুতি বলেন, ‘ব্লক ধ্বসের ব্যাপারে ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডকে অবহিত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি।’
অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের বিষয়টি স্বীকার করে ইউএনও বলেন ‘চুরি করে বালি ও ভরাট উত্তোলন যে কোন মূল্যে বন্ধ করা হবে।’